৭ই জুলাই, ১৯৩১সাল৷ শেষ রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে৷ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বন্দিরা কেমন নিস্তব্ধ, নীরব৷ ম্লান মুখগুলো অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভারাক্রান্ত৷ আর কিছুক্ষণ পরেই চিরদিনের মত চলে যাবে তাঁদের সহবন্দি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত৷ পরাধীন দেশের বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিচারে তাঁর ফাঁসি৷ পরাধীন দেশের নাগরিকদের বিদেশি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খোলা নিষেধ৷ আর উনি মুখ খোলেননি, মহাকরণের অভ্যন্তরে গিয়ে বিদেশি শাসকের কোমর ভেঙে দিয়ে এসেছে৷ এইরকম বিপদজনক ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখাও বিপদ৷ তাই বিচারের প্রহসনে ফাঁসির দন্ডই বরাদ্দ হয়েছে তার জন্য৷
সহবন্দীদের মুখ গুলো বেদনায় মলিন হলেও দীনেশ কিন্তু হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল৷ মৃত্যুর বিভীষিকা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ জীবন মৃত্যু তাঁর কাছে পায়ের ভৃত্য৷ এ কোন কল্পনা নয়, ফাঁসির আদেশের পর জেলখানায় বসে তিনি যে পত্র গুলো লিখেছেন এগুলো পাঠ করে স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন এসো শুধু চিঠি নয়, এক জীবন দর্শন৷ সত্যিই তাই, এতোটুকু একটা ছেলে জীবনকে যে এইভাবে দেখতে পারে তা কল্পনার অতীত৷ ৭ই জুলাই প্রণম্য বিপ্লবী শহীদ দীনেশ গুপ্তকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তার একটি পত্র প্রকাশ করা হলো এখানে ---
আলিপুরে সেন্ট্রাল জেল তাং ৩.১.৩১
মণিদি,
ভগবানের আশীষ যারা পায় অশেষ দুঃখ জোটে তাদেরই কপালে৷ সে দুঃখের মালা গলায় পরবার সৌভাগ্য ও শক্তি ক’জনের হয় জানি না, তবে যার হয়, তার জীবন পরম স্বার্থকতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে৷
ভগবান যাকে আসল কাজের জন্য বেছে নেন, তার সুখে-সম্পদ সব কিছু দেন ধূলোয় লাটিয়ে, করেন তাকে পথের ভিখারী, রিক্ত, কাঙাল৷ সে মালা কি সহজ?
এ তো মালা নয় গো,
এ যে তোমার তরবারী
জলে ওঠে আগুন যেন
বজ্রসম ভারি
এ তো তোমার তরবারী৷’
এ জীবনে সুখ পাওয়া বড় কথা হতে পারে, কিন্তু দঃখ পাওয়া তার চেয়েও বড়৷ সখ ভোগ করতে পারে সকলেই, কিন্তু স্বেচ্ছায় দঃখের বোঝা নিতে পারে ক’জন?
শক্তির উৎস তিনি৷ যাকে তিনি তাঁর কাজের ভার দেন, সে ভার বহন করবার শক্তিও তাকে অযাচিতভাবে দান করেন তিনিই৷ নইলে সাধ্য কি তার যে, সে গুরুভার এক মূহুর্তেও সে সহ্য করে?
যার প্রাণ আছে, শ্রেয়কে বরণ করবার জন্য যার আছে শ্রদ্ধা-সে কি কখনও তাঁর মহাশঙ্খের আহ্বান শুনে স্থির থাকতে পারে? কি শক্তি আছে সংসারের এই মিথ্যা মোহের যে, তাকে আটকে রাখবে? তাঁর আহ্বানে কি শক্তি আছে - জানি না---
শুধু জানি---যে শুনেছে কানে
তাহার আহ্বান গীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে
সঙ্কট আবর্ত মাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন
নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি মৃত্যুর গর্জন
শানেছে সে সঙ্গীতের মত!
আজ যাই দিদি৷ এই হয়তো শেষ প্রণাম!
---স্নেহের দীনেশ
- Log in to post comments