রক্তচাপ (ব্লাড প্রেসার) রোগ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

লক্ষণ ঃ সুনিদ্রার অভাব, রাত্রে বার বার পেশাব করতে ওঠা, মাথা ধরা ও মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা বা বুকে বেদনা বোধ করা প্রভৃতি৷

কারণ ঃ

১) সাধারণতঃ যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে তাদের খাদ্যতালিকায় চর্বি জাতীয় বস্তু, ঘি, তেল প্রভৃতি অধিক পরিমাণে থাকলে শারীরিক ক্রিয়াশীলতার অভাবে সেই চর্বি দগ্ধ হয়ে শক্তি বা উত্তাপে পরিণত হবার সুযোগ পায় না৷ এই উদ্বৃত্ত চর্বি শরীরকে মাংস ও চর্বিপিণ্ডে পরিণত করে দেয়৷ এর ফলে দেহের বিভিন্ন যন্ত্র ও গ্রন্থিগুলির ওপর অকারণ চাপ পড়ে৷ এই উদ্বৃত্ত চর্বি শিরা–ধমনীর অভ্যন্তরে জমবার সুযোগ পেলে তন্মধ্যস্থ রক্তের গতিপথ সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়৷ স্নায়ু–ধমনীগুলি যথাযথভাবে রক্তধারা সঞ্চালিত করে হূদ্যন্ত্রকে ঠিকভাবে সাহায্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ে৷ এই অবস্থায় রক্তধারাকে ঠিকভাবে প্রবাহিত রাখবার জন্যে হূদ্যন্ত্র অতিক্রিয় হয়ে যায়৷

২) যার শারীরিক পরিশ্রম করে না কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে, তাদের দেহে রক্তাধিক্য দেখা দেয় ও ক্রমে এই রক্ত মাংস ও মেদে পরিণত হয়ে ঠিক প্রথমোক্ত ভাবেই স্নায়ু–ধমনীর ক্রিয়াশীলতাকে ব্যাহত করে ও হূদ্যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত রক্তের চাপ সৃষ্টি করে৷ এইভাবে যাদের দেহে অতিরিক্ত রক্তের চাপ সৃষ্টি হয় ও হূদ্পিণ্ডের ওপর রক্তের চাপ বর্দ্ধিত হয় তাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও যন্ত্র অনেক সময় অতিক্রিয় হয়ে অত্যধিক ক্রোধ বা কামের উদ্রেক করে৷ তাই এই ধরণের রোগীর রক্তচাপবৃদ্ধি রোগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ ও কামুকতাও বেড়ে যায়৷ কখনও কখনও অতি ক্রোধ বা অতি কামুকতা ভাব জাগার সঙ্গে সঙ্গে শিরা–ধমনী ছিঁড়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে৷

৩) যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে কিন্তু অত্যধিক পরিমাণে আমিষ বা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খেয়ে থাকে তাদের শরীরে এই উদ্বৃত্ত প্রোটিন এক অনর্থের সৃষ্টি করে৷ এই অতিরিক্ত প্রোটিন রাখবার স্থান মানব শরীরে নেই, কারণ মানবশরীরে এর প্রয়োজন নেই৷ তাই দেহযন্ত্র একে শরীর থেকে নিষ্কাশিত করে দিতে চায়৷ এই প্রোটিনের  ফলে রক্তের ক্ষার ভাগ যায় কমে ও অম্লভাগ যায় বেড়ে৷ রক্তের অম্ল ভাগ বৃদ্ধির ফলে দেহস্থ রক্তোৎপাদক ও রক্ত–পরিষ্কারক গ্রন্থিগুলি (যকৃৎ, কিড্নি প্রভৃতি) দুর্বল হয়ে যায় ও তাদের এই দুর্বলতার জের স্বরূপ শেষ পর্যন্ত শিরা–ধমনীগুলিও কঠিন ও দুর্বল হয়ে পড়ে৷ এই কঠিন ও দুর্বল শিরা–ধমনীগুলি যথাযথভাবে রক্ত পরিবহনে অসমর্থ হয়ে পড়ে ও তার ফলে হদ্যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত রক্তের চাপ পড়তে থাকে৷ এই অবস্থায় দেহযন্ত্রকে স্বাভাবিক রাখবার জন্যে হূদ্যন্ত্রকে অত্যধিক পরিশ্রম করতে হয়৷ হূদ্পিণ্ডের এই অতিক্রিয়তা দুর্বল শিরা–ধমনী সহ্য করতে পারে না ও তা ফেটে গিয়ে হতে থাকে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ৷

৪) নানাবিধ কারণে শরীরের রক্তোৎপাদক ও রক্ত–পরিষ্কারক যন্ত্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ রক্তোৎপাদক যন্ত্রগুলি বেশী দুর্বল হয়ে পড়লে শরীরে প্রয়োজনীয় রক্তের অভাব ঘটে, সে অবস্থাতেও মানুষ অনিদ্রা, মাথা–ধরা, মাথা–ঘোরা, অত্যধিক শারীরিক দুর্বলতা প্রভৃতি উপসর্গে কষ্ট পেতে থাকে৷ একে বলা হয় রক্তের নিম্নচাপ ব্যাধি৷

চিকিৎসা ঃ

প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপমুদ্রা, কর্মাসন, যোগমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, ভুজঙ্গাসন, অগ্ণিসার, বায়বী মুদ্রা বা বায়বী প্রাণায়াম৷

সন্ধ্যায় ঃ কর্মাসন, যোগমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, ভুজঙ্গাসন, অগ্ণিসার ও উপবিষ্ট উড্ডয়ন৷

আচার্য্যোক্ত পদ্ধতিতে ঈশ্বর–প্রণিধান করলেও অত্যদ্ভুত ফল পাওয়া যায়৷ বস্তুতঃ রোগীর যতদিন আসন–মুদ্রা করবার সামর্থ্য না আসছে ততদিন কেবলমাত্র ঈশ্বর–প্রণিধানই একমাত্র করণীয়৷ অন্য ভাষায় বলা যেতে পারে, ঈশ্বর–প্রণিধানই এর একমাত্র ঔষধ, আসন–মুদ্রাগুলি অনুপান মাত্র৷ এই রোগে ব্যাপক স্নান রোগীকে বিশেষ সাহায্য করে থাকে৷

পথ্য ঃ এই রোগে অম্লধর্মী খাদ্য বর্জন করে চলতে হবে ও ক্ষারধর্মী খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷ তাই যত দূর সম্ভব ভাত, ডাল ও রুটির পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ফলমূল ও শাক–সব্জীর ঝোল খাওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ আমিষ খাদ্য বর্জন করতে হবে৷ ভাজা, পোড়া ও মিষ্টি জিনিসও এই রোগে ক্ষতিকারক৷ প্রয়োজন বোধে অল্প পরিমাণ গুড় বা মধু ব্যবহার করা যেতে পারে৷

ধীরে ধীরে শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে হবে ও মানসিক পরিশ্রমের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে৷ যাদের রক্তের চাপ নিম্ন তাদের রোগ না সারা পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দিতে হবে৷ এই রোগে উপবাস অত্যন্ত হিতকর৷ তাই রোগীকে অবশ্যই একাদশী, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় উপবাস করতে হবে আর উপবাসকালে কেবলমাত্র জলই পান করা যেতে পারে৷ যাদের শারীরিক সামর্থ্য অল্প তারা এই জলের সঙ্গে নেবুর রস মিশ্রিত করে নিতে পারে৷ নিম্নচাপ রোগীদের পক্ষে উপবাসের দিন দুধ, ফলের রস প্রভৃতি ব্যবহার করা উচিত৷ চর্বিবাহুল্যের দরুণ যাদের রক্তচাপ বর্দ্ধিত হয়েছে তাদের পক্ষে দুধের পরিবর্ত্তে ঘোল অথবা অল্প পরিমাণে নারিকেলের দুধ ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়৷ রোগীকে নেশার জিনিস অথবা যে খাদ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে অথবা যার ফলে শরীরে মেদাধিক্য দেখা দিতে পারে এরূপ খাদ্য সযত্নে পরিহার করতে হবে৷ ক্রোধ ও মৈথুন থেকেও দূরে থাকতে হবে৷ হূদ্রোগের সাধারণ বিধি–নিষেধগুলি এই রোগেও মেনে চলতে হবে৷

কয়েকটি ব্যবস্থা ঃ

১) ছোট এলাচচূর্ণ এক চামচ (ছোট) কিঞ্চিৎ মধু সহ দু’বেলা সেব্য৷

২) সর্পগগ্ধা (চন্দ্রা, চন্দ্রিকা বা ছোট চাদর) পাতার রস এক চামচ কিঞ্চিৎ মধুসহ,

অথবা

৩) সর্পগন্ধামূল–চূর্ণ এক আনা বা দুই আনা কিঞ্চিৎ মধু ও ত্রিফলার জল সহ দুই বেলা সেব্য৷

৪) ভূমিকুষ্মাণ্ড–চূর্ণ এক আনা কিঞ্চিৎ মধু সহ দুই বেলা সেব্য৷

৫) সর্পগ্ধার মূল–চূর্ণ (শুঙ্ক) এক আনা বা দুই আনা মিছরীর জল সহ দুই বেলা সেব্য৷

(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ’ থেকে গৃহীত)