প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা ঈশ্বরলাভের জন্য বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে নির্জন স্থানকেই তপোভূমি হিসাবে বেছে নিতেন৷ খুব প্রয়োজন না হলে তাঁদের লোকালয়ে আসতে হত না বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যথেচ্ছভাবে মিশতে হত না৷ কিন্তু আমরা যারা সংসারে বাস করি আমাদের নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মিশতে হয়৷ কারও সঙ্গ খুব ভাল লাগে--- মনে হয় অনেকক্ষণ আমার কাছে থাকুন আবার কাউকে দেখলেই মনে মনে একটা বিরক্তিভাব চলে আসে--- তিনি কখন সামনে থেকে চলে যাবেন সেই অপেক্ষায় থাকি, যত বেশী সৎ মানুষের সঙ্গে লাভ করব তত আমাদের মঙ্গল৷ তারকব্রহ্ম যে সময়ে পৃথিবীতে এসেছেন আমরাও সেসময় জন্ম গ্রহণ করেছি, তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি , তাঁর মূল্যবান প্রবচন শুনেছি--- এটা নিশ্চই অনেক জন্মের পুন্যফলে সম্ভব হয়েছে, তারকব্রহ্ম ছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক , অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়৷ তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যাঁদের সঙ্গ লাভে নিজেকে ধন্য মনে হয়৷ মনে হয় তাঁদের সঙ্গে শুধু এজন্মের নয়, জন্মান্তরের কোন সম্পর্ক ছিল৷ এরকম একজন ব্যক্তি হলেন আচার্য বিজয়ানন্দ অবধূত৷
আমার কাকু সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়ার পর তাঁকে খুঁজতে গিয়ে প্রথম যে সন্ন্যাসী দাদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় আচার্য বিজয়ানন্দ অবধূত, প্রথম দর্শনেই তিনি মনটাকে জয় করে নিয়েছিলেন, কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন---আনন্দমার্গ আশ্রমে যে একবার আসে সে আনন্দমার্গের আদর্শ থেকে বেশীদিন দূরে থাকতে পারে না৷ সত্যি-সত্যিই একবছরের মধ্যেই আনন্দমার্গের আদর্শে দীক্ষিত হই৷ মেদিনীপুরে তিনি বেশীদিন থাকেন নি৷ মার্গের কাজে অন্যত্র বদলি হয়েছেন, শেষে পাকাপাকিভাবে কেন্দ্রীয় আশ্রমে চলে আসেন৷ যখনই গুরুদর্শনে গিয়েছি, তখনই সময় করে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি৷ বোধ করি তিনিও এই সামান্য মানুষটিকে কাছে পেলে খুশী হতেন৷ আমার ভাল মন্দ সব কিছু খোঁজ নিতেন এবং কথার মাধ্যমেই ৰাৰার আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করাতেন৷ ইন্দিরা গান্ধী ভারতবর্সে জরুরী অবস্থা জারী করেছেন,অধিকাংশ সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী জেলবন্দী অথবা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করেছেন৷ এই সময় নিজেকে খুব একাকী মনে হয়েছে, অনেক সময় হতাশা মনটাকে গ্রাস করেছে, বিশেষ করে ৰাৰা যে সময় জেলে ছিলেন, তাঁকে জেলের মধ্যে ঔষধ খাওয়ানোর নামে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে, হত্যার চক্রান্তের প্রতিবাদে সুদীর্ঘ অনশন করে চলেছেন, তখন একদিন খুব ভেঙে পড়েছিলাম৷ মনে হয়েছিল---আনন্দমার্গ শেষের পথে ফলে অন্য কোন সংঘটনে চলে যাওয়াই শ্রেয়৷ সেসময় মনে হল বিজয়ানন্দদার কথা৷ স্কুল ছুটির পর একদিন কোলকাতা রবানা হলাম৷ তখন তিলজলা আশ্রম তৈরী হয়নি৷ খুব সম্ভবতঃ লেকগার্ডেন্সের আশ্রমও হয়নি, দাদা তখন থাকতেন লেক গার্ডেন্সের পাশেই ছোট্ট একটা বাড়িতে৷ আমি সন্ধ্যার কিছু আগে দাদার কাছে পৌঁছালাম৷ দাদা সেদিন খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে রাত্রি প্রায় দুটা পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিলেন৷ ৰাৰা কী জন্যও পৃথিবীতে এসেছেন, সংঘটনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী হবে, এজন্য আমাদের কী করতে হবে--- সবকিছু খোলাখুলি আলোচনা করলেন৷ আমার অধিকাংশ প্রশ্ণের উত্তর পেয়ে গেলাম, মনের সংশয় দূর হল এবং অস্থির মনে একটা সুস্থিতি ফিরে এল৷ দাদার সঙ্গে সেদিন দেখা না হলে বোধ করি জীবনটা অন্য দিকে মোড় নিত৷ পাঁশকুড়ার ব্লকে ব্লকে ছটি আনন্দমার্গ স্কুল আছে৷ সব স্কুলেরছেলে-মেয়েদের নিয়ে আমরা একটি ব্লক পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম, বিজয়ানন্দদা ছিলেন ঐদিনের বিশেষ অতিথি৷ দুপুরে খাওয়ার পর ছিল অভিভাবকদের নিয়ে একটি সভা এবং সবশেষে পুরস্কার বিতরণ, ঐদিনের সভায় এলাকার বহু শিক্ষিত মানুষ যোগ দিয়েছিলেন, দাদার বক্তব্য শুনে তাঁদের অনেকেই মার্গের আদর্শ আরও ভাল করে জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং কেউ কেউ আনন্দমার্গ সংঘটনের মূল কেন্দ্র আনন্দনগর ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন৷ কয়েকজন স্থানীয় মার্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাস খানেক পরে আনন্দনগর ঘুরেও এলেন৷ ঐরকম একটা সময় হিতব্রতানন্দ দাদা ও অপর একজন দাদার পাঁশকুড়া এলাকায় অবস্থান সোনায় সোহাগার কাজ করল৷ ফলে দেখতে দেখতে শ্রী মনিলাল মাইতি, শ্রী অশ্রুকুমার মণ্ডল, শ্রীরণজিৎ রাউত. শ্রীধনঞ্জয় মিশ্র, শ্রীমৃত্যুঞ্জয় মিশ্র প্রমুখ বেশ কিছু ব্যক্তি আনন্দমার্গের সাধনা শিখলেন ও মার্গের আদর্শ প্রচারে ব্রতী হলেন৷ বিজয়ানন্দদা রঘুনাথ বাড়িতে এসে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেলেন ঠিকই, কিন্তু আনন্দমার্গ স্কুলের পরিবেশটি তাঁর ভাল লাগল না, অনেক ছাত্র-ছাত্রা পাশাপাশি ঠাসাঠাসি করে দু-তিনটি ছোট ছোট রূমে বসে ক্লাশ করছে দেখে তিনি খুব দুঃখ পেলেন৷ তিনি মার্গের নিজস্ব জায়গায় খোলামেলা পরিবেশের মধ্যে স্কুল করার পরামর্শ দিলেন৷ তাঁর উপদেশ টনিকের মত কাজ করল৷ কিছু দিনের মধ্যেই রঘুনাথবাড়ি স্কুলের নিজস্ব জায়গা হল এবং ইষ্টক নির্মিত দোতলা বাড়িও তৈরী হল৷ বর্তমানে তা ত্রিতল পাকাবাড়ি এবং ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাড়ে চারশ৷
আশির দশকে আমি খুব শ্বাস কষ্টে ভুগতাম৷ দাদা একদিন পরামর্শ দিলেন--- আমি যেন আর দাড়ি না কামাই৷ দাড়িতে ক্ষুর বা ব্লেড লাগানো যাবে না৷ কাঁচি দিয়ে ছোট করা যেতে পারে৷ তাঁর উপদেশ আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি ও উপকারও পেয়েছি৷
তিনি প্রায়ই বলতেন---সুভাষ! তোমার দু-ছেলে চাকরি পেয়ে যাবে৷ চাকরি পেয়ে গেলে তুমি শিক্ষকতা ছেড়ে দেবে ও মার্গের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করবে৷ সেমিনার উপলক্ষ্যে দাদা একবার শিলদায় এসেছিলেন৷ ওখানেও বললেন---তোমার ছেলেরা বসে থাকবে না৷ চাকরি পাবেই ওরা চাকরি পেলে তোমার আর চাকরি করার দরকার নেই৷ ঝাড়গ্রাম -বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে তাঁর একটা পরিকল্পনা আছে জানালেন---প্রোজেক্টে তিনি আমাকে চান৷ আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম৷ আমাদের দুর্ভাগ্য এরকম একজন মানবদরদী সর্বত্যাগী প্রতিভাবান মানুষকে আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারলাম না৷ তাঁর অকাল প্রয়াণে আদিবাসী-কল্যাণ প্রোজেক্টটি অঙ্কুরে বিনষ্ট হল৷
আমার প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম৷ আমার মা মারা যাওয়ার পর লোকামুখে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমাদের সবার খবর নিয়েছেন এবং অযাচিতভাবেই বললেন যে তিনি শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আসবেন৷ তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন৷ সত্যস্বরূপানন্দদাক্ নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রয়োজনীয়তার কথা ভালভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন৷ উপস্থিত শিক্ষিত ও যুব সমাজ একটি নূতন দিশা খুঁজে পেলেন৷
১৯৯০ সালে গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তিরোধানের পর কিংকর্ত্তব্য বিমূঢ় শোক বিহ্বল মার্গীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রকৃত অভিভাবকস্বরূপ৷ গুরুদেবের পার্থিব শরীর ত্যাগ করার পর আমরা পিতৃহীন হয়েছিলাম ২০০২ সালে বিজয়ানন্দদার অকস্মাৎ প্রয়াণে আমরা অভিভাবকহীন হয়েছিলাম৷
- Log in to post comments