ঋষি অরবিন্দ স্মরণে

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তথাকথিত ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন তথা ভারতআত্মাকে খণ্ড–বিখণ্ড করার দিন আবার অপরদিকে বাঙলার বুকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঋষি অরবিন্দের আবির্ভাব দিবস৷ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে দুই তাৎপর্য্যপূর্ণ ঘটনা৷

শ্রী অরবিন্দ জড়বাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আই.সি.এস. চাকরি পরিত্যাগ করে বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের মুক্তি সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করার এক বিরল দৃষ্টান্ত৷

প্রথিতযশা চিকিৎসক ডঃ কৃষ্ণধন ঘোষের তৃতীয় পুত্র অরবিন্দ ঘোষ আশৈশব বিলেতে ইংরেজী শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে ‘অ্যাক্রোয়েভ’ অরবিন্দ ঘোষ নামে পরিচিত হলেন৷ ইংরেজ সরকারের গোলামী না করার জন্যে কৌশল করে ঘোড়ায় চড়া পরীক্ষাতে ফেল করে বসলেন৷ ১৮৯৯ সালে বরোদার রাজ্য সরকারের চাকুরীতে যোগদান করেন৷ স্বেচ্ছায় সরকারী চাকুরি ছাড়ার ঘটনাটি ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে ইংরেজী শিক্ষিত মানুষদের মোহমুক্তি ঘটানোর এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন৷ বিলেতে ছাত্রাবস্থাতেই ব্রিটিশ বিরোধী আইরিশ বিপ্লবীদের গুপ্ত বিপ্লবী সংঘটন ‘লেটস্ এ্যাণ্ড ড্যাগার’ সদস্য ছিলেন তিনি৷

অরবিন্দের সার্বিক সাধনার লক্ষ্যই ছিল সম্পূর্ণরূপে বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি স্বাধীন জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা৷ ১৯০৭ সালেই তিনি এই সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেছিলেন৷ ১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেসে ঘোষিত হয়েছিল পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব৷

১৯০৭ সালে অরবিন্দ ঘোষ দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘‘যতদিন পরের শাসন বা রাজত্ব থাকে ততদিন কোনও জাতিকে স্বরাজপ্রাপ্ত স্বাধীন জাতি বলে না৷ আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চাই, বিদেশির আদেশ ও বন্ধন হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি স্বগৃহে প্রজ্ঞার সম্পূর্ণ আধিপত্য, ইহাই আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য৷ তিনি আরও বলেছিলেন যে, ‘‘আমরা পূর্ণাঙ্গ স্বরাজ চাই, পূর্ণাঙ্গ স্বরাজ ভিন্ন অন্য আদর্শ স্বীকার করিয়া দেশবাসীকে মিথ্যা রাজনীতি ও দেশরক্ষার ভুল মার্গ প্রদর্শন করিতে প্রস্তুত নহি৷’’

অ্যাক্রয়েভ অরবিন্দ ঘোষ থেকে অরবিন্দ ঘোষ, তার থেকে বরোদার চাকুরীজীবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, এরপরে বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ–পরবর্ত্তীকালে আলিপুর জেল কক্ষে আধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ–ভারত আত্মার মুক্তির উপাসক–পরবর্ত্তীকালে যোগপুরুষ ঋষি অরবিন্দ৷

মাতৃবন্দনার স্রষ্টা বন্দেমাতরম্–এর রূপকার বঙ্কিমচন্দ্রকে অরবিন্দই ঋষি আখ্যা দিয়েছিলেন–অর্থাৎ যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা৷ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঋষি অরবিন্দ ছিলেন ‘স্বদেশ আত্মার বাণীমূর্তি’

আলিপুরে ঐতিহাসিক বোমার মামলায় আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে কৌঁসুলি দেশবন্ধু তাঁকে দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের প্রচারক ও মানবতা প্রেমিক বলে সম্বোধন করেছিলেন৷

১৫ই আগষ্ট দু’দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ৷ একদিকে এটি হ’ল স্বাধীনতা লাভের ঐতিহাসিক মুহূর্ত আর এক দিকে ঐতিহাসিক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্মক্ষণ৷

এই যুগসন্ধিক্ষণে বারবারই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় ঋষি অরবিন্দের অমর উক্তি –‘‘আমি জানি এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করিবার বল আমার গায়ে আছে, শারীরিক বল বা তরবারি বা বল্লম নিয়া আমি যুদ্ধ করিতে যাইতেছি না, জ্ঞানের বল৷ ক্ষাত্রতেজ একমাত্র তেজ নহে ব্রহ্মতেজও আছে, সেই তেজ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত৷’’

আলিপুর সেসন কোর্ট অরবিন্দ ঘোষকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক মামলা, আসামী পক্ষের ব্যারিষ্টার চিত্তরঞ্জন দাশ, সেদিন বিচারকের সামনে সওয়াল করতে সদর্পে বলেছিলেন–‘‘ধর্মাবতার, যখন সকল বাদানুবাদ থেমে যাবে, তখন স্তব্ধ হয়ে যাবে এই আন্দোলন ও কোলাহল, তারপরে যখন ইনি দেহত্যাগ করে পরলোকে চলে যাবেন, তারপরে বহুকাল পরে ভারতবর্ষের লোকে বলবে যে ইনি ছিলেন দেশপ্রেমের এক অমর কবি, জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত আর সমস্ত মানব জাতির নিঃস্বার্থ প্রেমিক৷ ইনি যখন এ জগতে থাকবেন না তখন পর্যন্ত এঁর বাণী কেবল ভারতের মধ্যেই নয়, এদেশ ছড়িয়ে দূর দূরান্তরে সাগর পারের সকল দেশে ব্যাপ্ত হয়ে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হবে৷ এই ব্যষ্টি আজ কেবলমাত্র এই আদালতের কাঠগড়াতেই বিচার চাইছেন না ইনি দাঁড়িয়েছেন ইতিহাসের মহা আদালতের কাঠগড়ার সামনে৷’’

জবানবন্দী নেওয়ার সময় সদর্পে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল–

‘‘আমি আমার দেশের স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করেছি৷ এ কাজ যদি আইন বিরুদ্ধ হয়, তাহলে আইন দোষী৷ এই স্বাধীনতার জন্যেই জীবনধারণ করেছি, শ্রম স্বীকার করেছি৷ এই স্বাধীনতাই আমার জাগরণের চিন্তা, নিদ্রার স্বপ্ণ৷’’ ১৯০৯ সালের ৬ই মে অরবিন্দ ঘোষ জেল থেকে মুক্তি পেলেন, মুক্তি পেয়ে দেখতে পেলেন দেশমাতৃকার বেদীতে আত্মদানের পথিকৃৎ ‘বন্দেমাতরম্’, ‘যুগান্তর’, ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাই নোতুনভাবে আত্মস্থ হয়ে নোতুন প্রেষণা নিয়ে ‘কর্মযোগিন’ নামে ইংরাজী ও ‘ধর্ম’ নামে বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করতে লাগলেন৷

১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারীমাসের শেষে ব্রিটিশ পুলিশকে চোখে ধূলো দিয়ে গঙ্গানদীতে নৌকায় করে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর চলে যান, এরপর ১৯১০ সালের ৪ঠা এপ্রিল কলকাতা হয়ে যাত্রা করেন এক সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে–আধ্যাত্মিক কর্ম ও সাধনা জগতে৷

মানব বিবর্ত্তনে ভারত আত্মার মুক্তির সন্ধানে–পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙলা তথা ভারতের মুক্তি সাধনে ঋষি অরবিন্দের অবদান এক বিরল দৃষ্টান্ত৷

এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর শ্রদ্ধাঞ্জলি আজও অবিস্মরণীয়৷

‘‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহো নমস্কার, হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ আত্মার

বাণীমূর্ত্তি তুমি৷ তোমা লাগি নহে মান, নহে ধন, নহে সুখ, কোনো ক্ষুদ্র দান

চাই নাই, কোন ক্ষুদ্র কৃপা ভিক্ষা লাগি, বাড়াওনি আতুর অঞ্জলি, আছ জাগি

পরিপূর্ণতার তরে সর্ব বাধাহীন–’’

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট–২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ও ক্ষমতার হস্তান্তরের দিন৷ অপরদিকে ১৮৭২ সালের ১৫ই আগষ্ট বাঙলার বুকে আবির্ভাব ঘটেছিল পরাধীনতার হাত থেকে ভারতের শৃঙ্খলমুক্তির অগ্ণিশিখা শ্রী অরবিন্দ ঘোষ৷