আজকের বিশ্বে শান্তি শান্তি বলে চোঁচানো একটা রীবাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু চেঁচিয়ে কোন কাজের কাজ হবে কি? যে কারণগুলো শান্তিকে বিঘ্নিত করে, সেই কারণগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় কোন পথ নেই৷ ব্যষ্টিগত জীবনে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই রয়েছে শুভবুদ্ধি ও অশুভবুদ্ধি বা বিদ্যা ও অবিদ্যার সংগ্রাম৷ কখনও বিদ্যা জেতে কখনও বা জেতে অবিদ্যা৷ সামাজিক জীবনেও এই বিদ্যা-অবিদ্যার সংগ্রাম চলেছে৷ অবিদ্যার বিরুদ্ধে বিদ্যাকে লড়তে হয়, আর সেই লড়াইয়ে যখন বা যতক্ষণ বিদ্যা জয়ী থাকে ততক্ষণই থাকে এক বিশেষ ধরণের শান্তি, যার নাম দিতে পারি সাত্ত্বিকী শান্তি৷ ঠিক তেমনি, এই লড়াইয়ে যখন বা যতক্ষণ অবিদ্যা জয়ী থাকে তখনও থাকে এক প্রকারের শান্তি, তাকে বলতে পারি তামসী শাস্তি৷ তাহলে দেখতে পাচ্ছি শান্তি জিনিসটা একটা আপেক্ষিক তত্ত্ব৷ পরমাশান্তি বা স্থায়ী শান্তি সামূহিক জীবনে আসতে পারে না৷ কারণ এই সৃষ্ট জগৎ যে সঞ্চর ও প্রতিসঞ্চর ক্রিয়ায় বিধৃত৷ সেই ক্রিয়া দুটির প্রথমটি অবিদ্যাপ্রধানা ও দ্বিতীয়টি বিদ্যাপ্রধানা৷ দুয়ের অস্তিত্বেই যখন জগতের অস্তিত্ব তখন বিশ্বে স্থায়ী শান্তির অর্থ (স্থায়ী তামসী বা স্থায়ী সাত্ত্বিকী যে শান্তিই হোক না কেন) বিদ্যা বা অবিদ্যা অথবা দুটিরই অক্রিয়তা৷ তাই বলতে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সমূহিক শান্তি এক সামগ্রিক প্রলয় ছাড়া আর কোন অবস্থায়ই আসতে পারে না৷ আর এই সামগ্রিক প্রলয়ের কল্পনা যুক্তিবিরোধী তবে ব্যষ্টিগত মানুষ সাধনার দ্বারা অবশ্য পরমাশান্তি লাভ করতে পারে, আর জাগতিক বিচারে সে অবস্থাকে বলতে পারি ব্যষ্টিজীবনের প্রলয়৷ সরকারী কর্মচারী যেখানে দৃঢ়চেতা, সমাজবিরোধী তামসিক ব্যষ্টিরা সেখানে মাথা নীচু করে থাকে৷ তখন দেশে থাকে একটা বিশেষ প্রকারের শান্তি, সেটাকে বলতে পারি সাত্ত্বিকী শান্তি৷ সরকারী কর্মচারীরা যেখানে দুর্বল দেশে তখন চলতে থাকে তামসিক ব্যষ্টিদের দাপট, সৎ ব্যষ্টিরা মাথা নীচু করে থাকে৷ সেটাও একটা শান্তির অবস্থা৷ সেটাকে বলতে পারি তামসী শান্তি৷ এই তামসী শান্তি নিশ্চয়ই কাম্য নয়৷ কোন এক বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ মানবগোষ্ঠী যদি সেই অঞ্চলের অথবা বহিঃস্থ কোন অঞ্চলের অন্য এক মানবগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার করে বা হামলা করে সেই অবস্থায় অন্যান্য মানুষেরা যদি নির্বাক হয়ে দেখতে থাকে অথবা আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া বা আপোষ রফার পথকেই যদি একমাত্র পন্থা বলে মনে করে, বুঝতে হবে তারা তামসী শান্তিকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে৷
কোন প্রতিবেশীর সঙ্গে যদি মৌখিক খুবই সদ্ভাব থাকে, কিন্তু যদি স্পষ্টই দেখা যায় যে সে তার স্ত্রীকে হত্যা করতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবেশীদের কী কর্তব্য? তারা কি সেটা একটা ঘরোয়া ব্যাপার বলে মুখ বুজে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে,ওই নারীর মৃত্যুর পথ সুগম করে দিয়েই তামসী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য দেবে? না, মানুষ-ধর্ম সেকথা বলে না, তাদের উচিত দরজা ভেঙ্গে তার গৃহে প্রবেশ করে ওই নারীকে রক্ষা করা ও অত্যাচারী পুরুষের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে সাত্ত্বিকী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা৷ কোন দেশ যদি তার সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যায় বা তার দুর্বল প্রতিবেশীদের উপর হামলা করে, অন্যান্য প্রতিবেশীদের উচিত প্রয়োজনবোধে অস্ত্রবলের সাহায্যে অত্যাচারকারীকে নিরস্ত করে সাত্ত্বিকী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে এগিয়ে আসা৷ এই সাত্ত্বিকী শান্তি যারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের শক্তির সাধনা করতে হবে৷ ছাগলের দ্বারা ব্যাঘ্রের সমাজে সাত্ত্বিকী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়৷ যাদের মতে অহিংসার অর্থ শক্তির অসম্প্রয়োগ, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তাদের দ্বারা সাত্ত্বিকী শান্তির প্রতিষ্ঠা বা অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা কোনটাই সম্ভব নয়৷ তাদের অহিংসায় ধাপ্পাবাজী থাকতে পারে৷ নিজেদের দুর্বলতা ঢাকবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও থাকতে পারে৷ কিন্তু তার দ্বারা সাত্ত্বিকী শান্তির প্রতিষ্ঠা হবে না ৷
আজকের সমস্যা বই থেকে