স্বাধীনতার প্রাপ্তি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আর একটা ১৫ই আগষ্ট এসে গেল৷ স্বাধীনতার পর ৭৭ বছর অতিক্রান্ত৷ ৭৭ বছরে দেশবাসী কি পেল৷ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে দেশের সিংহভাগ সম্পদের মালিক মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনকুবের৷ শুধু সম্পদের মালিক নয়, সমস্ত আর্থিক ব্যবস্থাটাই কয়েকজন পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণে৷ শাসকের প্রাপ্তি কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতা৷ তা নিয়েই এক একজন হোমড়া-চোমড়া তালেবর! জনগণের বরাতে শুধু ভুয়ো প্রতিশ্রুতি আর অর্থনীতির তত্ত্ব কথার কচকচানি৷ দেশ এগিয়ে চলেছে. এক নম্বর নয়, দু’নম্বর নয় একেবারে তিন নম্বরে আর্থিক বিকাশের দেশ হিসেবে৷

কিসের আর্থিক বিকাশ! জিডিপি বাড়ছে! মাথাপিছু আয় বাড়ছে! নীচের তলায় পড়ে থাকা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এই আর্থিক বিকাশের কোন সম্পর্ক নেই৷ তারা জিডিপি বোঝেই না৷ মাথাপিছু আয় আর্থিক বৈষম্য আড়াল করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা৷ ধনকুবেরদের কথা ছাড়ুন --- এক শ্রেণীর উচ্চ বেতন ভোগী চাকুরী জীবির সঙ্গে দিন মজুরীর আয়ের গড়৷

ক্ষমতার মোহে, ধর্মান্ধতাকে হাতিয়ার করে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করে যে স্বাধীনতা---তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কতটুকু! এ স্বাধীনতায় তারা কি পেল, কি পেল না, ৭৭ বছর ধরে শাসক বিরোধী কোনদলই কোন হিসেব নেয়নি৷ তাইতো স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও সীমাহীন আর্থিক বৈষম্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা, দারিদ্র কুরে কুরে খাচ্ছে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে৷

অপরদিকে দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে মুষ্টিমেয় কয়েক জন ধনকুবের৷ সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে ধনকুবেরের ছেলের বিয়েতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচের খবর৷ কিন্তু ক’জন খবর রাখে এই দেশে লক্ষ লক্ষ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার দুরাবস্থার৷

৭৭ বছরের স্বাধীনতায় জনগণের আংশিক বোটাধিকার আর নির্বাচনের প্রাক্কালে জনদরদী (!) নেতাদের মুখ দর্শন, আর মুখ নিঃসৃত অমৃতবাণী! জনগণের ভাঁড়ারে স্বাধীনতার প্রাপ্তি এতটুকুই৷ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে সুস্থ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজন---অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সুব্যবস্থা৷ দেশের সাধারণ মানুষের এক বৃহত্তম অংশের কাছে আজও এগুলি অপ্রাপ্তির তালিকায়৷ অনেকের কাছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ এদের কাছে স্বাধীনতার মূল্য কতটুকু! স্বাধীনতার অমৃত আজও এদের কাছে তিক্ত কটু, হয়তো বা গরলও!

দেশের শাসকগোষ্ঠী যতদিন পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি হয়ে দেশ শাসন করবে ততদিন স্বাধীনতার অমৃতের স্বাদ সাধারণ মানুষের রসনায় অধরাই থাকবে৷ যেমন গণতন্ত্রের মোড়কে যে স্বাধীন সরকার স্বাধীন দেশের সেও তো সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ যদিও গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার৷

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া স্বার্থক স্বাধীন রাষ্ট্রগড়ে উঠতে পারে না৷ কংগ্রেস সভাপতি হয়ে ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র সেই কথাই বলেছিলেন৷ কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনীতির লাগাম ধরে আছে সেদিন থেকেই দেশীয় পুঁজিপতিরা৷ তাইতো সুভাষচন্দ্রকে হারিয়ে যেতে হয়েছে৷ স্বাধীনতার ৭৭বছর পরেও আর্থিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে আছে ওই দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতেই৷

৭৭ বছরের স্বাধীন দেশে জনগণের ভাঁড়ারে শুধুই অপ্রাপ্তি৷ জনগণের প্রাপ্তির ভাঁড়ার সেদিনই ভরে উঠবে যেদিন প্রাউটের পথে আর্থিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে৷ প্রাউটের দৃষ্টিতে---অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের হাতে আর্থিক ক্ষমতা তুলে দিতে হবে৷ জীবন ধারণের নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্য ক্রয় করার ক্ষমতা দিতে হবে৷ মানুষের হাতে থাকবে আর্থিক ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষমতা৷ সার্বিকভাবে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় মানুষের হাতে থাকবে৷ তবেই সাধারণ মানুষের প্রাপ্তির ভাঁড়ার ভরে উঠবে স্বাধীনতার অমৃতে৷

আজ আর শুধু আর্থিক ক্ষমতা নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি ক্রীড়া জগতেও পৌঁছে গেছে শোষকের কালো হাত৷ রাজনৈতিক দলের ব’কলমে রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করে রেখেছে ধনকুবেররাই৷ গোটা দেশ নয়, স্বাধীনতার বেদীতে সব থেকে বেশী যারা রক্ত দিল সেই বাঙলার জনগোষ্ঠী! আজ তাদের মাথা এন.আর.সির হাঁড়ি কাঠে, মাথার উপর উদ্যত খড়্গ---স্বাধীনতার প্রাপ্তি৷