প্রসঙ্গ তেইশে জানুয়ারী---‘‘আমি কারো প্রতিচ্ছবি নই, প্রতিধবনি নই’’

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

তেইশে জানুয়ারী---ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপোষহীন সংগ্রামী বিপ্লবী মহানায়ক সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন৷ বাঙালীর কাছে এ বড় বেদনারও দিন৷ এই দিন সেই সব হাতগুলো পুষ্পস্তবক নিয়ে নেতাজীর মূর্ত্তির সামনে দাঁড়াবে যাঁরা বা যাঁদের পূর্বসূরী সুভাষচন্দ্রকে জব্দ করতে তলে তলে ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল৷ ওদেরই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সুভাষচন্দ্রকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল৷ কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট, আর.এস.এস---এদেরই বিশ্বাসঘাতকায় সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ণের স্বাধীনতা আজও অধরা৷ তিনি নিজেও কোন অজানা পথের পথিক হয়ে রয়ে গেলেন!

রয়ে গেলেন! না-কি থাকতে বাধ্য হলেন, বাধ্য করা হ’ল৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই কলঙ্কিত ইতিহাস একদিন প্রকাশ্যে আসবে, আর আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হয়ে যে মুখগুলো জ্বলজ্বল করছে, মূর্ত্তি হয়ে সু-উচ্চে অবস্থান করছে সেই মুখগুলো সেদিন কালো কালিতে ঢেকে যাবে৷ যতদিন না সেই দিন আসছে ততদিন দরকষাকষি স্বাধীনতার অভিশাপ বাঙলীকে বয়ে বেড়াতে হবে৷ স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য বাঙালী দিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে তার এক কানাকড়ি মূল্যও স্বাধীন দেশের সরকার বাঙালীকে দেয় নি৷

কোন অপরাধে সুভাষচন্দ্রকে হারিয়ে যেতে হ’ল? কিসের অপরাধে বাঙালীকে আজও পরাধীনতার জ্বালা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে? দেশের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য হা-হুতাশ করতে হচ্ছে? সুভাষচন্দ্রের অপরাধ---তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর জীবনাদর্শ৷ তিনি হাত পেতে স্বাধীনতা নিয়ে ক্ষমতার পিড়ি দখল করার মতলবে ছিলেন না৷ সুভাষচন্দ্রের মতাদর্শ ছিল---‘স্বাধীনতা কারোর দয়ায়, কোন আপোষ আলোচনায়, দর কষাকষির মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায় না৷ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়, অন্তহীন সংগ্রামের মাধ্যমে জয় করে নিতে হয়৷’

অন্তহীন সংগ্রামই করে গেছেন সুভাষচন্দ্র৷ কিন্তু তাঁর স্বপ্ণের স্বাধীনতা অধরাই থেকে গেছে৷ তাঁর সেই স্বাধীনতার স্বরূপ কেমন হবে তাও তিনি বলেছিলেন ১৯৩৮ সালে প্রথম কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর লণ্ডনের ভারতীয় ছাত্রদের এক সভায়---‘দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তি অর্জন করছে৷ এদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ মানুষকে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিলেই হবে না৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও অর্জন করতে হবে৷’ দেশীয় পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা---এই দুটি শব্দই সেদিন দেশীয় পুঁজিপতিদের হাড়ে কাঁপন ধরিয়েছিল৷ তাই সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে বিতাড়নের ব্লু-প্রিণ্ট সেদিনই তৈরী করেছিল দেশীয় পুঁজিপতিরা৷ তাকেই বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট ও হিন্দুত্ববাদীরা৷ রাজনৈতিক মতাদর্শে যতই পার্থক্য থাক এই এক জায়গায় সবাই এক---দেশীয় পুঁজিপতিদের স্বার্থ৷ ভারতীয় রাজনীতির এ এক অন্ধগলি৷ এই অন্ধগলি থেকে রাজনৈতিক দলগুলো আজও বের হতে পারেনি৷ তাই সি.এ.এ.-র মত কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও পরস্পরের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ হয়নি৷

যাইহোক, দেশীয় পুঁজিপতিরা সেদিনই বুঝেছিলেন সুভাষচন্দ্র যদি স্বাধীন ভারতের কর্ণধার হয় তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দেশীয় পুঁজিপতিদেরও দেশ থেকে বিদায় নিতে হবে৷ তাই জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী লবি গান্ধীর নেতৃত্বে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত শুরু করে৷ কমিউনিষ্টরা সেদিন নীরব থেকে কংগ্রেসকেই মদত দিয়েছিল৷ সেই চক্রান্তের পরিণতিতেই সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷

কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তি যাঁর জীবনের ব্রত, যাঁর জীবনাদর্শ---তাঁকে আটকায় কে! সুভাষ বুঝেছিলেন দেশে থাকলে তাঁকে ব্রিটিশ অপেক্ষা মেকী দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে অনেক বেশী৷ তাই তিনি ব্রিটিশের  চোখে ফাঁকী দিয়ে ভারতের বাইরে চলে গেলেন৷ সেখানে অপেক্ষা করছিলেন আর এক বিপ্লবী নায়ক রাসবিহারী বসু৷ তিনিও ব্রিটিশের চোখে ফাঁকী দিয়ে জাপান চলে যান৷ সুভাষচন্দ্র জাপানে গিয়ে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর দায়িত্ব নিলেন৷ তৈরী হ’ল আজাদ হিন্দ ফৌজ, আজাদ হিন্দ সরকার৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আজাদ  হিন্দ্ সরকার৷ নেতাজীর ঘা খেয়েই ব্রিটিশ ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়৷ কিন্তু সুভাষচন্দ্রের ঘরে ফেরা হয়নি৷ তাঁকে ফিরতে দেওয়া হয়নি৷ কিন্তু সুভাষ আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে, দেশীয় পুঁজিপতি ও তাদের অর্থে পুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে৷ তড়িঘড়ি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে , দেশকে ভাগ করে খণ্ডিত ভারতের শাসন ক্ষমতা  জাতীয় কংগ্রেসের হাতে তুলে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ত্যাগ করে৷

কিন্তু সুভাষচন্দ্র! সুভাষচন্দ্র কোথায়!  এর উত্তর আজও ভারতবাসী খঁুজে বেড়াচ্ছে সাংহাই, তাইহোকু, মস্কো আর তদন্ত কমিশনের পাতায় পাতায়৷ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও  এর কোন উত্তর রাজনৈতিক দলগুলো দেয়নি৷ কংগ্রেস তো বটেই, হিন্দুত্ববাদী আর.এস.এস জনসংঘ, সমাজতন্ত্রী কমিউনিষ্ট---এই এক ব্যাপারে রাজনীতির সব পক্ষ এক পক্ষ হয়ে যায়৷ তাই রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পরস্পরে যতই লড়াই করুক, মঞ্চের আড়ালে সবাই এক আজও৷

শুধু বাঙালী সেই ভিক্ষালব্ধ দর কষাকষি স্বাধীনতার অভিশাপ বহন করে চলেছে৷ ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়, সুভাষ বিরোধী সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কংগ্রেস৷ ঐতিহাসিক মাইকেল এডওয়ার্ডস তাঁর গ্রন্থে বলেছেন---Gandhi now turned the technique of non-co-operation, not against the British, but against Congress’s own President. Bose was forced to resign.

দুর্ভাগ্যের বিষয় কংগ্রেস-কমিউনিষ্টদের সেই চরিত্র আজও বদলায়নি৷ তাই তারা বাঙালী বিদ্বেষী সি.এ.এ-র বিরুদ্ধে যতটা না চিৎকার করে তার চেয়ে অনেক বেশী চিৎকার করে রাজ্য শাসক দলের বিরুদ্ধে৷

আর সুভাষচন্দ্র! গান্ধী ভক্তরা সেদিন সুভাষচন্দ্রকে গান্ধীর মত মানতে বাধ্য করাতে গান্ধীজীকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছিল৷ গান্ধীভক্ত নেতা শেঠ গোবিন্দ দাস বলেছিলেন ---‘ফ্যাসিস্টদের মধ্যে মুসোলিনী, নাৎসীদের মধ্যে হিটলার ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে স্ট্যালিনের যে স্থান, কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধীরও সেই স্থান৷’ সভায় ধবনিত হ’ল --- ‘হিন্দুস্থান কা হিটলার মহাত্মা গান্ধী কী জয়৷’

ব্যথিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন--- ‘অবশেষে আজ, এমনকি, কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেও হিটলারী নীতির জয়ধবনি শোনা গেল৷ স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্যে যে বেদী উৎসৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিস্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷’

আর সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন---‘আমি কারো প্রতিচ্ছবি নই, কারো প্রতিধবনি নই, কারো prototype  নই---I am myself৷’

সুভাষ সুভাষই৷ আর একটা সুভাষ হয় না হবে না৷ তবে ফ্যাসিস্টের সাপের অভাব হয় না৷ তাই ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলের সেই বিশেষ জায়গা থেকে আজ আবার ফ্যাসিস্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷