পরিচয় ও প্রজাতি ঃ পটোল উত্তর–পূর্ব ভারতের একটি মুখ্য সব্জী৷ কারণ এর আদি বাস পূর্ব ভারতে–বিশেষ করে গঙ্গা অববাহিকার সাহেবগঞ্জ, মালদা, নদীয়া ও রাজমহল এলাকায়৷ এছাড়াও পটোল বেশী পাওয়া যায় রাঢ়, সমতট, মিথিলা (বিহার) ও উৎকলে (ওড়িষ্যা)৷ পটোল একটি ইন্ডিকা বর্গীয় গাছ৷ বাংলায় একে পটোল বলে, সংস্কৃতেও ‘পটোল’৷ মগহীতে শাদা রঙের পটোলকে বলা হয় পটোল কিন্তু সবুজ রঙের পটোলকে বলা হয় ‘পরবল’৷ ভোজপুরীতে বলা হয় ‘পরুরা’ বা ‘পরোরা’৷ মৈথিলীতে ‘পরোর’, হিন্দীতেও ‘পরবল’, আর ইংরেজীতে বলা হয় wax gourd õ± squart gourd । মোটামুটি বিচারে পটোলের চারটি প্রজাতি আছে৷ তার তিনটি প্রজাতিই বাংলার৷ মাত্র একটি প্রজাতি বিহারের৷ বাংলার প্রজাতিগুলি হচ্ছে–পেরো পটোল (আকারে বেশ লম্বা ও সবুজগ্গ, দেশী পটোল, (বেশ লম্বা, তবে একটু শাদাটে রঙের, গায়ে সবুজ রঙের দাগ), ঢোলক পটোল (আকার খুব বড়, এই পটোলের দোরমা হয়)৷ বিহারের পটোলকে পশ্চিমা পটোল বলে (আকার ছোট, রঙ শাদা, স্বাদ তেমন মিষ্টি নয়)৷
তেলাকুচোর সঙ্গে কুঁদরির মিলন ঘটিয়ে পটোলের জন্ম হয়েছে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে৷ পটোলের সঙ্গে লাউয়ের মিলন ঘটিয়ে, অথবা কুঁদরি ও তেলাকুচোর সঙ্গে (তেলাকুচো ডায়াক্ষিটিস রোগের ও কুঁদরি হজম তথা অন্যান্য রোগের ঔষধ) পটোলের মিলনের ফলে ভাল ধরণের পটোল তৈরী হতে পারে৷
পটোল ও পটোল–লতার গুণাগুণ ঃ (১) পটোল একটি সুস্বাদু, নির্দোষ সব্জী ও সর্বরোগে সমপথ্য৷ বিশেষ করে অর্শ, আমাশয়, বহুমূত্র ও অম্লরোগে প্রাত্যহিক ভোজন তালিকায় পটোলের তরকারী সুপথ্য৷ (২) পটোলের লতার ডগার অংশকে পলতা বলে৷ পলতা একটি তিক্ত ভোজ্য ও ঔষধীয় গুণে পরিপূর্ণ৷ পলতা লিবার তথা যকৃতের পক্ষে উপকারী, এ রক্ত–পরিষ্কারক, রক্ত–বর্ধক, ক্ষুধা–বর্ধক ও নিদ্রাহীনতার ঔষধ৷ প্রমেহ (গণোরিয়া), উপদংশ (সিফিলিসগ্গ, চর্মরোগে, কুষ্ঠে ও বহুমূত্র রোগে পলতার তরকারী আবশ্যিক ভোজন৷
গ্রন্থিবাত অর্থাৎ আর্থরাইটিস্ রোগে মুখ্যতঃ পলতা ও অন্যান্য উপকরণ সহযোগে একটি ভাল ঔষধ তৈরী হয়–এক মুঠো অড়হর ডাল ১/২ দিন জলে ভিজিয়ে রেখে তারপরে শিলে পিষে নিতে হয়৷ পলতা পাতা (ধরা যাক ১০০টি) ও তার অর্ধেক কালমেঘের পাতা একত্রে পিষে নিতে হয়৷ তারপর দুই ধরনের পেষা বস্তু একত্রে মিশিয়ে মাখো মাখো অবস্থায় ছোট ছোট ওষুধের পিলের মত বানিয়ে শুকিয়ে নিতে হয়৷ তারপর প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২টি করে পিল ১/২ ফোঁটা মধুসহ খেতে হয়৷ অড়হর ডাল বাদ দিয়ে কালমেঘ পাতা ও পলতা পাতা থেকে একই প্রক্রিয়ায় বটিকা তৈরী করে নিয়ে ব্যবহার করলেও ফল পাওয়া যায়৷
(৩) যে পটোলের ভেতরের দিকটা বেশী নিরেট, তার ভাজা ভাল হয়৷ যে পটোলের ভেতর দিকটা বেশী ফাঁপা তার দোরমা ভাল হয়৷ বাংলার মানুষ ছোলার ডাল বাটা, মটর ডাল বাটা, অথবা ছানা ভরে’ পটোলের দোরমা করেন৷ ভেতরে ক্ষোয়া–ক্ষীর ভরে’ ঘিয়ে ভেজে রসে ফেলে যে পটোলের মেঠাই তৈরী হয়, তার সাবেকী জন্মস্থান লক্ষ্ণৌ৷
মূত্রস্তম্ভ ঃ
কারণ ঃ মূত্রের গতি রুদ্ধ হওয়ায় মূত্রস্তম্ভ ব্যাধিকে কবন্ধও বলা হয়৷
ঔষধ ঃ (১) মেথী ভেজানো জল (সকালে–সন্ধ্যায়)৷ (২) তাজা খেজুরের রস অথবা তাল গাছের রস (৩) শাঁখালুর রস (৪) অর্জুন ছালের ক্কাথ মূত্রস্তম্ভের ঔষধ৷ (৫) প্রত্যহ প্রাতে পরিমিত মাত্রায় শশা খেলে মূত্ররোগ ও মূত্রস্তম্ভ ব্যাধিতে ভাল ফল দেয়৷
ডালিম
সংস্কৃতে ‘দাড়িম্ব’ থেকে মৈথিলিতে ‘দাড়িম’, বাংলায় ‘ডালিম’ শব্দ এসেছে৷ এই দাড়িম্ব বা ডালিমের বৈজ্ঞানিক চর্চা করে প্রাচীনকালে বেদানার উদ্ভব হয়েছিল৷ ইংরেজীতে এই দু’টিকেই pomegranate বলা হয়৷ বেদানার ভাল নাম ‘দাড়িম্বী’৷ আকারে ডালিম বড়, মাঝারি ও ছোট নানান ধরনের হয়৷ বেদানা হয় মাঝারি আকারের৷ ডালিমের খোলার গাত্রবর্ণ কিছুটা লালচে, বেদানার গায়ের রঙ খয়ের বা কপিশ বর্ণ৷ ডালিমের দানা লাল৷ বেদানার দানা হালকা গোলাপী অথবা বেগ্নে মিশ্রিত গোলাপী৷ স্বাদে ডালিম টক অথবা টক–মিষ্টি মেশানো৷ বেদানা সাধারণতঃ মিষ্টি৷ খাদ্যগুণ ডালিম ও বেদানায় থাকলেও, বেদানায় বেশী রোগীদের পথ্য হিসেবে বেদানাই ব্যবহার্য৷ ডালিম একটি রক্ত–বর্ধক ফল৷
স্ত্রী–ব্যাধিতে ডালিম ঃ ডালিমের গাছ, ফুল ও ছাল স্ত্রী–ব্যাধির মহৌষধ৷ চীনদেশের আয়ুর্বেদে স্ত্রী–ব্যাধিতে জবাফুল ও ডালিম ফুলের ব্যবহার ব্যাপক রূপে রয়েছে৷ ৩/৪টে ডালিম ফুল কাঁচা দুধে বেটে ঋতুকালে নারীর প্রত্যহ দিনে দু’বার করে সেব্য৷ অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে রোগিনী দুর্বল হয়ে পড়লে দু’তোলা কুকসিমার রস বা দুর্ব্বার রস কিঞ্চিৎ মধুসহ ঋতুকালে প্রত্যহ একবার সেব্য৷
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে গৃহীত