রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্যোপাধ্যায় গত ২৭শে মে ফেসবুক পেজে ‘ছাত্র শিক্ষক’ -এর যাঁরা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, কীভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় উৎকর্ষ আনা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ চেয়েছেন৷
শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা নিয়ে আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ণ৷ বহুবার আমরা এই উদ্বেগের কথা আমাদের পত্রিকায় প্রকাশ করেছি৷ প্রাউট-প্রবক্তা মহান্ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার শিক্ষার সমস্যার সমাধানের জন্যে যে সুচিন্তিত অভিমত দিয়েছেন, তাঁরই ভিত্তিতে আমরা এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করছি৷ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যদি আন্তরিক ভাবে শিক্ষা-সমস্যার সমাধান চান,তাহলে প্রাউটের পরমর্শ কার্যকরী করতে পারেন৷ আমাদের বিশ্বাস, তাতে শিক্ষার প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হবে৷
এ ব্যাপারে আমাদের প্রথম পরামর্শ, দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে শিক্ষাক্ষেত্রকে মুক্ত রাখতে হবে৷ প্রাউট-প্রবক্তা তাঁর ‘‘আজকের সমস্যা’’ পুস্তকে সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘‘দলীয় রাজনীতির হাত থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সযত্নে মুক্ত রাখা দরকার৷ শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু পঠন-পাঠন, পাঠ-রীতি তথা পাঠ্য নির্বাচনের একচ্ছত্র অধিকার শিক্ষাব্রতীদেরই থাকা উচিত৷ রাষ্ট্র এই শিক্ষাব্রতীগণকে বা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরামর্শ দিতে পারে---হুকুম করতে পারে না৷ কোনো প্রস্তাব বিচার-বিবেচনার জন্যে পাঠাতে পারে--- গ্রহণ করতে চাপ দিতে পারে না৷ ’’
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে কলেজে কলেজে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন তৈরী করার প্রতিযোগিতা হয়,তা বন্ধ করতে হবে৷ বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ছাত্র ইউনিয়নগুলো মূল পার্টির নির্দেশে, পাটি স্বার্থের দিকে তাকিয়ে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এমনকি অধ্যাপকদের ওপরও হামলা চালায়, কলেজের পরিবেশটাই নষ্ট করে দেয়৷ বিশেষ করে বামফ্রন্ট আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কলেজে ছাত্র রাজনীতির বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে উঠেছে৷ মাঝে তো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেই বলেছিলেন, ‘‘কলেজগুলোকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব মুক্ত করবার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন৷ কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করেন নি, এমন কি সে চেষ্টাও করেননি৷
তেমনি শিক্ষক ইউনিয়নগুলিকেও দলীয় রাজনীতির প্রভাব মুক্ত করা একান্ত দরকার৷ সে চেষ্টাও করা হচ্ছে না৷ শিক্ষাক্ষেত্রের কাজ কর্ম , প্রশাসন, সিলেবাস তৈরী, পরীক্ষার প্রশ্ণপত্র তৈরী, পরীক্ষা করানো, পরীক্ষার ফলপ্রকাশ সহ শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সরকারের জড়িত থাকা উচিত নয়৷
সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দ্বারা পরিচালিত হবে৷ যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা ক্ষমতায় এসে নিজেদের মতো করে সিলেবাস তৈরী করবে, পাঠ্যপুস্তক রচনা বা সিলেকশন করবে--- তা চলতে দিলে শিক্ষাক্ষেত্রের নিরপেক্ষতা নষ্ট হবে৷ ছাত্র-ছাত্রার প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে শাসক দলের মতাদর্শ অনুসারে বিকৃতি শিক্ষা লাভ করবে৷ শিক্ষা হওয়া উচিত উদার, সার্বভৌম, দলমত নিরপেক্ষ, সংকীর্ণ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রাদের মানসিক বিকাশ ঘটানোর পরিবর্তে মানসিক বিকৃতি ঘটাবে৷ তাতে সমগ্র সমাজের ক্ষতি৷ তাই শিক্ষার বিষয়, পাঠ্যসূচি, পুস্তক রচনা, সিলেবাস তৈরী, এসমস্ত কিছুর দায়িত্ব দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষাবিদদের নিয়ে তৈরী বোর্ডের হাতে ন্যস্ত থাকা একান্ত প্রয়োজন৷
তাই বলে আর্থিক ব্যাপারে সরকার হাত গুটোলে চলবে না৷ শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সম্পূর্ণতঃ সরকারের৷ সরকার বা শাসকবর্গের বলার এক্তিয়ার নেই যে, আমরা যখন অর্থ জোগাচ্ছি, তাহলে শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতে থাকবে না কেন? শাসকগোষ্ঠী জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকেই শিক্ষাখাতে অর্থ ব্যয় করছেন৷ এটা তাঁদের দায়িত্ব তাই বলে শিক্ষা ব্যবস্থায় নাক গলানো তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না৷
তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সরকারকে মাথায় রাখতে হবে৷ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্থ রোজগার না হলেও শিক্ষান্তে চাকুরী বা কর্মসংস্থানের ব্যাপারটা সরকারকে দেখতে হবে৷ তাই প্রথম থেকে শিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিতে হবে৷ যেখানে যে ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ বা সুবিধা রয়েছে সে ধরণের বৃত্তিমূলক শিক্ষাও যেন ছাত্র-ছাত্রারা পায়, আর তার সঙ্গে সঙ্গে কার্যতঃ পাশের অভিজ্ঞানপত্রের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও নিশ্চিততা দিতে হবে৷ দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও সেইভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, সেই দিকে নজর রেখে ধণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সমবায় ভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার কাজে হাত দিতে হবে৷ আর এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে৷ জল,আলো,হাওয়ার মতো শিক্ষাকে সমস্ত মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তুলতে হবে ও দেখতে হবে শিক্ষা থেকে সমাজের একটি মানুষও যেন বঞ্চিত না হয়৷ এজন্য সর্বস্তরে শিক্ষাকে নিঃশুল্ক অর্থাৎ সম্পূর্ণ ফ্রি করতে হবে৷ আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা হ’ল, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রাদের কর্মসংস্থান বা আর্থিক দিকটার দিকে যেমন নজর রাখতে হবে, তেমনি ছাত্র-ছাত্রাদের নৈতিক তথা আত্মিক বিকাশের দিকটার প্রতিও সজাগ থাকতে হবে৷
আজকাল, ছাত্র-ছাত্রাদের নৈতিক তথা আধ্যাত্মিক শিক্ষার দিকটা, বলা চলে প্রায় সম্পূর্ণরূপেই অবহেলা করা হচ্ছে৷ এই অবহেলার জন্যেই সমাজে যত দুর্নীতি, ব্যাভিচার, সমাজে বিভিন্ন অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের এত বাড়াবাড়ি৷ বস্তুতঃ যথাযথ নৈতিক তথা আধ্যাত্মিক শিক্ষা না হলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়৷
- Log in to post comments