পরমপুরুষের গুণ বর্ণন করা সম্ভব নয়৷ তবুও মানুষ আত্মতৃপ্তির জন্যে কিছু বলার, কিছু বর্ণনা করার চেষ্টা করে থাকে৷ বলা হয়েছে ––
‘‘প্রভুমীশমনীশমশেষ্ গুণহীনমহেশ গণাভরণম্৷’’
পরমপুরুষের গুণের আর শেষ নেই৷ আর মানুষের ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র কণ্ঠ সেই অশেষ গুণের বর্ণনা করবে কী করে? কবি পদ্মদন্ত পরমপুরুষের গুণের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন ––
‘‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জ্বলং সিন্ধুপাত্রে
সুরতরুবরশাখা লেখনীপত্র মুর্বী৷
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং
তথাপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি৷৷’’
লিখতে গেলে কালির দরকার৷ পরমপুরুষের গুণবর্ণন করতে গেলে, তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে কী ধরনের কালি চাই? –– না, হিমালয় পর্বতের মত একটা প্রকাণ্ড কালির বড়ি চাই৷ আর ‘কজ্জ্বলং সিন্ধুপাত্রে’৷ সেই কালির দোয়াতটা কত বড় হবে? –– না, সমুদ্রের মত প্রকাণ্ড৷ আবার লেখার জন্যে একটা কলমও তো চাই৷ সেটা কত বড় হবে? –– না, স্বর্গের পারিজাত নামে যে বৃক্ষ রয়েছে তার শাখাকে যদি আমরা লেখনীরূপে ব্যবহার করি তবেই তা সম্ভব৷ আবার লিখতে গেলে কাগজও তো চাই৷ এখন এই সমগ্র ধরাপৃষ্ঠকে যদি কাগজের মত ব্যবহার করি তবে হয়তো কিছুটা গুণবর্ণন করা যেতে পারে৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে –– এরকম কালি অর্থাৎ হিমালয়ের মত প্রকাণ্ড কালির বড়ি, এই ধরনের লেখনী, এত বড় দোয়াত –– এই সব কিছু নিয়ে স্বয়ং সরস্বতী যদি লিখতে বসেন ও তাও অল্প সময় নয়, অনন্তকাল ধরে লেখেন তা হলেও পরমপুরুষের গুণবর্ণন সম্ভব নয়৷
তবুও তো মানুষের মন চায় অন্ততঃ কিছুটা বর্ণন করতে৷ বেদব্যাস মহাপণ্ডিত ছিলেন৷ তিনি জানতেন যে পরমপুরুষের গুণবর্ণন সম্ভব নয়৷ তবুও তো তিনি পুরাণে এদিক ওদিক অনেক কিছু লিখেছিলেন ও এজন্যে তিনি ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন–
‘‘রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতো যদ্ধ্যানেন কল্পিতং
স্তুত্যানির্বচনীয়তাখ্ দূরীকৃতা যন্ময়া৷
ব্যাপিত্বং চ নিরাকৃতং ভগবতো যৎতীর্থযাত্রাদিনা
ক্ষন্তব্যং জগদীশো তদ্বিকলতাদোষত্রয় মৎকৃতম্৷৷’’
পরমপুরুষ ক্ষন্ধনে বদ্ধ নন৷ তথাপি আমি তাঁকে ক্ষন্ধনে বাঁধবার চেষ্টা করে ফেলেছি৷ মানব মনের স্বাভাবিক ধর্ম হ’ল পরমপুরুষের শরণাপন্ন হওয়া৷ কেবল মানুষই নয়, জীবজগৎ, আক্ষ্রহ্মস্তম্ব অর্থাৎ সামান্য একটি তৃণখণ্ড থেকে সৃষ্টিকর্তা ক্ষ্রহ্মা পর্যন্ত সকলেই একটা আশ্রয় চায়৷ সেটা কেমন আশ্রয়? –– না, যা অটুট, যা নির্ভরযোগ্য, যা সুদৃৃ৷ এমন আশ্রয় তো কেবল একটাই –– তা হ’ল পরমপুরুষের শ্রীচরণ৷ এমন তো আর কই দ্বিতীয় আশ্রয় নেই৷ মানুষকে যদি আত্মসমর্পণ করতেই হয় তো কেবল পরমপুরুষের কাছেই তা করা উচিত৷ আর যদি কারুর নাম জপ করতেই হয় তবে কেবল পরমপুরুষেরই নাম জপ করা উচিত৷ আর যদি কাউকে প্রণাম করতে হয় তো কেবল পরমপুরুষেরই চরণে প্রণাম করা উচিত৷ লোকে বলে, ‘নমস্তে’ কিংবা ‘নমস্তুভ্যাম্’৷ তোমরা জানো যে নমস্কার শব্দটা মানুষ ও পরমপুরুষ উভয়ের উদ্দেশ্যই ব্যবহূত হয়ে থাকে৷ কিন্তু ‘নমস্তে’ বা ‘নমস্তুভ্যাম্’ কেবল পরমপুরুষকেই বলা চলে, অন্য কাউকে নয়৷
‘‘তমেকং স্মরামস্তমেকং জপাম
স্তমেকং জগৎসাক্ষীরূপং নমামঃ৷৷’’
যদি কাউকে স্মরণ করতেই হয় তবে কেবল পরমপুরুষকেই স্মরণ করা উচিত৷ এ ধরনের কথা বলা হ’ল কেন? এখন তুমি যাকে স্মরণ করবে তুমি সেই স্মরণীয় বস্তুর মতই হয়ে যাবে৷ যেমন কোন ধনী ব্যবসায়ী যদি দিনরাত কেবল টাকা পয়সার চিন্তা করে তাহলে তার মৃত্যুর পর সে তো টাকাই হয়ে যাবে, আর অপর কোন ব্যবসায়ীর ক্যাস বাক্সে বদ্ধ হয়ে থাকবে৷ এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম৷ এই জন্যে ক্ষুদ্ধিমান মানুষের কাজ হ’ল কেবল তাঁকেই স্মরণ করা৷ এতে শেষ পর্যন্ত কী হবে? –– না, তুমি তাঁর সমান হয়ে যাবে৷ এইজন্যে যদি কখনও কারুর কথা ভাবতেই হয় তাহলে কেবল তাঁর কথা ভাববে, আর কারুর নয়৷
‘তমেকং জপামঃ’৷ জপক্রিয়া কী? –– না, বিশেষ কোন শব্দমাত্রাকে বার বার মনে মনে বলা ও জিবের সহায়তায় এমন ভাবে উচ্চারণ করা যাতে সেই শব্দ অন্যের শ্রতিশ্রুতিগোচর না হয়৷ এরই নাম জপক্রিয়া৷
শাস্ত্রে তিন ধরনের জপক্রিয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে৷ একঃ মানসিক জপ, যে ব্যষ্টি মনে মনে জপ করছে কেবল সেই শুণছে, অপরে শুণছে না৷ দুইঃ বাচনিক জপ অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে শব্দটা বাইরের লোকে শুণছে৷ তিনঃ উপাংশু জপ অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে মন বলছে, জিব বলছে কিন্তু শুণছে কেবল মন, বাইরের কেউ শুণছে না৷
জপ করলে একটা অভ্যন্তরীণ তথা বাহ্যিক তরঙ্গ উৎপন্ন হয়৷ সেই তরঙ্গ শেষ পর্যন্ত মানুষের বৈয়ষ্টিক অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে দেয়৷ এই জন্যে যদি কারুর নাম জপ করতে হয় তো কেবল পরমপুরুষের নামই জপ করা উচিত, আর কারুর নয়৷ তাই বলা হয়ে থাকে –– ‘তমেকং জপামঃ’ অর্থাৎ কেবল তাঁরই নাম জপ কর, অন্যের নাম নয়৷