লক্ষণ ঃ শ্বিত্র রোগটি কুষ্ঠের অন্তর্ভুক্ত হলেও জীবনীশক্তির পক্ষে ততটা ঘাতক নয় ও রসস্রাবী নয় বলে সংক্রামকও নয়৷ সপ্ত ধাতুর বিকৃতির ফলে যে কুষ্ঠ সৃষ্ট হয় তা’ মানুষের শরীর ও মনে অল্প কালের মধ্যেই মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু এই শ্বেত কুষ্ঠ বা শ্বিত্রে সাধারণতঃ রক্ত, মাংস ও মেদ কেবলমাত্র এই তিনটি ধাতুই বিকৃতিপ্রাপ্ত হয়৷
শরীরের বিভিন্ন স্থানে–বক্ষে, মুখে ও পায়ের গোড়ালিতে ও দেহের শেষাংশে অর্থাৎ ঠোঁটে, আঙুলে প্রথমে লালচে রঙের দাগ দেখা দেয় ও দেখে মনে হয় ওই সকল স্থানের চামড়া যেন কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে৷ পরে ওই লাল দাগগুলি ধীরে ধীরে শাদা হয়ে যায়৷ আগেই বলেছি, রোগটি ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অংশে সৃষ্ট ওই শাদা দাগগুলি এমনই একটি ভীষণতা সৃষ্টি করে যে রোগীকে দেখে লোকে ভয় পায়–রোগীকে পাপী বা অপরাধী বলে ঘৃণার চক্ষে দেখে৷
কারণ ঃ রক্তদুষ্টিই এই ব্যাধির মূল কারণ৷ রক্তে অম্লদোষ অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে যেখানে চামড়া অল্প সময়ের মধ্যে অধিক দুর্বল হয়ে পড়ে সেখানেই এই রোগটি ফুটে ওঠে৷ সাধারণতঃ দেখা যায় যে রোগীর যদি কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে অথবা কোন ধারক ঔষধের সাহায্যে আমাশয় রোগের বিষ দেহের মধ্যেই নিবদ্ধ করে দেওয়া হয়, সেই সকল ক্ষেত্রেই রোগী পূর্বতন রোগের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ তাই ইতোপূর্বে আমাশয় রোগ প্রসঙ্গে সূচিকা প্রয়োগে আমাশয় বন্ধ করবার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছি৷
চিকিৎসা ঃ
প্রত্যুষে ঃ উৎক্ষেপমুদ্রা, কর্মাসন, উড্ডয়ন, অগ্ণিসার, দীর্ঘপ্রণাম,, যোগমুদ্রা, ভুজঙ্গাসন, আগ্ণেয়ী মুদ্রা বা আগ্ণেয়ী প্রাণায়াম৷
সন্ধ্যায় ঃ সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যমুদ্রা, নৌকাসন, পশ্চিমোত্তানাসান, উড্ডয়ন, অগ্ণসার, মৎস্যেন্দ্রাসন৷
আসনাদি অভ্যাসের পর দু’বেলাই শীতলী কুম্ভক করে রোগগ্রস্ত স্থানগুলি ভালভাবে মর্দন করে নিতে হবে৷
পথ্য ঃ যে সকল খাদ্য গ্রহণ করার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ দেখা দিতে পারে সেগুলি কঠোরভাবে বর্জন করে চলতে হবে, যে সকল খাদ্য পিত্ত বৃদ্ধি করে সেগুলিও বর্জন করতে হবে৷ মাছ, মাংস, ডিম, ঘি, অধিক পরিমাণে মশলা প্রভৃতি বস্তু যকৃৎকে দুর্বল করে দেয় ও তার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ সৃষ্ট হয় যা শ্বিত্র রোগের অন্যতম করণ৷ এই ব্যাধিতে মৎস্য ও অন্যান্য আমিষ খাদ্য অত্যন্ত কুপথ্য৷ তাই সেগুলি বিষবৎ পরিতাজ্য৷ যে যত বেশী আমিষ লোভীই হোক না কেন তাকে সে লোভ সংবরণ করতেই হবে৷
রোগীর পক্ষে হেলেঞ্চা (হিংচা), গিমা, আমরুল, ব্রাহ্মী প্রভৃতি শাক অত্যন্ত হিতকর৷
বিধি–নিষেধ ঃ রোগটি আমাশয়েরই স্বগোত্র৷ তাই এতে মোটামুটি বিচারে আমাশয়েরই বিধি–নিষেধ মেনে চলা উতি৷ রোগীর পক্ষে একটু একটু করে দিনে অনেক বার জল পান বিধেয় ও সমস্ত দিনে অন্ততঃ সাড়ে চার সের জল পান করা উচিত৷ রোগীর পক্ষে টক–মিষ্ট ফলের রস অত্যন্ত সুপথ্য৷ একাদশী, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় উপবাস বিধিও মেনে চলা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়৷ শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে নির্দিষ্ট সময়ে একটানা ১৫/২০ মিনিট আতপস্নান করে সর্বাঙ্গ ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছে নিতে হবে, আর এই ভাবে কয়েকবার আতপস্নান করে শেষের বারে আর তোয়ালে দিয়ে গা না মুছে রোগগ্রস্ত জায়গা জলপাই তৈল, অভাবে মহুয়ার তৈল দিয়ে মর্দন করে নিতে হবে৷ মনে রাখা দরকার, সূর্যলালোক চর্মের সুস্থতা রক্ষার পক্ষে অত্যাবশ্যক ও এই জন্যে চর্মের দুর্বলতা–সঞ্জাত সর্বপ্রকার ব্যধিতেই আতপস্নান (রোদ লাগানো) অত্যন্ত হিতকর৷ ধৈর্যের সঙ্গে উল্লিখিত পদ্ধতিতে আসন ও বিধিব্যবস্থাগুলি মেনে চললে এই রোগে আরোগ্য লাভ করা মোটেই অসম্ভব নয়৷ যেহেতু এই রোগে তিনটি ধাতু বিকৃত হয় সেজন্যে রোগীর পক্ষে আহারে ব্যবহরে যথেষ্ট সংযম মেনে চলা দরকার৷ দিবানিদ্রা, রাত্রিজাগরণ, স্ত্রীসঙ্গ ও অতিভোজন বর্জন করা বাঞ্ছনীয়৷
কয়েকটি ব্যবস্থা ঃ
১) ছাগদুগ্ধের সঙ্গে আমড়ার ছালের রস মিশিয়ে প্রত্যহ প্রত্যুষে পান করলে,
অথবা
২) আমরুল শাকের রস চীনী সহ,
অথবা
৩) পাকা কলা ঘিয়ে ভেজে এক চামচ পরিমাণ দুগ্ধক্ষীরা রসে মিশিয়ে প্রত্যহ সকালে খেলে এই রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়৷
৪) বুচকিদানা জলে বেটে রোগগ্রস্ত স্থানে প্রলেপ দিলে,
অথবা
৫) কালকেসেন্দার রসে গোরুর হাড় ঘষে রোগগ্রস্ত স্থানে প্রলেপ দিলে সুন্দর ফল পাওয়া যায়৷
৬) এক আনা পরিমাণ শ্বেতজয়ন্তীর মূল গোদুগ্ধ সহ বেটে রবিবরা দিন পান করলেও এই রোগ অত্যল্পকালের মধ্যেই বিদূরিত হয়৷
(‘‘যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ’’ –শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)