বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে, ও যুক্তিসঙ্গত বণ্ঢন করতে হবে৷
স্থূল জগতে, সূক্ষ্ম জগতে ও কারণ জগতে যা কিছু সম্পদ নিহিত আছে তার উৎকর্ষ সাধন করতে হবে জীব কল্যাণে৷ ক্ষিতি–অপ–তেজ–মরুৎ্– পঞ্চতত্ত্বের যেখানে যা কিছু লুকানো সম্পদ রয়েছে তা ষোল আনা সদ্ব্যবহারের প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এর উৎকর্ষ সাধিত হবে৷ জল–স্থল–অন্তরীক্ষ তোলপাড় করে’ মানুষকে প্রয়োজনের উপাদান খুঁজে বের করে’ নিতে হবে–তৈরী করে’ নিতে হবে৷
মানুষের আহৃত সম্পদ বিচার–সম্মতভাবে মানুষের মধ্যে বণ্ঢন করে’ দিতে হবে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন প্রয়োজন সবাইকার তো মেটাতে হবেই, অধিকন্তু গুণীর ও বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ মানুষেরও প্রয়োজনের কথা মনে রাখতে হবে৷
জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর রয়েছে–জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷
জাগতিক স্তরে আবার অনেকগুলি উপস্তর রয়েছে–যেমন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সামাজিক অগ্রগতি ও সেই সঙ্গে রাজনৈতিক–অর্থনৈতি জীবন৷
জাগতিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ
এই সৌরজগৎ সম্পদ–প্রাচুর্যে ভরপুর৷ শুধুমাত্র মানুষই নয়, জীবজগতের খাওয়া–পরা তথা সর্বাত্মক বিকাশের জন্যে পর্যাপ্ত সম্পদ এখানে রয়েছে কিন্তু আমাদের অনুন্নত চিন্তা ও দুর্বুদ্ধির জন্যেই আমরা যথার্থ সমাধান খুঁজে পাইনি৷ আমাদের এই পৃথিবী যেন গুপ্তধন–ভাণ্ডার৷ বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবর্ধনের জন্যে আমাদের এই লুকোনো সম্পদকে ভালভাবে কাজে লাগাতে হবে৷
প্রকৃতি অকৃপণ হস্তে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলকেই অজস্র ভূ–নিম্নস্থ সম্পদে ও ভূমি–উপরস্থ সম্পদে সমৃদ্ধ করে’ দিয়েছে৷ বনজ, কৃষিজ, খনিজ, জলজ, ভেষজ, প্রভৃতি সম্পদে আমাদের এ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল পূর্ণ হয়ে রয়েছে৷ তবু বহু দেশের অর্থনৈতিক পরিভূতে রয়েছে চরম দারিদ্র্য, জীবন যাত্রার নিম্ন মান, কৃষি ও শিল্পে অনগ্রসরতা৷ ফলে অন্নাভাব, বস্ত্রাভাব, নিরক্ষরতা, চিকিৎসার অভাব ও গৃহহারা জীবনের অভিশাপ নিয়ে আজও বিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগে কোটি কোটি মানুষ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করে’ চলেছে৷ প্রকৃতির অঢেল আশীর্বাদে সম্পদের অভাব কোন অর্থনৈতিক অঞ্চলে নেই, কিন্তু শুভ–হিতৈষণার অভাবের জন্যে সমাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে লাগান হয়নি৷ ফলস্বরূপ, ভৌতিক জগতে মানুষের ন্যুনতম চাহিদাগুলি (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান) পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি৷
মানব সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়ের কথাই ভাবা যাক না৷ এই অতি প্রাচীন ঢেউখেলানো ভূমিখণ্ডে প্রকৃতি তার সম্পদের ভাণ্ডার উজাড় করে’ ঢেলে দিয়েছে৷ রাঢ়ের প্রাচীন কঠিন শিলার স্তরে স্তরে ঢাকা রয়েছে সোণা*,*রূপা, তামা, পারা, অভ্র, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি ধাতব দ্রব্য৷ আবার আগ্ণেয় শিলার কঠিন শয্যায় শায়িত রয়েছে কোয়ার্জ ও অনেক ধরণের মূল্যবান প্রস্তর৷ রাঢ়ের প্রাচীন পাললিক শিলাস্তরে ও মৃত প্রস্তরের অভ্যন্তরে খুঁজে পাচ্ছি উন্নতমানের কয়লা ও বালি৷ পশ্চিম রাঢ় তাই অজস্র খনিজ সম্পদে রত্নগর্ভা৷ আর পূর্ব রাঢ়ের ভূমিখণ্ড তুলনায় নবীন মৃত্তিকাসঞ্জাত, কারণ এ অঞ্চল হ’ল সমুদ্রোত্থিত৷ কিন্তু তারও বুকে অতি প্রাচীনকালে যে সকল স্থানে ‘সারগোসা’ সমুদ্র ছিল, সে সকল অঞ্চলে খনিজ তৈল পাবার বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷
পশ্চিম রাঢ় যেমন সমৃদ্ধ মাটির তলাতে, পূর্ব রাঢ় তেমনি সমৃদ্ধ মাটির ওপরে৷ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বর্দ্ধমান, হুগলী, হাওড়া, পূর্ব–মেদিনীপুর, কান্দি মহকুমার মত উর্বর জমি বিরল৷ এর কারণ হচ্ছে দামোদর, অজয়, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, বক্রেশ্বর, কোপাই, শিলাবতী, হিংলো প্রভৃতি রাঢ়ীয় নদীগুলি তাদের উজানে ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য প্রচুর খ্নিজ সম্পদ সমৃদ্ধ পলিমাটি বহন করে’ এনে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মৃত্তিকার উপরিভাগকে করে’ তুলেছে উর্বর, মাটিকে করেছে সোণার মাটি৷ এই উর্বর ভূমিতে ধান, গম, ইক্ষু, ডাল, কার্পাস, তুঁত–রেশম, অতুঁত–রেশম ইত্যাদি বহু কৃষিপণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে৷ রাঢ়ের লালমাটি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ৷ এ মাটিতে উৎকৃষ্ট মানের আপেল, নাসপাতি, কমলা, পেঁপে, পেয়ারা, আঙ্গুর, আতা প্রভৃতি ফল ফলতে পারে৷ বিভিন্ন ধরণের সেচ ব্যবস্থা (ক্ষুদ্র নদী সেচ, পুষ্ক্রিণী সেচ, তোলা সেচ) প্রবর্ত্তন করে’ উদ্যানশিল্প (orchard) ও বছরে তিন রকম ধানের (আউশ–আমন–বোরো) ফলনের চেষ্টা করাও যেতে পারে৷ কৃষি সম্পদের এই বিপুল সম্ভাবনাকে ভিত্তি করে’ রাঢ়ের বুকে গড়ে’ উঠতে পারত হাজার হাজার কৃষিভিত্তিক ও কৃষি–সহায়ক শিল্প –তাহলে রাঢ়ের সামাজিক–র্থনৈতিক পটভূমি আজ সম্পূর্ণ অন্যরূপ হ’ত৷
বাংলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক৷ বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া সহ সমগ্র পশ্চিম রাঢ়ের জন্যে একটি উপ–পরিকল্পনা (sub-plan) রচনা করা উচিত আবার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, গোয়ালপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের জন্যেও আর একটা উপ–পরিকল্পনা রচনা করা উচিত৷
আমাদের এই পৃথিবীতে এমন দেশ আছে যেখানে আরও বেশী খাদ্য উৎপাদন করা যাবে৷ স্বচ্ছল দেশগুলি
থেকে উদ্বৃত্ত যাবতীয় সম্পদ, অন্ন, জল–প্রয়োজন বিশেষে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বিলি করা যেতে পারে৷ পৃথিবীর কাউকে কোথাও অনাহারে মরতে দেওয়া হবে না৷ আমরা সবাই সকলের জন্যে–বিশ্বের যাবতীয় সম্পদ সকলের ভোগের জন্যে৷
একদেশের মানুষ ভূমির অভাবে বা খাদ্যের অভাবে ক্লেশ পাক, অন্যদেশে থাকুক প্রচুর পতিত জমি বা প্রচুর খাদ্য–এ অবস্থাটাও এক ধরণের পুঁজিবাদ ছাড়া আর কী
বিশ্বের কোন কিছুই গুরুত্বহীন নয়৷ কোন কিছুকেই তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করা চলে না৷ অণু–পরমাণুকে এককালে খুবই ক্ষুদ্র ও গুরুত্বহীন বলে’ মনে করা হ’ত৷ কিন্তু আণবিক বোমা আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ সেই অণুকেই ভয়ের চোখে দেখতে লাগল৷ কেউ ঠিকভাবে জানে না কোন্ জিনিসটার মধ্যে কী ধরণের সম্ভাবনা নিহিত আছে৷ কেবল পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার পরেই কোন বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধে মানুষ একটা সম্যক্ ধারণা গড়ে’ তুলতে পারে৷