পরিবেশগত ভাবে বাঙালী মুক্ত–চিত্তের অধিকারী৷ জাত–পাতের লড়াই গৌড়বঙ্গে বড় একটা ছিল না৷ তন্ত্র–ভিত্তিক শৈব সংস্কৃতি বাঙালীর চেতনা–মননকে পুষ্ট করেছে৷ পেশাভিত্তিক সামাজিক–র্থনৈতিক জীবন শুরু হবার বহু পূর্ব থেকেই সকল বাঙালীর সাধারণ পেশা ছিল তিনটে – মাছ ধরা, তাঁত বোনা ও চাষ করা৷ তাই উঁচু–নিচু–জাত–পাত ছিলনা৷ কাল হল আর্যাবর্তের ব্রাহ্মাণ্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ৷ পরবর্তীকালে বল্লাল সেনের বল্লালী দাওয়াই–কৌলিন্য প্রথা ও ‘বিভেদ কর, শাসন কর’ নীতি বাঙালীর মুক্ত চিত্তের মেরুদন্ড ভেঙে দিল৷ আরো পরবর্তী কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি বাঙালীর অনৈক্যকে সুদূর প্রসারী করেছে৷ স্বাধীনোত্তর কালে অচেতন বাঙালী চেতনার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেছে বাঙলায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা৷ ভোটের ঢ়াকে কাঠি পড়তেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক কাজিয়া৷ চলছে পরস্পরের কাদা–ছোঁড়া ছুঁড়ি, চরিত্র হনন৷ এই রাজনৈতিক দাঙ্গায় মরছে বাঙালী, মারছে বাঙালীই৷ লুপ্ত হয়েছে বাঙালী ঐক্য চেতনা৷ সাম্রাজ্যবাদীদের কূট–কৌশলে, রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজদের নিষ্ক্রিয়তার ও সর্বভারতীয় তক্মা পেতে পরের ইন্ধনে আপন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির উন্ানাসিকতা ও অবজ্ঞা, অমর্যাদা বাঙালীর অনৈক্যের ফাটলকে গভীর চারী করেছে৷ মানুষকে ধোঁকা দিতে সংসদীয় গণতন্ত্রকে তারা ঢ়াল হিসাবে ব্যবহার করছে৷
সাধারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ভাষা সংস্কৃতির বন্ধন একটা জনগোষ্ঠীকে সংহত করে এক ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে দেয়৷ কিন্তু বাঙলার শৌর্যবীর্যে–সম্পদে–ম্ ঐতিহ্যে ঈর্ষায়িত হয়ে বিদেশী ও হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা বাঙালীর সাধারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ পুষ্টির সন্তুলিত বুনিয়াদকে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে৷ বাঙলার সংস্কৃতিতে চটকদারী অসংস্কৃতির ফোয়ারা ছুটিয়েছে, বাংলা ভাষার চলাচলের পথকে রুদ্ধ করে চূড়ান্ত অবজ্ঞার জঞ্জাল স্তুপে নিক্ষেপ করেছে৷
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতি গোষ্ঠী আজ বাঙালী জনগোষ্ঠীকে আত্ম পরিচয় ভুলিয়ে নানা দল–উপদলে বিভক্ত করে পরস্পরের মধ্যে ভাতৃঘাতী লড়াই লাগিয়ে অবাধে লুন্ঠন করে চলেছে বাঙলার সম্পদ৷ অবুঝ বাঙালী পুঁজিপতি নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দলের সামান্য উচ্ছিষ্টের আশায় আত্মকলহে মগ্ণ!
আজ চূড়ান্ত সর্বনাশের খাদের কীনারায় দাঁড়িয়ে বাঙালীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি লুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক শিরোনামে বিশেষিত হয়ে যাদুঘরের চির শয্যার স্থান করে নেবে, নাকি শোষণ–বঞ্চনা–ত্যাচ্ অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে মারের উপর ভয়ঙ্কর ভাবে জেগে উঠবে৷ কোন মধ্যপন্থার অবকাশ আর নেই৷ তীক্ষ্ণোজ্জ্বল উন্মাদনায় উত্তরণে যদি এগিয়ে যেতেই হয় তবে ‘শীতঘুম’ ছেড়ে বাঙালীকে জেগে উঠতেই হবে৷ সুবর্ণরেখার পূর্ব পাড় থেকে অজয়, ময়ূরাক্ষী, কোয়েল কুমারী, কংসাবতী, রূপনারায়ণ হয়ে তিস্তা তোর্সা, জলঢ়াকা, মহানন্দা পার হয়ে হাওড়া, খোয়াই থেকে বরাকভ্যালি ব্রহ্মপুত্র বাঙলার সীমানায় বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে তার অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে৷
- Log in to post comments