এই মুহূর্ত্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী তথা কলিকাতা মহানগরী থেকে বেশ কয়েকটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা বের হয়৷ তারপর সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক মিলে আরও বেশকিছু বাংলা ভাষায় ট্যাবলয়েডের সন্ধান পাওয়া যায় শহরের বুকস্টলগুলিতে৷ উক্ত ট্যাবলয়েডগুলি যে রাজ্যের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে তা তাঁদের ঘোষণা থেকেই পাঠক কুল জানতে পারেন৷ তাছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী সংস্থা আছে যারা মাসিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করে থাকে৷ কিন্তু আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যারা নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের নামে দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করছে৷ কারণ এই সকল সংবাদপত্রের পরিবেশিত বিষয়গুলির প্রতি একটু লক্ষ্য করলে অবশ্যই প্রশ্ণ আসে, নিরপেক্ষ ও নির্ভীক সংবাদ পরিবেশক হিসাবে এরা কি বিশ্বাসযোগ্য কেননা এদের পরিবেশিত বিষয়গুলিই প্রমাণ করে তারা যে ঘোষিত নীতির যথাযথ দায়বদ্ধতা পালন করছে না৷
প্রশ্ণ আসছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও প্রচার মিডিয়া তথা সংবাদপত্র গোষ্ঠীর ধর্মচ্যুতি ঘটল কেন অতীতের পরম্পরাকে তারা ধরে রাখতে গেল না কেন বিষয়টা আজকের প্রজন্মের জানার কথা নয়৷ অথচ অতীতে ‘‘যুগবাণী’’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা কলিকাতা শহর থেকে প্রকাশিত হত৷ গেট আপ বলে এই পত্রিকার কিছুই ছিল না৷ অতি সাধারণ নিউজপ্রিণ্টে ছাপা হত ‘যুগবাণী’৷ কিন্তু এই সাপ্তাহিকের গ্রাহক ছিল গোটা পূর্ব ভারত ব্যাপী৷ যাইহোক এই ছোট পত্রিকাটির ধার ভার ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এতটাই সত্যনিষ্ঠ থাকত যে, সরকার যেমন তেমনই বিরোধী রাজনৈতিকদেরও রীতিমত ভীত থাকতে হত৷ তৎকালীন সময়ে মাত্র চার আনার বিনিময়ে এই নির্ভীক পত্রিকাটি জনসাধারণ পড়তে পারতেন৷ সে সময় এ ধরনের নির্ভীক ও নিরপেক্ষ পত্রিকা শুধু বাংলা থেকেই প্রকাশিত হত তা নয়৷ দেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকেও ইংরেজী ভাষায় আর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হত৷ তার প্রচার ছিল গোটা ভারতব্যাপী৷ ওই সকল পত্রিকার সত্যনিষ্ঠ সংবাদ ও প্রবন্ধের বিশ্লেষণাত্মক লেখার ওপর জনসাধারণের বিশ্বাস ও আস্থা ছিল অপরিসীম৷ মোদ্দা কথা পাঠকরা জানতে পারতেন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে কোন পথে পরিচালনার চেষ্টা সরকার ও রাজনৈতিকরা করছেন৷
কিন্তু আজ দেশব্যাপী হাজার হাজার সংবাদপত্র প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে, অথচ ধার ও ভার কয়টির আছে প্রশ্ণ হচ্ছে কেন নেই বাম আমলে কোন এক দলের সুপ্রিম কম্যাণ্ড পত্রিকার সাংবাদিকদের ‘‘বরাহনন্দন’’ বলে প্রকাশ্য জনসভায় অবিহিত করলেও (বর্ধমানের কোন এক সভায় উক্ত মন্তব্য করা হয়েছিল) এর বিরুদ্ধে কোনও উপযুক্ত জবাব পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকরা আজ পর্যন্ত দেওয়ার সাহস দেখাননি৷ আজও নানাভাবে শাসকদলের হাতে, রাজনৈতিক দলের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হলেও সংবাদমাধ্যমগুলোর কোন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ দেখা যায় না৷ কেন সাংবাদিকরা প্রতিবাদী হতে পারেননি কারণ পত্রিকাগোষ্ঠী তাঁদের নীতিবোধ হারিয়ে পোষা প্রাণীতে পর্যবসিত৷ মানে আজকের সংবাদপত্র গোষ্ঠী কোন না কোন লবির পৃষ্ঠপোষক হয়ে সংবাদ পরিবেশনের ধার–ভার ও অতীতের পরম্পরাকে বিদায় দিয়ে টাকা কামাইয়ের মাধ্যম হিসাবে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করছেন বলেই এই পরিণতি ঘটছে৷ এমতাবস্থায় বরাহনন্দন কেন, আরও জঘন্য ভাষায় অপমান করলেও অপমানবোধ করার কারণ নেই৷
এখানে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা না বলে পারছিনা৷ তিনি তার মনের অন্তঃস্থলের গোপন কথাটি আমাকে জানালেন৷ জানিস পত্রিকার কর্তৃপক্ষ আমাকে কি বলেছেন আমার লেখা একটি প্রবন্ধও ছাপা হবে না৷ প্রশ্ণ করি কেন উত্তরে বন্ধুটি জানালেন–আমার মনে হতে লাগল রাজ্যের প্রকৃত আর্থিক অবস্থাটি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা একজন সাংবাদিকের একান্ত কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ তাই অনেক পরিশ্রম করে একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে আর্থিক পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা শেষে প্রশ্ণ রেখেছিলাম এই পরিণতির জন্যে মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় সরকার তো দায়ী নয়৷ কারণ আগের মার্কসবাদী সরকারের পোড়া মাটি নীতির (যা সামরিক বাহিনী পরাজিত রাষ্ট্রের বুকে নিয়ে থাকে)–র জন্যে রাজ্যটি বন্ধ্যা হয়ে গেছে৷ তার জন্যে কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার, ও রাজ্যের মার্কসবাদী সরকার সমান দায়ী৷
ব্যস, কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে বললেন, আপনার এই প্রবন্ধ প্রকাশ করা হবে না৷ কেন আমাদের নীতি তো জানেনই৷ তারপরও বলছি লেখাটা মমতা সরকারের পক্ষে হয়ে গেছে৷ অথচ আপনার পরিবেশিত বিষয়টা নিখাদ সত্য হলেও প্রবন্ধের বিশেষ বিশেষ প্যারাগ্রাফগুলি পাল্টে দিতে হবে৷ উত্তরে সাংবাদিক বললেন–এই তথ্য সমৃদ্ধ প্যারাগ্রাফগুলি তুলে দিলে প্রবন্ধের মহৎ উদ্দেশ্যই মার খেয়ে যাবে৷ উত্তরে কর্তৃপক্ষ জানালেন আমাদের সংস্থার নীতি অনুযায়ী আপনাকে বলা হ’ল, এক্ষণে ভাবনা–চিন্তা আপনার নিজস্ব৷
বস্তুত বলতে কী সংবাদপত্রের মত অতি দায়িত্বশীল গোষ্ঠীর এ ধরনের অবস্থানের ফলে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে৷ এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের স্তম্ভ বলে স্বীকৃত প্রচার মিডিয়া আসলে দেশের সংবাদ পরিবেশনের নামে লবিবাজিকেই পত্রিকার ধর্ম বলে বিবেচনা করে৷ তাই দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ব্যাভিচার, অত্যাচার, নির্যাতন, আর্থিক দুর্নীতির প্রকৃত সত্য জনসধারণের চোখে ধরা পড়ার কোন সুযোগ আজ আর নেই৷ পরিবর্তে প্রচার মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী যা জানতে পারেন তা আসলে সরকার, পুলিশ, আদালত ও বিভিন্ন স্বশাসিত সংস্থার দেওয়া তথ্য নিয়েই বানানো একটা ককটেল মাত্র৷ তা দিয়েই সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা পূর্ণ করা হয়৷ এর ভেতর প্রচার মিডিয়ার নিজস্বতা বলতে কোনও অবদান নেই৷ এখানেই পশ্চিমের উন্নত ও স্বাধীন দেশের প্রচার মিডিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের প্রচার মিডিয়ার পার্থক্য ধরা পড়ে৷ কারণ, ও দেশের সরকার ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ত্রুটি–বিচূ্যতি খুঁজে বের করতে জান লড়িয়ে দেয় প্রতিটি প্রত্রিকা গোষ্ঠী৷ তারই পরিণাম ফল হচ্ছে সে দেশের সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিকরা প্রচার মিডিয়ার মুল্যায়নকে সম্মান ও গুরুত্ব দিতে বাধ্য থাকেন৷ আর আমাদের দেশের অবস্থান হচ্ছে এই যে, মন্ত্রী বাহাদুর জনসভায় নাম ধরে ধরে পত্রিকা গোষ্ঠীর পিণ্ডি দান করেন৷ সঙ্গে এও জানাতে ভুল করেন না ওদের মিথ্যা প্রচার জনসাধারণ বুঝে গেছেন৷ সুতরাং ওরা যা পারে করে নিক৷ অথচ পশ্চিমের কোনও গণতান্ত্রিক দেশের কোন নেতা বা দলের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য রাখার সাহস নেই কোনও প্রচার মিডিয়ার বিরুদ্ধে৷ আর প্রচার মিডিয়াও কোন নেতা বা দলকে অহেতুক অপমান অপদস্থ করার জন্যে মিথ্যাচারের পথে কোনদিনই এগোয় না৷
কিছুদিন আগে এক সেমিনারে খ্যাতনামা এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছিলেন আজকে ভারতের প্রচার মিডিয়াগুলির পাঁচ শতাংশ যদি জনস্বার্থে কাজ করত তাহলে দেশের এতটা দৈন্যদশা হত না৷ অথচ পশ্চিমের শিক্ষিত দেশগুলির প্রচার মিডিয়া জনস্বার্থে দায়বদ্ধতার সাক্ষ্য রাখতে যেভাবে লড়াই চালায় তার ছিটেফোঁটাও এদেশে দেখা যায় না৷ ও দেশের প্রচার মিডিয়ার কার্যক্রমের সঙ্গে আমাদের দেশের মিডিয়ার কোনরকম তুলনাই চলে না৷ তাই এদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দল থেকেও নেই৷ কারণ কেন্দ্রে ওরা শাসন ক্ষমতায় না থাকলেও বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রের বিরোধীরা ক্ষমতাসীন৷ অথচ দুইয়ের মধ্যে জনসধারণের সম্পদ চুরি, জোচ্চুারি ও প্রতারণায় কোথাও পার্থক্য নেই দু–একজন ব্যতিক্রম ছাড়া৷ অর্থাৎ যে দল যেখানে ক্ষমতাসীন সেখানেই অবাধ লুঠতরাজ চালানো হচ্ছে৷ বলা চলে দেশের রাজনৈতিকরা অবাধ লুণ্ঠনের জন্যে একটি সামাজিক অবক্ষয়ের মুখে দেশের সংবাদমাধ্যম বা প্রচার মিডিয়া গুরু দায়িত্ব নিতে পারত৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বীয় ভূমিকায় সংবাদ মাধ্যমের উপস্থিতি দালালেরও অধম৷ এই অবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষে, সমাজের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক৷ অথচ ইতিহাস বলছে, বিরোধী শূন্য দেশে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেই দেখা যায়, সংবাদপত্রই বিরোধিতার ভূমিকা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে৷ অথচ এদেশে তা সম্ভব নয়৷ কারণটিও পরিষ্কার৷ চরিত্রহীন, দুর্নীতিগ্রস্তের দ্বারা কোনও মহৎ কাজ করা সম্ভব হয় না৷
- Log in to post comments