আর ক’দিন পরেই ২১শে ফেব্রুয়ারী৷ ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’! না, আমরা ভুলতে পারি না৷ ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস৷ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দের মতো৷ মাতৃভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা৷ আমরা ভুলতে পারি না, ১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে ডাকার (ঢাকা) রাজপথে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্যে ৫জন শহীদ হয়েছিলেন ও ১৭জন আহত হয়েছিলেন৷ এরপর ১৯৬১ সালের ১৯শে মে তেও অসমের শিলচরে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন৷
বাংলাদেশের মাতৃভাষার স্বাধিকারের দাবী নিয়ে আন্দোলন সমগ্র বাঙালী জাতির হৃদয়ে যে আবেগ সৃষ্টি করেছিল, সেই আবেগই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেয় ও শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের অক্টোপাসীয় শোষণের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়৷
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন যেভাবে ওপার বাংলার গোটা বাঙালী জাতির জাগরণ ঘটিয়েছিল ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুত্থান ঘটিয়েছিল তাতে বিস্মিত হয়ে রাষ্ট্রসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে৷ পরের বছর ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী এই দিনটিকে মর্যাদা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আপন আপন ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে৷ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর বিচারে স্প্যানিশ, চীনা ও ইংরেজীর ভাষার পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশী ভাষায় কথা বলা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে মধুরতম ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়৷
এইভাবে বাংলা ভাষা সারা বিশ্বে বিশেষ গৌরবময় উচ্চাসন লাভ করা সত্ত্বেও এখনও ভারতবর্ষে বাংলাভাষীদের অবস্থা দুয়োরাণীর মতো৷ রাজনীতির ঘূর্র্ণবর্তে পড়ে ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খণ্ড. এমনকি খোদ পশ্চিমবঙ্গেও বাংলাভাষা ক্রমাগত তার গৌরবময় মর্যাদা হারিয়ে চলেছে৷
রাজনীতির কুটিল চক্রান্তে স্বভূমিতে বাস করেও লক্ষ লক্ষ বাঙালী মাতৃভাষা শিক্ষা, মাতৃভাষা চর্র্চ, মাতৃভাষায় কাজকর্ম করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ যেমন ঝাড়খণ্ডের অধিকাংশইটাই বাঙালী অধুষ্যিত এলাকা, এখানে প্রায় ৬৫ শতাংশ বাঙালীর বাস৷ তবুও এখানে স্কুল-কলেজে মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগ নেই, সরকারী ও বেসরকারী অধিকাংশ কাজে বাংলা ভাষায় কাজকর্ম করারও অধিকার নেই৷ অসমের লক্ষ লক্ষ বাঙালীদেরও একই অবস্থা, এমনকি এখানে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে স্বভূমিতেই বিদেশী হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হওয়ার যন্ত্রণার শিকার হতে হচ্ছে৷ এমনি ভাবে বাঙলার নিজস্ব এলাকাকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলে বাঙালী আজ নিজভূমি পরবাসী, মাতৃভাষা-মাতৃদুগ্দ থেকে বঞ্চিত৷
ভারতে ‘বাঙালীস্তানে’র অর্থাৎ বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমির একটি ক্ষুদ্র ভগ্ণাংশ পশ্চিম বাংলা নামে চিহ্ণিত--- যেখানে ‘বাঙলা’র নিজস্ব পরিচিতিটুকু বহন করার আইনতঃ অধিকার রয়েছে৷ অথচ এই পশ্চিম বাংলায়ও এখনও পর্যন্ত সমস্ত সরকারী কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয়নি৷ কেবল মাঝে মাঝে মন্ত্রিসভায় এই সদিচ্ছার কথা শুণিয়ে সবাইকে আশ্বাসবাণীটুকু দেওয়া হয়৷ এখনও বিভিন্ন সরকারী নির্দেশও ইংরেজী বা হিন্দীতেই করা হয়৷ রেলে, ডাকব্যবস্থা প্রভৃতিতেও এখনও পর্যন্ত বাংলার দেখা মেলে না৷ অথচ পাশেই ওপার বাংলায় দেখেছি, স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা হবার কয়েকমাসের মধ্যেই সমস্ত কাজকর্ম অবশেষে বাংলাতে হওয়া শুরু হয়ে গেল৷ অর্থাৎ সদিচ্ছা থাকলে ---সৎ সংকল্প থাকলে সবকিছুই যে করা যায়--- তা বুঝতে আমাদের কোনও অসুবিধা হ’লনা৷
হয়তো কোনো কোনো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ প্রশ্ণ করতে পারেন বাংলায় কথা না বলে ইংরেজীতে বা হিন্দিতে কথা বললে অসুবিধা কোথায়? রুজি রোজগারের অসুবিধা না হলে হ’ল৷ তাহলে ‘মাতৃভাষা’---‘মাতৃভাষা’ বলে চিৎকারের কী দরকার৷ ‘মাতৃভাষায় মানুষ যত সহজে সাবলীলভাবে ও স্বচ্ছন্দে ভাবপ্রকাশ করতে পারে, অন্য কোনো ভাষায় সে তা পারে না৷ প্রতিমূহূর্তে কোনো জনগোষ্ঠীকে অন্য ভাষায় ভাবপ্রকাশ করতে বাধ্য করা হলে, সব সময় তারা অস্বচ্ছন্দ বোধ করে, ফলে তাদের প্রাণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এ অবস্থায় তাদের মধ্যে জাগে হীনম্মন্যতাবোধ৷ এইভাবে বিভিন্ন কাজকর্ম মাতৃভাষায় করার সুযোগ না থাকলেও একইভাবে তাদের ক্রমাগত অধিক থেকে অধিক হীনম্মন্যতাবোধের শিকার হতে হয়৷ এই হীনম্ম্যতাবোধ ওই জনগোষ্ঠীর মনকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়৷
তারা তাদের নৈতিক উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলতে থাকে৷ পরিণামে তাদের মধ্যে পরাজিতের মনোভাবও দেখা দেয়৷ এইভাবে একটা জনগোষ্ঠী তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে অপরের দাস হয়ে যায়৷ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না৷
এইভাবে ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত জনগোষ্ঠী দুর্বলচিত্ত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক ভাবে অন্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত হতে থাকে৷ একেই বলা হয় সাইকো-ইকনমিক এক্সপ্লয়টেশন (মানস-অর্থনৈতিক শোষণ)৷ এমনি করে সর্বাত্মক শোষণে পিষ্ট হয়ে জাতিগত ভাবে ওই জনগোষ্ঠীর মৃত্যু হয়৷
প্রাউট -প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার মাতৃভাষার অবদমনের ফলে কীভাবে একটা জনগোষ্ঠীর চরম ক্ষতি হয় তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন ও তাই মাতৃভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে সামিল করেছেন৷
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারী ---মাতৃভাষা দিবসে আসুন শপথ গ্রহণ করি, সমস্ত বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা--- বাঙালীস্তানে বাংলাভাষাকে--- আমাদের মাতৃভাষাকে গৌরবময় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করি৷ সরকারী ও বেসরকারী সমস্ত কাজকর্ম বাংলা ভাষায় করার দাবীতে আমরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলি৷ আসুন ‘প্রভাত সঙ্গীতে’র ভাষাতে গাই --- বাংলা আমার দেশ, বাংলাকে ভালবাসি বাংলার দুখে কাঁদি,বাংলার সুখে হাসি’’৷
- Log in to post comments