স্থায়ী বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ---সমবায়

লেখক
সত্যশিবানন্দ অবধূত

গত ৪ঠা নভেম্বর নয়াদিল্লীতে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড ফুড ইণ্ডিয়া’ উৎসবে পশ্চিম বাঙলার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী আব্দুল রজ্জাক মোল্লা যোগ দেন৷ তিনি এক আলোচনাচক্রে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের এ রাজ্যে তাঁদের পুঁজি বিনিয়োগের জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা পশ্চিমবঙ্গে পুঁজি বিনিয়োগ করলে একশ’ শতাংশ লাভের মুখ দেখতে পারবেন৷ পশ্চিম বাঙলা একপ্রকার সোণার খনি, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, আপনারা এখানে সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা পাবেন ইত্যাদি৷ তিনি জানান, পশ্চিম বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছেন৷ একই সুরে পশ্চিম বাঙলার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, কৃষি সচিব সঞ্জীব চোপরাও পুঁজিপতিদের আবেদন জানিয়েছেন৷ অনেকেই এই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন বলে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ জানানো হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগের তালিকায় আমেরিকার মত দেশও আছে৷ আছে দক্ষিণ কোরিয়া, মায়ানমার, নেদারল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশও৷ আমেরিকার পেপসিকো সংস্থা এ রাজ্যে তাদের ইয়ূনিট বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেও কৃতিত্বের সঙ্গে দাবী করা হচ্ছে৷

বলা বাহুল্য এ রাজ্যের বেকার সমস্যার সমাধানের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী সহ সমস্ত মন্ত্রীরাও দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের বিভিন্ন বণিক সভায় ও অন্যত্র সাদর আহ্বান জানাচ্ছেন৷ এদেশের প্রধানমন্ত্রীও দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের কাছে সদা-সর্বদা দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের স্বার্থে তাদের পুঁজি বিনিয়োগের আবেদন জানিয়ে চলেছেন৷ একই নীতি ছিল পশ্চিম বাঙলার বিগত বামফ্রণ্ট সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ সমস্ত মন্ত্রীদেরও৷ স্মর্তব্য যে সিঙ্গুরে রতন টাটাদের কারখানা গড়াকে কেন্দ্র করে ও নন্দীগ্রামে বিদেশী কোম্পানীর কারখানা গড়ার উদ্যোগকে কেন্দ্র করেই কিন্তু বামফ্রণ্ট সরকার বিরোধী আন্দোলনের উত্থান ও বামফ্রণ্ট সরকারের পতন হয়েছিল৷ তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷ সে সময় হয়ত ইসূ্যটা ঈষৎ অন্য ধরণের হলেও কারখানার জন্যে অনিচ্ছুক চাষীর জমি অধিগ্রহণটাই মুখ্য ইস্যু ছিল৷ যাইহোক, মূল ব্যাপারটা কিন্তু পুঁজিপতিদের নিয়ে এ রাজ্যে শিল্পায়ন৷ এ রাজ্যের তথা কেন্দ্রের নেতা-মন্ত্রীদের বদ্ধমূল ধারণা---পুঁজিপতি তোষণ ছাড়া, দেশী বিদেশী পুঁজিপতিদের কৃপা ছাড়া দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না ও দেশের বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানের এইটিই নাকি একমাত্র পথ৷ কিন্তু আজকের নেতা-মন্ত্রীদের বলি, ইতিহাস কী বলে? দেশ-বিদেশের বাস্তব চিত্র কী বলে? আমেরিকার পুঁজিপতিরা এদেশে একটু পুঁজি বিনিয়োগ করলে এদেশের বেকার সমস্যার সমাধান হবে বলে যাঁদের ধারণা তাঁদের বলি, খোদ আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট ও এর আগের প্রেসিডেণ্ট ওবামাও ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন---তাঁদের দেশের প্রধান সমস্যা বেকার সমস্যা আর এই বেকার সমস্যার সমাধান করাটাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷

বিশ্বের পঁুজিপতি শিরোমণিদের দেশ আমেরিকাতেই যদি বেকার সমস্যা তীব্র হয় তাহলে এই পুঁজিপতিদের পুঁজি বিনিয়োগের ফলে আমাদের দেশের বেকার সমস্যার সমাধান হবে---এটা ভাববার পেছনে কোনও যুক্তি আছে কী? পুঁজিপতিরা তাঁদের পুঁজি খাটায় মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে, শিল্পের মাধ্যমে সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে৷ যেমনটি একদা করেছিল ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী৷ তারা এদেশকে শোষণ করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে৷ রেজ্জাক মোল্লা কৃষির ক্ষেত্রেও ওই সব পুঁজিপতিদের দরাজ হস্তে পুঁজি বিনিয়োগের জন্যে সাদর আহ্বান জানাচ্ছেন৷ এইভাবে তাঁরা কি খাল কেটে কুমীর নিয়ে আসতে চান? ব্রিটিশ পুঁজিপতিরাও এইভাবে কৃষিতে নীল চাষে পুঁজি বিনিয়োগ করার পর নীল চাষীদের ওপর কীভাবে অত্যাচার চলেছিল---সে-সব ইতিহাস তিনি কী ভুলে গেছেন?

প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিদের শিল্পে অধিক থেকে অধিকতর পুঁজি বিনিয়োগের দ্বারা কোনদিন স্থায়ীভাবে দেশের বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে না৷ এতে অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ হবে না৷ বরং বৃদ্ধি পেতে থাকবে৷ পুঁজিপতিরা শিল্প গড়ে এদেশের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবে ও সম্পদের বহিঃস্রোত ঘটাবে৷ তাতে দেশ ক্রমশঃ নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে যাবে৷ ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ও তাদের শোষণের সহযোগী ব্রিটিশ শাসকরা যেমন করে এদেশকে ছিবড়াতে পরিণত করেছিল, একইভাবে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর চিরকালীন নীতিই হ’ল ‘শোষণ’৷ শোষণ নীতির দ্বারা কোনকালে জনগণের কল্যাণ হতে পারে না৷

তাহলে পথ কী? আগে নেতা-নেত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে৷ পুঁজিবাদের বেড়াজাল তথা মায়াজাল ছিন্ন করে জনগণের যথার্থ উন্নয়নের পথ খুঁজতে হবে৷ আর তা হ’ল সমবায়ের পথ৷ পুঁজি হ’ল প্রকৃতপক্ষে ভোগ্যপণ্যের অন্তর্নিহিত শক্তি৷ জনগণের সেই উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য তথা সম্পদ লুণ্ঠন করে এক শ্রেণীর লোভী মানুষ পুঁজিপতি হয়৷ এখন, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের সম্পদ লুণ্ঠিত হতে না দিয়ে একত্র সঞ্চিত করে নিজেদের অধিকার সংরক্ষিত করার মাধ্যম হ’ল সমবায়৷ তাই প্রয়োজন হ’ল জনগণকে নোতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে ব্যাপকভাবে উৎপাদক সমবায় ও উপভোক্তা সমবায় গড়ে তোলা৷ এর মাধ্যমেই দেশে কৃষির উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক শিল্পোন্নয়নও সম্ভব৷ আর এর দ্বারাই বেকার ও দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান সম্ভব৷