সংকীর্ণ সেন্টিমেন্ট ভিত্তিক  নির্বাচন বনাম দেশের আমূল পরিবর্তন

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি মেদিনীপুরের লোকসভা প্রার্থী দিলীপ ঘোষ রামনবমীর দিন রামনবমীর মিছিলের নামে গদা হাতে মিছিল করলেন, কেউবা তলোয়ার হাতে মিছিল করলেন৷ প্রয়োজনে কারুর বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করারও হুমকি দিলেন৷

নির্বাচন বিধি অনুসারে অস্ত্র হাতে মিছিল নিষিদ্ধ৷ নির্বাচন কমিশন সেই ঘোষণাও করেছেন৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশনারের সেই ঘোষণাকে অমান্য করেই মিছিলে অস্ত্র ব্যবহার করা হল৷

দিলীপবাবু---ইতোপূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘রামনবমীতে অস্ত্র শোভাযাত্রা, ঐতিহ্য৷ আর যেটা ঐতিহ্য সে সেভাবে করবে৷’

এইভাবে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে সুড়সুড়ি দিয়ে, বিজেপি নির্বাচকমণ্ডলীকে প্রভাবিত করতে চান৷ বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের নীতির সঙ্গে এটা একেবারে খাপ খায় না৷ কিন্তু তাতে বিজেপির কিছু যায় আসে না৷

বিজেপি’র প্রধান হাতিয়ার ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে জয়লাভ করা৷ প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের কোনো সম্পর্কও নেই, আসলে সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্টকে উস্কিয়ে দিয়ে সম্প্রদায় বিশেষের সমর্থন সংগ্রহের এটা একটা অপকৌশল মাত্র৷

এভাবেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরণের সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্টকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়৷

কিন্তু শাসনক্ষমতায় যাঁরা আসবেন,তাদের দেশের সমস্ত নাগরিককে সমদৃষ্টিতে দেখে সবার সামাজিক -অর্থনৈতিক সমস্যা-সমাধান করাটাই কর্তব্য৷ এখানে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই উচিত নয়৷ শাসকদলকে, কেবল শাসক দল কেন, সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই জাত-পাত-সম্প্রদায়ের ঊধের্ব উঠতে হবে৷ সবার কল্যাণ করার কাজে হাত লাগাতে হবে৷ নাহলে দেশের সংহতি টেকে না, দেশের প্রকৃত উন্নয়নও সম্ভব নয়৷ তাই হিন্দু-মুসলীম সেন্টিমেন্টকে উস্কিয়ে দিয়ে নির্বাচন করা চরম অপরাধ৷ এটা দেশ-শাসনের মৌলনীতির বিরোধিতা করা৷

রাজনীতিবিদদের কোনো সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়৷ ‘জিও-সেন্টিমেন্ট’কে অর্থাৎ কোনও এলাকা-কেন্দ্রিক বা অঞ্চল-কেন্দ্রিক সেন্টিমেন্ট, ‘সোসিও সেন্টিমেন্ট’ অর্থাৎ বিশেষ ‘গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সেন্টিমেন্ট’, এমনকি ‘অর্ডিনারী হিউম্যান সেন্টিমেন্ট ’ অর্থাৎ সাধারণ মানবতাবাদের সেন্টিমেন্টের মধ্যেও আবদ্ধ থাকলে চলবে না৷

সমস্ত এলাকা, সমস্ত মানুষ এমনকি দেশের পশুপক্ষী-তরুলতা সবার কল্যাণসাধনের জন্যে প্রয়াসশীল হতে হবে৷

মহান্ দার্শনিক ঋষি প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায়, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যারা দেশ শাসনের দায়িত্বগ্রহণ করতে চান, তাদের অবশ্যই নব্যমানবতাবাদী হতে হবে৷ নব্যমানবতাবাদী মানেই যারা সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী-তরুলতা সবাইকে ভালবাসবে, যাদের মধ্যে কোনোমাত্র সংকীর্ণতা থাকবে না৷ তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই তারা দৃঢ়ভাবে নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবেন৷ প্রাউট-প্রবক্তা এই ধরণের চরিত্রের মানুষদের নাম দিয়েছেন ‘সদবিপ্র’৷ তিনি বলেন, মানুষের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব কেবল সদ্বিপ্ররাই করতে পারে৷ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা কেবল তারাই করতে পারবে৷ আর মানুষ এই সদ্বিপ্রদের চিনে নেবে তাদের আচরণ থেকে, তাদের সেবাপরায়ণতা থেকে, তাদের কর্মনিষ্ঠা থেকে, তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা থেকে৷

দেশের যথার্থ উন্নতি করতে গেলে দুটো মৌলিক জিনিস চাই---‘নোতুন নেতা, নোতুন নীতি৷’ নোতুন নেতা মানে এখানে বোঝানো হচ্ছে---বর্তমানে স্বার্থন্বেষী---পদ,অর্থ, যশলোভী মানুষেরাই নেতা সেজে সমাজের বিভিন্ন স্তরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ সমস্ত রাজনৈতিক দলে সৎ সেবাব্রতী নেতা বা কর্মীর একান্ত অভাব৷ আর এই কারণেই অচিরে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-নেত্রীরা নানান দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ে, তাদের পার্টির দুর্নাম হয়--- দেশেরও ক্ষতি হয়৷ এটা প্রায় সব দলের সাধারণ সমস্যা৷ কিন্তু কোনো দল সৎমানুষ তৈরী করার, সৎ ক্যাডার বা কর্মী তৈরী করার কোনো পরিকল্পনা নেয় না, বরং যেন তেন প্রকারে দলের কলেবর বৃদ্ধির জন্যে ভীষণভাবে চেষ্টিত হয়৷ অথচ এই যে সৎকর্মী বা সৎ মানুষ তৈরীর প্রয়াস না করা এটাই শেষ পর্যন্ত তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ তবু এ ব্যাপারে কারুর কোনো পরিকল্পনা নেই৷ অবশ্য আসল কারণটা হচ্ছে, কীভাবে সৎ মানুষ বা সৎ কর্মী তৈরী করবে সে পথটাই কারুর জানা নেই৷

দ্বিতীয় হ’ল মৌলী নীতি৷ আজকের বিভিন্ন বড় বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসরে নেমেছে, বর্তমানে লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেন কুরুক্ষেত্রে মহারণ শুরু হয়েছে৷ কিন্তু একটু তলিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, এদের সবাই একই পুঁজিবাদী সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বকে মেনে চলে৷ এমনকি আজকের তথাকথিত বামপন্থীরাও৷ সবাই দেশের দারিদ্র্যও বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে দেশ বিদেশের পুঁজিপতিদের একান্তভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন৷ সবাই পুঁজিপতিদের কৃপাপ্রার্থী৷ পুঁজিপতিদের মনজয় করার একান্ত প্রত্যাশী৷

পুঁজিপতিদের কাছে সবারই প্রার্থনা, তাঁরা তাঁদের এলাকায় এসে পুঁজি বিনিয়োগ করে কলকারখানা গড়ে তুলুক, তবেই এদেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান হবে ও তাদের মতে সমস্ত সমস্যারই সমাধান হবে৷

স্বাধীনতার পর সব দলই তো এইভাবে পুঁজিপতিদের সেবা করে গেলেন, কিন্তু তাতে দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান হয়েছে কি? হয়নি৷ অর্থাৎ দেশের যথার্থ সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো নোতুন নীতি --- কোনো পরিকল্পনাও এই সব রাজনৈতিক দলের নেই৷

তাহলে আছে কী? জনগণের কল্যাণ নয়, যেমন করে হোক ক্ষমতা লাভ, ক্ষমতা ভোগ  ও ওই ক্ষমতার সাহায্যে নিজেদেরও আত্মীয় স্বজনের সম্পদ বৃদ্ধি যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি৷ প্রাউট-চায় বর্তমান রাজনীতির এই অধোমুখী গতি প্রবাহের আমূল পরিবর্ত্তন৷

প্রাউট প্রথমতঃ সমাজে নোতুন নীতিবাদী নেতৃত্ব তৈরী করতে চায়--- তারজন্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে এই কাজ সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে প্রাউটের নোতুন যুগান্তকারী অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শেরও ব্যাপক প্রচার ও এ ব্যাপারে মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ও সেই অনুসারে কাজ চলছে৷ ‘সর্বাত্মক বিপ্লব ছাড়া সমাজের যথার্থ-কল্যাণ সম্ভব নয়৷ প্রাউট তারই প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে৷