শোষণ-যন্ত্রের কি নামান্তর গণতন্ত্র

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তাই, স্বভাবতঃই চিন্তারাশির স্রোত বইতে গিয়ে সংশয়ের বালিচরে পৌঁছে আটকে পড়তে চায়৷ বুঝে নিতে খুবই কষ্ট হয়,এমনতর পরিবেশে অবস্থান করে আজকের মানুষ আমরা কী নিয়ে আমাদের শিক্ষা,সংস্কৃতি,সামাজিক চেতনা, সভ্যতা ও সমৃদ্ধি তথা প্রগতি নিয়ে সত্যিকার অর্থে দাবী রাখতে পারি৷ এখানে অতীব প্রাসঙ্গিক কারণেই বাইরের কোথাও না তাকিয়ে প্রথমতঃ আমাদের নিজের ঘর, নিজের দেশ, আমাদের মাতৃভূমি, --- কবিগুরুর ভাষায় ‘মহামানবের সাগরতীরে ’ ভারতবর্ষ তথা আজকের এই খণ্ডিত ভারত নিয়েই গুটিকয়েক দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করতে চাইছি,যার সাহায্যে অপরিণত বয়েসের কাঁচা বুদ্ধির আর চপলমতি কিশোর---কিশোরীরাও সহজেই বুঝে নিতে পারবে এদেশে গণতন্ত্রের বর্তমান পূজারীরা গণতন্ত্রের বোরখার আড়ালে স্বৈরতন্ত্র তথা শোষণযন্ত্র চালাতে ওস্তাদিপনা দেখাচ্ছেন,স্রেফ পুঁজিবাদেরই ‘‘একনিষ্ট দালাল’’ সেজে৷

(ক) বেকার-সমস্যা দেশে দৈত্যকার রূপ ধারণ করেছে৷  আর শাসকগোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে , ডান-বাম-রাম জার্সি-গায়ে আবির্ভূত হয়ে ছেঁদো কথায়, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ও জুমলারাজি দিয়ে দিয়ে দেশের কোটি কোটি কর্মহীন  মানুষকে, বিশেষ করে, তরুণ-তরুণীদের ঠকিয়ে চলেছেন৷ আর, ইদানিং শাসকগোষ্ঠীর অপদার্থতা, অপরিণতদর্শিতা ও স্বচ্ছচিন্তার অভাব আর মূলতঃই দুর্নীতিপরায়ণতা ও ক্রীতদাসসুলভ ধনী-তোষণকারী মানসিকতার জন্যে সৃষ্ট দেশের আর্থিক সমস্যায় দিশেহারা হয়ে কর্ম বিনিয়োগের  বদলে কর্মী -ছাঁটাইয়ের পথ খুঁজছেন৷ ইদানীং আবার ধনীদেরই মেদবৃদ্ধি করাবার উদ্দেশ্যে দেশবাসীদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে বেসরকারী ফোর্সের মাধ্যমে চাইছেন রিক্রুটমেন্ট প্রথা চালু করতে৷ এভাবে এক ঢিলে দু’ পাখী মারার ফন্দি বের করেছেন  ‘ধনকুবেরদের পোষ্য’ মার্র্ক দেশ-কাণ্ডারীরা---একদিকে প্রভুভক্তগিরি বজায় রাখা আর অপর দিকে দেশের কোটি কোটি কর্মপ্রার্থীদের  ধন-কুবেরদের ভোগে নৈবেদ্য রূপে নিবেদন করা৷ দেশে প্রতিবছরে দু’কোটি চাকুরি দেবার ও ত্রিপুরার মত রাজ্যে মিস্‌ কলে চাকরি দেবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যে রাজনীতির মঞ্চে স্রেফ অভিনয় চাতুরিপনাই ছিল, এখনও যদি দেশবাসী ভুল করেন বুঝে নিতে তাহলে আকাশ থেকে ভাগ্যলিপি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে না সেকথা হলপ করেই বলতে পারি৷

(খ) শাসকগোষ্ঠীর দ্বিতীয় বিশ্বাসঘাতকতা স্বরূপ আরো একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে---রাজ্যস্তরীয় কিংবা কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের বিভিন্ন সুকৌশলের মাধ্যমে চাপের মধ্যে ফেলে রেখে, অদৃশ্যভাবে তাদের রক্ত ও প্রাণশক্তি নিংড়ে নেওয়া৷ বলা খুবই সঙ্গত একারণে যে দস্যু---তস্করেরা বা সন্ত্রাসবাদীরা নিরীহ মানুষদের  টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি অস্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদি লুঠ করে নেয় চুরি করে বা পকেট কেটে অথবা জুলুমবাজির দ্বারা কেড়ে নিয়ে যায়৷ কিন্তু, আমাদের দেশে এখন এমনই পলিটিক্যাল ‘দস্যু’ তস্কর, লুঠেরা  বা সন্ত্রাসীরা বহাল তবিয়তেই ঘুরছেন, দিব্যি আরামে আয়াসে দিন যাপন করছেন, গায়ে চর্বি আর গাত্রচর্মে চাক-চিক্যের জৌলুস বাড়াতে পারছেন, তাদের অধীনস্থ একশ্রেণীর কর্মচারীদের ‘নায্যপ্রাপ্তি’ থেকে  কৌশলের মাধ্যমে বঞ্চিত রেখে ও সেই বঞ্চনা ও  প্রতারণার অর্থ লুঠ করে নিয়ে৷ এমন নজির আমাদের ত্রিপুরা রাজ্যেও ভুরি ভুরি  পরিমাণে  রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি--- (১) অতীতের  কংগ্রেসী শাসনামলে  সেনগুপ্ত-মন্ত্রীসভা চলাকালে ন্যায্যবেতন বঞ্চিত  স্নাতক শিক্ষকদের হয়রানি করা (২) পরবর্তী বামফ্রন্টের  শাসনকালে সরকারী দপ্তরগুলোতে ও বিশেষ করে শিক্ষাদপ্তরে  শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রমোশন অন্যায়ভাবে আটকে রেখে দলীয়-ক্যাডার বানানো, বদলির ভয় দেখিয়ে দলদাসে পরিণত করা ও এগুলোর চাইতেও রোমহর্ষক ঘটনা ছিল পোষ্ট সৃষ্টি করে  একজ মাত্র চামচে দিয়ে চার-ছয়টি-স্কুল-প্রধানে কাজ চালিয়ে নেওয়া, ইত্যাদি৷

আবার বর্তমানে এরাজ্যে রাম-আমলে অর্থাৎ ‘‘ভাজপা আমলের পরিবর্তন--- আনয়নকারীরা আরও একধাপ উপরে চড়ে গিয়ে তারা বাম-আমলের ‘‘নির্দিষ্ট বেতনে চাকুরি’’ নীতিকেও  হার মানিয়ে বেশ কায়দা খুঁজে পেয়েছেন ‘‘চুক্তি ভিত্তিক চাকুরীতে’’ নিয়োগ প্রথায়৷ এই নীতির ফলে, চাকুরীজীবী তথা চাকুরী প্রার্থীরা দিনরাত চবিবশ ঘন্টাই চাকুরি খোয়াবাদ বলা যায় জীবিকা হারাবার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে বাধ্য থাকেন ও দপ্তরের সমস্ত অন্যায়, জুলুম,  অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা- অবিচার নীরবে  নতমস্তকে মেনে নিতে হয়৷ এই অবস্থায় এসব শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অফিশিয়্যালরা যাতে স্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্তদের সম মর্যাদা, সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধে সহ বেতন হার ইত্যাদির ন্যায্য-পাওনার  দাবী না জানাতে পারেন, সেজন্যে মাঝে মাঝে অতি অবশ্যই তাদের কর্ম-বিচ্যুতি (সার্বিক-ব্রেক) ঘটানো হয় দপ্তরীয় উপরিওয়ালাদের মস্তিষ্ক বলে৷ সবচেয়ে দুঃখজনক যে, সর্বশিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা  দুটো মিলে এখনকার সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে এই বজ্জাতি-নীতিটা আরো প্রকট  রয়েছে৷ এরই সুবাদে কোন কোন  কর্মজীবীকে একাই দু’ থেকে চার রকমের  বিভিন্নমুখী দায়িত্বের বোঝা টানতে হচ্ছে এটাই বাস্তবচিত্র৷ আর, এমনটা যে শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রের ঘটছে তা তো নয়৷ যত দূর পত্র-পত্রিকায় জানা যায় রাজ্য-সরকারের অন্যান্য কোন কোন দপ্তরেও একই রকমের অরাজকতা চলছে৷ কিছুদিন আগে পশুপালন দপ্তর কিংবা কৃষিদপ্তর নিয়েও কেচ্ছা জনগোচরে এসেছে৷ এরাজ্যে বাম-আমলের কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ জীবন-যন্ত্রণা চরম ভোগের শিকারে পরিণত হয়েছেন ১০,৩২৩---এর কর্ম-জীবীরা৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ণটা ঘুরে ঘুরে মনকে পীড়ন করে যে--- কাদের অন্যায়ের বোঝা কারা বহন করে চলেছেন৷ মন আরও উথাল-পাথাল করে উঠে,যখন শুণি এরাজ্যের চুক্তিভিত্তিক কর্মজীবীদের স্থায়ীকরণের  জন্যে ভারতের সবের্র্বচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা’ নাকি কার্যকর হচ্ছে না৷ এমনকি এ ধরণের কর্মচারীদের নামে কেন্দ্রের বরাদ কত অর্থ এনেও কর্মচারীদের পুরো প্রাপ্যটা চুকিয়ে  না দিয়ে কিছু অর্থ (বেশ মোটা মাপের) ‘কাটমানি’  বা ‘তোলাবাজি’ বা পোশাকীয় ভাষায় ‘ঠগবাজি’ বা  চিটমাটি স্বরূপ দপ্তর কর্তারা বেহদিশ করে দিয়ে চলেছেন৷ তাই প্রশ্ণঃ--- এরা কি গণতন্ত্রের জোরেই চলছে না, না দিল্লী আগরতলা মেইল ডাব্‌ল ইঞ্জিন বলেই সম্ভব হচ্ছে৷

এবারে, পুঁজিবাদ-তোষক ও দুর্নীতির-পোষক গণতন্ত্র নিয়ে আরও দুয়েকটি কথা বলেই লেখাটির  ইতি টানতে চাইছি৷ লেখাটির পেছনে একটাই মাত্র উদ্দেশ্য রয়েছে৷ তীর্থস্থানে অথবা বলতে পারি নাম করা সব মন্দির সমূহে সাধারণ মানুষেরা অনেক বিশ্বাস, ভক্তি, নিষ্ঠা ও কামনা নিয়ে দেবদর্শনে যান, ধর্না দেন, পুজো -আরাধনা করেন ---যাতে বৈয়ষ্টিক জীবনে, পারিবারিক, রাষ্ট্রিক তথা সামাজিক জীবনে একটু শান্তি, নিরাপত্তা লাভ ও বিড়ম্বনা থেকে  মুক্তিলাভের আশা নিয়ে৷ কিন্তু, যখন আমরা শুণতে পাই যে, অমুক  মন্দিরে  কোন পাণ্ডা বা পুরোহিত কর্ত্তৃক অথবা তাদেরই পোষা গুণ্ডাদের দ্বারা কোন তীর্থযাত্রী ভক্ত ও তার মানুষজন প্রতারিত  হয়েছেন তখন আমরা কাকে দায়ী করব যুক্তিসম্মত বিচারে? নিশ্চয়ই সেই মন্দিরের বিগ্রহ, দেবালয়ের ইট-কাঠ থালা-বাসন-ধূপদানীকে নয়, এমনকি অদৃশ্য ঈশ্বরকেও নয়--- দায়ী করাটা যুক্তিগ্রাহ্য হবে মন্দিরের পরিচালক গোষ্ঠী ও তাদের পরিচালন ব্যবস্থাকে তাই নয় কি? তদ্রূপ, যদি ভাবা যায়  যে গোটা ভারত-ডোমিনিয়ন হচ্ছে আমাদের সেই মন্দির, দেবালয় বা তীর্থস্থান, ভারতবাসী মাত্রেই পূজারী, উপাসক বা তীর্থযাত্রী আর গণতন্ত্রের ধবজাধারী দেশ-পরিচালকরাই হচ্ছেন সেই মন্দিরের পুরোহিত বর্গ৷ তাহলে, আমাদের বিবেক সত্তার রায় কী হওয়া উচিত? (১) গুজরাটিসহ ভারতের গুটি কয় পুঁজিপতি অর্থদস্যুরা ব্যাংক ফাঁকা করে দিয়ে বেপাত্তা হয়ে রয়েছে৷ (২) ব্যাংকের ক্ষতি পোষাতে গিয়ে ইদানীং কয়েকটি ব্যাংকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ইতোমধ্যেই রেল, রেলস্টেশন, বিমান, পরিবহন ইত্যাদি বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ কিছু কিছু  বিক্রীও  করে দেওয়া হয়েছে৷ আরও বিক্রী করা হবে৷ ভবিষ্যতে কর্মচারী নিয়োগ করা হবে আউট সোসিং মাধ্যমে৷ সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার প্রণীত কৃষি-আইনে কৃষি ব্যবস্থাপনায় রচিত হয়েছে বড় বড়  বিজনেশম্যানসহ করপোরেট সংস্থার স্বার্থে, পেট্রোল ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দামসহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেলাগামভাবে বেড়ে চলেছে৷ দেশবাসী সাধারণ মানুষের জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷

এ সবের জন্যে দায়ী কারা? দায়ী হবেন কি ঈশ্বর, না মাটির দেশ ভারতই? দায়ী তথাকথিত গণতন্ত্রের মূলভিত্তি জনগণ , না দেশের পরিচালন ব্যবস্থা কেবিনেট, ইত্যাদি বজায় রেখে অর্থাৎ সরকারী ব্যবস্থাপনায় রেখে --- দেশ চলার মূল রসদ সরবরাহকারী ইঞ্জিন অর্থাৎ (১) কৃষি , ২) শিল্প ও ৩) বাণিজ্যিককে বেসরকারীকরণে এতটাই লোলুপ কেন? দেশের সম্পত্তির প্রকৃত মালিক কারা?--- বিধায়ক, সাংসদ ও তাদের মন্ত্রী--- আমলারা না দেশবাসী জনসাধারণ? শুধু বোটের  জোরে নির্বাচিত বা দেশবাসীর মালিকানা গুটিকয়েক পুঁজিপতির হাতে তুলে দেবার জন্যে যে কৌশল--- এরই নাম কি গণতন্ত্র? তাহলে, এইসব গণতন্ত্রকে ‘‘শোষণের হাতিয়ার যন্ত্র বা তন্ত্র’’ বলা অন্যায় হবে কোন যুক্তিতে?