সমাজ ও আধ্যাত্মিকতা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

আজকের সমাজের  বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা  নিজেদের প্রগতিশীল  বলে জাহির করেন, তাঁরা আদর্শ সমাজ সংরচনায় আধ্যাত্মিকতার যে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা সাধারণতঃ স্বীকার করতে চান না৷ তাঁরা আধ্যাত্মিকতাকে মনে করেন একটা অন্ধবিশ্বাস  বা কুসংস্কার৷ আসলে ‘আধ্যাত্মিকতা’  সম্পর্কে তাঁদের ধারণাটাই পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ৷

সমাজে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষ রয়েছে, ধর্মের নামে যে জাত-পাত বা ছঁুয়া-ছুতের  বিকৃত ভাবনা রয়েছে, এগুলোকে ধর্মের  অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই তাঁরা মনে করেন৷ নানান্ দেব-দেবীর প্রতি মানুষের যে ভয় ভক্তি রয়েছে, অমুক দেবতা বা দেবীর পূজো না করলে বা অবজ্ঞা করলে আমার ভয়ানক বিপদ হয়ে যাবে, ওই দেবী-দেবতার অভিশাপে আমার  সর্বনাশ ডেকে আনবে-এই ধরণের ভীতি আর সেই ভীতির জন্যেই ওই সমস্ত দেবী-দেবতাকে পূজা করা--- এই সবকেই বেশির ভাগ মানুষ ধর্ম বলে মনে করেন৷

ধর্মের সম্পর্কে তাঁদের এই ধারণাটা যে সর্বৈব মিথ্যা  এটাই  তাঁরা  জানেন না৷ অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের  কোনো সম্পর্ক নেই৷ স্বামী বিবেকানন্দজীকে  তাঁরা মান্যতা দেন বা ভক্তিও করেন, কিন্তু যে আধ্যাত্মিকতা নরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্বামী বিবেকানন্দে  পরিণত করেছিল , সেই আধ্যাত্মিকতার  প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নেই৷ এটা কি বৌদ্ধিকতার ভণ্ডামী নয়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, রবীন্দ্রনাথ নোবেল  পুরস্কার লাভ করে বাঙলা তথা ভারতবাসীকে গৌরবান্বিত করেছেন, এটা তাঁরা স্বীকার করেন৷ কিন্তু যে ‘গীতাঞ্জলি’র জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, সেই গীতাঞ্জলি যে পরিপূর্ণভাবে  আধ্যাত্মিকতা- আধারিত এটা জেনেও তাঁরা না-জানার  ভান করেন৷ গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতাই তো ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার  চরণ ধূলার তলে’--- এটা তো না-জানার কথা নয়! তাহলে রবীন্দ্রনাথকে মান্যতা দেব, অথচ তাঁর আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করব, এ কী ধরণের কথা? এটা কি আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? এর পেছনে তাঁদের মানসিকতা হ’ল-- রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের প্রশংসা করলে প্রগতিশীল হওয়া যাবে, অথচ আধ্যাত্মিকতাকে মানি  বললে আমাকে লোকে ‘ব্যাক-ডেটেড’ বলবে--- এ ধরণের ভাবনা কি উদ্ভট অযৌক্তিক ভাবনা নয়?

রাজা রামমোহন রায়কে তাঁরা আধুনিক রেণেশাঁর জনক বলে জ্ঞানগর্ভ বত্তৃণতা দেন, কিন্তু তিনি যে ব্রহ্মবাদী, আধ্যাত্মিকতা যে তাঁর জীবনের ভিত্তি---এটা মানতে কষ্ট হয় কেন? আধুনিক  তথাকথিত বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য এইভাবে দ্বিচারিতায় ভরা৷

তাঁরা যে আসলে আধ্যাত্মিকতার প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ--- এই সহজ সত্য কথাটা তাঁরা মানেন না৷ আর তা মানলে তো তাঁদের পাণ্ডিত্যের  অন্তঃসার শূণ্যতা সর্বসমক্ষে ধরা পড়ে যাবে! এটা তাঁরা কিছুতেই চান না৷

আমরা তাঁদের বলব, তাঁরা  সত্যকে  সহজভাবে স্বীকার করুন৷ উল্লিখিত মহামানবদের জীবন ও আদর্শকে গভীরভাবে অনুধ্যান করে অন্ততঃ আধ্যাত্মিকতার প্রতি নাসিকা-কুঞ্চন ভাবনা দূর করুন৷ আধ্যাত্মিকতা যে   অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের সমষ্টি নয়, পরন্তু আধ্যাত্মিকতার স্থান যে সমস্ত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঊধের্ব,  সেটাই উপলব্ধি করার চেষ্টা  করুন৷

প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর এই সমস্ত মহাজ্ঞানীদের বাণী হ’ল--- প্রকৃত আধ্যাত্মিকতাই জীবনের সুদৃঢ় ভিত্তি৷

আধ্যাত্মিকতা যখন আদর্শ মানবজীবনের ভিত্তি, আর মানুষের সমষ্টিই  যখন সমাজ, তখন আদর্শ সমাজের ভিত্তিভূমিও আধ্যাত্মিকতা৷ এটা তো যুক্তিসিদ্ধ৷

 সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলাই সমাজ৷ ‘সমানম্ এজতি  ইতি সমাজ ঃ’৷ তাই সমাজের  মূল কথা হ’ল পারস্পরিক সহযোগিতা৷ ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’--- এই মানসিকতাই সমাজের ভিত্তি৷

বর্তমানে সমাজের সমস্ত সমস্যার মূলীভূত কারণ হ’ল উগ্র স্বার্থপরতা, প্রাউটের ভাষায় আত্মসুখতত্ত্ব, আজকের পুঁজিবাদী সমাজে যা ‘ভোগবাদ’ নামে পরিচিত৷  কেবল আমি ভোগ করব, আমার পাশের যারা নিঃস্ব রিক্ত,হৃতসর্বস্ব---তাঁদের কথা চিন্তা করব না৷ তাঁরা যে কত কষ্টে আছে, কত অভাবের  মধ্যে রয়েছে, তাদের কথা ভাবতে গেলে যে আমার ভোগবিলাসিতা ধাক্কা খাবে- তাই কি তাদের কথা ভাবলে চলবে না!

আবার একদল বুদ্ধিজীবী এই হীন মানসিকতাকে প্রোৎসাহিত করে বলছেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সারকথা হ’ল বাঁচার জন্যে লড়াই করতে হবে, আর যোগ্যতমই এ লড়াইয়ে জয়যুক্ত হবে৷ এই প্রতিযোগিতাই প্রগতির মূল সূত্র৷ এই নিয়ম মেনেই জীবের বিবর্তন হয়েছে৷

তাঁদের বলব, এটা মনুষ্যেতর প্রাণীদের বিবর্তণের মূলসূত্র হতে পারে৷ কিন্তু এটা মনুষ্যত্বের সারকথা নয়৷ মানুষ জীব কিন্তু জানোয়ার নয়৷ হিংস্র জীবজন্তুর মত মানুষকে বিবেকহীন হলে চলবে না৷ এখানেই মানুষের সঙ্গে  হিংস্র প্রাণীদের তফাৎ৷

তাই ‘ডারউইনবাদ’ কে ভিত্তি করে মানবসমাজের প্রগতি হতে পারে না , মানবসমাজের প্রগতির ভিত্তি হ’ল ‘সিমবায়োটিক থিওরী’৷ অর্র্থৎ আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের  সঙ্গে যেমন   পারস্পরিক  সম্পর্কে, একের সুস্থতা, একের  সঙ্গে অন্যের  হিত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত-সমাজের সমস্ত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও তেমনি৷

প্রাউটের ‘নব্যমানবতাবাদ’ তত্ত্বের সারকথাও  এইটাই৷ শুধু মানুষ নয়, এই জগতের পশু-পক্ষী তরুলতা সবাইকে  নিয়ে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে৷ সবাইকে ভালবাসতে হবে৷ এককে ধবংস করে অন্যের  বাঁচা নয়, নিজেকে যেমন বাঁচতে হবে, অন্যকেও বাঁচতে সাহায্য করতে হবে৷ Live & let live সবাই মিলে আমরা  এক অখন্ড সত্তা --- এটাই আমাদের ভাবতে হবে৷ এতেই  সমাজের  প্রকৃত প্রগতি৷

এই যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সেবা ও ত্যাগের  ভাবনা --- এর ভিত্তিই হ’ল আধ্যাত্মিক চেতনা ৷ সবার মধ্যে সেই একই আত্মা বিরাজমান৷ সবার আত্মা সেই এক পরমাত্মার প্রতিফলন-এই চেতনাই মানুষকে তথা সমস্ত জীবকে কাছে টেনে আনবে৷ এই চেতনা এনে দেবে পারস্পরিক ভালবাসা, সেবা ও ত্যাগের ভাবনা৷ তাই প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশই হ’ল আদর্শ সমাজের ভিত্তিভূমি৷

তাই আজ যারা সমাজের যথার্থ কল্যাণ চান, তাদের উচিত তাদের নিজেদের মধ্যে ও সবার মধ্যেই এই সার্বভৌম আধ্যাত্মিক চেতনার জাগরণের ‘আন্তরিক প্রয়াস’৷