শুধু জাতিগত বৈশিষ্ট্য নয়, ভাষার ওপর সাংস্কৃতিক প্রভাব যথেষ্ট রয়েছে, এক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়৷ নিয়ম হ’ল এই যে, যে সংস্কৃতি প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও শক্তিশালী তা দুর্বল সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে৷ এমন কি কখনও কখনও তাকে আত্মসাতও করে ফেলে৷ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল পাশাপাশি বাস করার ফলে উভয়ের মধ্যে আদান প্রদান শুরু হয়৷ যে অধিক শক্তিশালী তা দুর্বল সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করে দেয়৷ সেই সময়ে প্রভাবিত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর লোকেরা, প্রভাব-বিস্তারকারী সংস্কৃতির সবকিছু গ্রহণ করতে চায়, তার মধ্যে ভাষাও একটি তত্ত্ব৷
আর্য-অনার্যদের মধ্যে প্রভূত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অনার্যরা সংস্কৃত ভাষাকে গ্রহণ করে নেয়৷ আবার আর্যরা অনার্যদের অন্তর্মুখী সাধনাকে নিজেদের ধর্মমতের মধ্যে মিলিয়ে নেয়৷ আর্য ভাষা সংস্কৃত, তাই পূর্ব ও উত্তর ভারতের সমস্ত ভাষাকে প্রভাবিত করেছে৷ দক্ষিণ ভারতের ভাষাতেও সংস্কৃত ভাষার প্রভাব যথেষ্ট বিদ্যমান-এর মধ্যে সব থেকে ৰেশী হল মালায়ালমে৷ তার কারণ হ’ল উত্তর ভারতের লোকেরা মাদ্রাজের ‘বর্তমানে চেন্নাই’ পশ্চিম দিক দিয়ে সমুদ্র পথে কেরালায় গিয়ে বসবাস শুরু করে৷ তাই মালয়ালাম ভাষার মূল ধাতু যদিও তামিল থেকে নেওয়া কিন্তু শব্দ ভাণ্ডার সংস্কৃতবহুল৷ তাই মালায়ালমে সংস্কৃত ভাষার পরিমাণ প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ৷
আর্যদের প্রভাব সমাজের উচ্চস্থানীয় লোকদের ওপর যেমন পড়েছিল তেমনিই পড়েছিল অধঃস্তন শ্রেণীর ওপরও৷ এই প্রভাব কোথাও কোথাও এত প্রবল হয়ে পড়েছে যে লোকেরা নিজের ভাষায় পরিবারের বাইরে কথা ৰলতে লজ্জা পায়৷ যেমন কতকগুলি অষ্ট্রিক শাখার লোক, যেমন সাহা গোষ্ঠীর লোকেরা ঘরে নিজেদের ভাষা ৰলে কিন্তু বাইরে তারা ৰলৰে ভোজপুরী৷ তেমনই বিহারের রাঁচী অঞ্চলের সিংমুণ্ডা ও শরণ গোষ্ঠীর লোকেরা ও ত্রিপুরার টিপ্সা গোষ্ঠীর লোকেরা বাংলা ভাষা ৰলে৷ গাড়োয়ালীরা টিবেটো-চাইনিজ ভাষা পরিত্যাগ করে, আর্য-ভারতীয় ভাষা বলা শুরু করেছে৷
এইভাবে জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলে ভাষার বিভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়৷ এই বিভিন্নতাকেও জোর করে দূর করা যায় না৷ কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাৰে যে, পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষাকে জোর করে অবদমিত করার প্রচেষ্টা হয়েছে৷
(মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত কণিকায় প্রাউট পুস্তকের সপ্তম খণ্ড থেকে গৃহীত)