কেরালার শবরীমালায় অবস্থিত আয়াপ্পার মন্দিরে ৯ থেকে ৫০ বছর বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না৷ সম্প্রতি এই সম্পর্কিত এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সবার প্রবেশাধিকারের রায় ঘোষণা করেছেন৷ এ ব্যাপারে মহিলা-পুরুষের কোনো বিভেদ করা চলবে না বলে সুস্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন৷ কিন্তু এরপরও মন্দির কর্তৃপক্ষ ও তাদের গোঁড়া একশ্রেণীর ভক্ত মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না৷ পুলিশও নিষ্ক্রিয়৷ বর্তমানে এটাকে কেন্দ্র করে জোর রাজনীতি চলছে৷ বি.জে.পি ও কংগ্রেস দুই পার্টিই মন্দির কর্তৃপক্ষ তথা গোঁড়া ভক্তদের সমর্থন করছে৷ তাঁরা এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছেন৷ তাঁদের বক্তব্য, এটা এখানকার পরম্পরা৷ এই চিরাচরিত প্রথাকে রক্ষা করতে তাঁরা বদ্ধ পরিকর৷ স্বাভাবিকভাবে বিশেষ করে বিজেপি ও আর. এস. এস-এর লোকেরা হিন্দুত্ব রক্ষার নামে মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশে গোঁড়া আয়াপ্পা ভক্তদের সঙ্গে অবরোধ সৃষ্টি করেছে৷ তারফলে কোনওভাবে ৯ থেকে ৫০ বছর বয়সের মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তাঁদের যুক্তি, এই বয়সে মহিলারা ঋতুমতী হওয়ার জন্যে তারা মন্দিরে প্রবেশ করলে মন্দির নাকি অপবিত্র হয়ে যাবে৷
এ যুক্তি যে অসার, এসব যে যুক্তিহীন কুসংস্কার বা ডগ্মা এ বিষয়ে কোনোমাত্র সন্দেহ নেই৷ অন্যান্য কোনো মন্দিরের ক্ষেত্রেও এধরণের নিয়ম নেই৷ পুরোনো প্রথা--- এই অজুহাতে কুসংস্কার হলেও তাকে ঐতিহ্য রক্ষার নামে মেনে চলতে হবে, এটা কোনো যুক্তিই নয়৷ তাহলে তো সতীদাহ প্রথা রদ করে রামমোহন অন্যায় করেছেন বলতে হয়, বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন করে বা নারী শিক্ষাকে সমর্থন করে বিদ্যাসাগর মহাশয়রা অন্যায় করেছেন বলতে হয়, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্যে যারা আন্দোলন করেছেন, তাঁরও অন্যায় করেছেন বলতে হয়৷
পুরানো কুসংস্কার বহুদিন ধরে তো চলতে থাকেই৷ পরম্পরা বলে কুসংস্কারকে যারা সমর্থন করেন তারা ডগ্মা বা ভাবজড়তার সমর্থক৷ এই সব ডগ্মাপন্থীরা সমাজের প্রগতিকে সবসময় বাধা দেন, প্রগতিশীল চিন্তাধারার তাঁরা বিপক্ষে৷ তাঁর পেছনে মূল কারণ হ’ল ক্ষুদ্র স্বার্থ৷ এ ব্যাপারে গোঁড়া পুরোহিত কুলের সমর্থন থাকে--- তাদের শোষণ ব্যবস্থা অটুট রাখার জন্যে৷ এখানে বিজেপি ও কংগ্রেস দলের বড় স্বার্থ আছে তা বুঝতে কারোর অসুবিধা হয় না৷ আগামী নির্বাচনে কেরালার ওইসব ডগ্মা বা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভক্তকুলের সমর্থন লাভের জন্যেই ওঁরা আসলে এই কুসংস্কার তথা ডগ্মাকে জোরালো সমর্থন জানাচ্ছেন৷
বস্তুতঃ প্রচলিত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখতে যুক্তিহীন জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা সহ নানান্ অন্যায় মানবিক ও অযৌক্তিক ডগ্মাকে সমর্থন করে চলে৷ এইভাবে তারা সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়৷
প্রাউট-প্রবক্তা সর্বক্ষেত্রে ডগ্মার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন৷ ডগ্মা হ’ল যা মানুষের মনকে একটা গণ্ডীর মধ্যে আটকে রাখতে চায়৷ এটা মানতে হবে, এটা বিশ্বাস করতে হবে, এব্যাপারে কোনো যুক্তি চলবে না৷ বর্তমানে বিভিন্ন রিলিজিয়নে এমনি অজস্র ডগমার ভিড়৷ যেখানে ডগ্মা, বুঝতে হবে সেখানে আছে একশ্রেণীর শোষণ৷ মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ যে বুদ্ধিবৃত্তি--- যে যুক্তি তাকে শৃঙ্খলিত করে রাখতে চায় ডগ্মা৷
ডগ্মা কেমন? একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে৷ জমিদারবাবু মারা গেছেন৷ তারজন্যে শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে৷ শ্রাদ্ধের জন্যে চাল, ফল-মূল সাজানো হয়েছে৷ এমন সময় বাড়ীর বিড়ালটা এসে ওর ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে ওইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল৷ তখন সবাই বিব্রত হয়ে বিড়ালটাকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে আবার নূতন করে চাল-ডাল-ফল-মূলের নৈবেদ্য সাজানো হ’ল৷ পরের বছর বাৎসরিক শ্রাদ্ধের সময় আগের বছরের কথা মনে ছিল, তাই আগে থেকে বিড়ালটাকে বেঁধে রাখা হয় ও বাৎসরিক শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়৷ এইভাবে প্রতিবছর করা হতে থাকল৷ ধীরে ধীরে এটা প্রথা হয়ে গেল---শ্রাদ্ধের আগে বিড়াল বেঁধে রাখা৷ অনেক পরের কথা, একবার এইভাবে বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় এক মহিলা বললেন, তোমরা ভুল করেছ, জমিদার বাড়ীর প্রথা,বিড়াল বেঁধে শ্রাদ্ধের আয়োজন করা৷ কোথায় বিড়াল তো বাঁধা হয় নি৷ কিন্তু বাড়ীতে তো কোনো বিড়াল নেই৷ তখন অন্যবাড়ী থেকে একটা বিড়াল এনে তাকে বেঁধে রেখে শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হ’ল৷
কেউ ভেবে দেখলেন না, বিড়াল বাঁধার কী প্রয়োজন৷ কেবল এটা একটা প্রথা--- ব্যস এই যুক্তিকেই সমর্থন জানানো হ’ল৷ এইভাবে নানান্ কুসংস্কার বা ডগ্মা বাসা বাঁধে৷ আর এই ডগ্মার আড়ালে মানুষের ভাবজড়তার সুযোগ নিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়৷
ডগ্মা যে কেবল রিলিজনের ক্ষেত্রেই হয় তা নয়,ডগ্মা সব ক্ষেত্রেই হতে পারে৷ যেমন বর্তমানে বাস্তব বিচারে মার্কসবাদের ব্যর্থতা তথা অযৌক্তিকতার পরিপ্রেক্ষিতেও অনেককে শ্লোগান দিতে শোনা যায় ‘মার্কসবাদ সত্য তা কখনোই মিথ্যা হতে পারে না’৷
সবক্ষেত্রে পুরোনো প্রথা বা বিশ্বাসের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে চলবে না৷ যুক্তির কষ্টিপাথরে সব কিছুকে যাচাই করে যা গ্রহণযোগ্য--- তাকে গ্রহণ করতে হবে, যা বর্জনযোগ্য তাকে বর্জন করতে হবে৷ মনের এই প্রগতিশীল চিন্তাধারা চাই৷ প্রাউট-প্রবক্তা তাই বলেছেন---‘বুদ্ধির মুক্তি চাই’৷ পুরাতনের জীর্ণ সংস্কারকে ত্যাগ করে সর্বক্ষেত্রে যা যুক্তিপূর্ণ তাকেই বরণ করে নিতে হবে৷ তা কি ধর্মের ক্ষেত্রে, কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কি সমাজিক ক্ষেত্রে৷ তবেই সর্বক্ষেত্রে প্রগতি সম্ভব৷
- Log in to post comments