শিক্ষার সংকট

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

মানব সমাজের সঙ্গে শিক্ষার গভীর সম্পর্ক৷ শিক্ষককে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড৷ পক্ষান্তরে বলা যায় শিক্ষাই সমাজের মেরুদণ্ড৷ মানুষকে মানুষ করে গড়তে হলে উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন৷ প্রশ্ণ উঠতে পারে মানব শরীর নিয়ে যে জন্মায় সে তো মানুষই৷ মানুষকে আবার মানুষ হতে হবে কেন? অন্যান্য জীবের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানেই৷ একটা গোরুর শাবক গোরুই৷ কিন্তু একটা মানব শিশু মানুষও হইতে পারে, আবার দানবও হইতে পারে৷ নিজেকে চালাবার মতো বুদ্ধি পশুর মগজে নেই৷ প্রকৃতির দ্বারাই সে পরিচালিত হয়৷ তাই পশুত্ব নিয়েই পশু জন্মায়৷ কিন্তু মানুষের মূল্যবান সম্পদ তার বুদ্ধি৷ এই বুদ্ধির জোরেই মানুষ জড় সম্পদকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত করতে পারে৷ এই বুদ্ধি দিয়েই মানুষ জড় সম্পদকে সমাজের সার্বিক কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে পারে৷ কিন্তু সব মানুষ তা করতে চায় না৷ কারণ মানুষ লোভ, স্বার্থপরতার মতো রিপুর বশবর্তী হয়ে ব্যষ্টি বা গোষ্ঠীস্বার্থকে বড় করে দেখে, ব্যষ্টি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতেই বুদ্ধির ব্যবহার করে৷ এই ধরণের মানুষেরা কখনও চায় না মানুষের বুদ্ধি সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে ব্যবহার করা হোক৷

মানুষ জন্মগ্রহণ করে কতকগুলি সহজাত বৃত্তি নিয়ে৷ স্বভাবগতভাবে এই বৃত্তিগুলির কিছু যেমন মানুষকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়, বিকাশেরপথে নিয়ে যায়, আবার কিছু বৃত্তি মানুষকে অবনতির পথে, অধঃপতের পথে নিয়ে যায়৷ এখানেই মানুষের উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজন৷ কারণ বর্তমানে এক শ্রেণীর হীনরুচির নিম্নমানের সঙ্গীত, চলচিত্র বিজ্ঞাপন মানুষের হীনবৃত্তিগুলিকে উস্‌কে দিয়ে মানুষকে নৈতিক অধঃপতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ আজ সমাজের যে চরম অবক্ষয় সর্বস্তরে--- রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ধর্ম সবই মানুষকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে৷

আজ সমাজ ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা, ব্যাভিচার --- এর অন্যতম কারণ যেমন আর্থিক বৈষম্য, তেমনি উপযুক্ত শিক্ষার অভাবও সমাজকে অধঃপতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ বর্তমান সামাজিক সংকটকে শিক্ষার সংকটও বলা যেতে পারে৷ স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও দেশে একটা উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি৷ এর মূল কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে রাজনৈতিক নেতাদের মাতববরি৷ শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য সেখান থেকে সরে গিয়ে শিক্ষাক্ষেত্র দলীয় রাজনীতির মল্লভূমিতে পরিণত হয়েছে৷ দুই বা ততধিক রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে৷ শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নয়, ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যেও সংঘর্ষ বাধে৷ অনেক শিক্ষকই দলীয় রাজনীতির উর্দ্ধে উঠতে পারে না৷ শিক্ষাব্যবস্থা ও পঠন-পাঠনের বিষয়ও তৈরী করা হয় শাসক দলের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে৷ তাই যে যখন ক্ষমতায় আসে তার মতো করেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে৷ তাই শিক্ষার যে মূল কথা--- কি শিখাইব, কে শিখাইবে ৭৭ বছরে তার কোন স্থায়ী নীতি তৈরী হলো না৷

আজকের তরুণ প্রজন্ম, ছাত্র-যুবদের অধঃপথে যাওয়ার অন্যতম কারণই শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির দাপাদাপি৷ আদর্শপরায়ণ ত্যাগব্রতী শিক্ষক আজও আছেন৷ কিন্তু রাজনৈতিক দাদাদের গা-জোয়ায়ারী সামনে তাঁরা ম্রিয়মান হয়ে রয়েছেন৷ তবু শিক্ষাব্যবস্থাকে এই সংকট থেকে বের করে আনতে এ বিষয়ে চিন্তা করছেন কিন্তু পাচ্ছেন না৷ এ বিষয়ে চিন্তাশীল ও বিচার বোধ সম্পন্ন মানুষ যাঁরা তাঁরা পরমশ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘নব্যমানবতা-ভিত্তিক’ শিক্ষা পুস্তকটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন৷ মানুষের প্রয়োজনও সমগ্র মানব সমাজের সার্বিক বিকাশের কথা ভেবে, জীবনের মহত্তম লক্ষ্যপ্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে তিনি এক আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করেছেন৷ যার বাস্তবায়ন বর্তমান সংকট থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে৷