প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্বের পঞ্চমূল নীতি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সর্বাধিক উপযোগের সঙ্গে বলা হয়েছে ‘যুক্তিসঙ্গত বণ্টনে’র কথা৷ সমাজের আজ যে প্রচণ্ড রকমের অর্থনৈতিক বৈষম্য, এর অবসান হওয়া উচিত৷ এজন্যে মূলনীতি হবে ঃ

১) প্রথমে সকলেরই প্রাথমিক চাহিদার গ্যারাণ্ঢীর ব্যবস্থা, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের গ্যারান্টীর ব্যবস্থা৷ এজন্যে রাষ্ট্র এই সবগুলি সবার বাড়ীতে পৌঁছে দেবে তা নয়৷ সকলেরই ক্রয়ক্ষমতা যেন এমন থাকে যাতে অন্ততঃপক্ষে তারা ওইগুলির ব্যবস্থা করে নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা, সকলের কর্মসংস্থানের গ্যারাণ্ঢী দেওয়া, মূল্যবৃদ্ধি কঠোর হস্তে রোধ করা ও সমাজের নিম্নতম বেতনের কর্মচারী যাতে পূর্বোক্ত মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্রয়ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়, তদনুযায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূলস্তরকে ধরে রাখা৷ এই সমস্তের মাধ্যমে সমাজের সকলের প্রাথমিক চাহিদার গ্যারাণ্ঢীর বিধান করা যেতে পারে৷

তবে, সকলের সমান বেতন বা মজুরী হোক্ এটা একটা অবাস্তব তত্ত্ব আর এ হ’লে শ্রমিকের উৎপাদনের উৎসাহ নষ্ট হয়ে যাবে৷ প্রচণ্ড মিলিটারী ব্যবস্থাতেও এই বিপর্যয় রোধ করা যাবে না, এতে উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত মানেরও চরম অবনতি হবে৷ তাই কর্মীর দক্ষতা ও বিশেষ গুণের জন্যে অতিরিক্ত মজুরী’ বা incentive  দেবার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে৷ (তবে নীতি ও আাধ্যাত্মিকতাভিত্তিক সমাজে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে কর্মের একটা আত্মিক প্রেরণাও কাজ করবে৷ তাই এই কর্মপ্রেরণা পুরোপুরি বস্তুগত হবে না৷) এর পর আর এও প্রয়াস চালানো হবে, সমাজে উচ্চতম আয় ও নিম্নতম আয়ের মধ্যে ব্যবধান কত কম করা যায়৷

প্রাউটের তৃতীয় নীতি হ’ল, সমাজের যুগপৎ ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বপ্রকার ভৌতিক •Physical—,  মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটাতে হবে৷ সমাজে কেউ কেউ সমষ্টিকে অবহেলা করে ব্যষ্টি–স্বার্থের ওপর বেশী জোর দিতে চায় ও বলা হয় সমস্ত ব্যষ্টি যদি অবাধে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির সুযোগ পায়, তাহলে সামূহিক উন্নতি এমনিতেই হবে৷ এই ব্যষ্টি–স্বাতন্ত্র্যবাদ্ মারাত্মক কুফল দেখে কার্লমার্কস ব্যষ্টি–স্বার্থকে সমষ্টিস্বার্থের কাছে সম্পূর্ণ বলি দেবার পরামর্শ দিলেন৷ এর ফলে ব্যষ্টির সার্বিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেল৷ কাল্পনিক সমষ্টিদেহের কল্যাণের নাম করে (যেন কোন অদৃশ্য দেবতার নামে উৎসর্গ করা) কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রনায়কদের ব্যষ্টির স্বাধীনতাকে দলিত মথিত করার বিরুদ্ধেই দেখা গেছে সল্ঝেনিংসিন্ ও শাখারভের বিদ্রোহ৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা দর্শন করে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছেন–‘সমষ্টির প্রতি ব্যষ্টির উপেক্ষা ক্রমশঃই বেড়ে উঠেছিল বলেই সমষ্টির দোহাই নিয়ে আজ ব্যষ্টিকে বলি দেবার আত্মঘাতী প্রস্তাব উঠেছে, তীরে অগ্ণিগিরি উৎপাত বাধিয়েছে বলে সমুদ্রকেই একমাত্র বন্ধু বলে এই ঘোষণা৷ তীরহীন সমুদ্রের রীতিমত পরিচয় যখন পাওয়া যাবে, তখন কূলে ওঠবার জন্যে আবার আঁকুপাঁকু করতে হবে৷ সেই ব্যষ্টি বর্জিত সমষ্টির অবাস্তবতা কখনই মানুষ চিরদিন সইবে না৷’’ তাই প্রাউট বলছে, ব্যষ্টিস্বার্থ ও সমষ্টির কল্যাণের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হবে৷ সমষ্টি স্বার্থের দিকে তাকিয়েই ব্যষ্টির মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক যে অনন্ত সম্ভাবনা আছে, তার বিকাশ ঘটানোর জন্যে রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণ প্রয়াসী হতে হবে৷

প্রাউটের চতুর্থ মূল নীতি হ’ল, উপরিউক্ত সমস্ত সম্পদের উপযোগের ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি মেনে চলা উচিত৷ কোন বিশেষ সম্পদের বা কোন বিশেষ ব্যষ্টি বা শ্রেণীর বিশেষ গুণের কেবল উপযোগ নেওয়া হবে, অন্য সম্পদ বা অন্যান্য মানুষের গুণের উপযোগিতা সমাজ নেবে না, এ যেন না হয়৷

প্রাউটের পঞ্চম নীতি হ’ল, যুগের দাবী মেনে নিয়ে প্রয়োজন মত উপযোগ নীতিরও পরিবর্ত্তন করে যেতে হবে৷ সব দেশেই, বা সব মানুষের ক্ষেত্রে এক উপযোগ নীতি মেনে চলতে হবে, এধরনের গোঁড়ামী থাকা উচিত নয়৷ এ ধরনের গোঁড়ামীর জন্যে জাতিভেদ, সম্প্রদায়ভেদ ও বিভিন্ন ইজ্মের লড়াই অহরহ সমাজে হয়ে চলেছে৷ তাই পরিস্থিতি বিচার করে উপযোগ নীতির পরিবর্ত্তনে প্রাউট স্বীকৃতি দিচ্ছে৷