টেবীর খোঁপা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ক্রম্’ ধাতু+ ড+ কস্+ অচ=  ক্রকষ ৷  ‘ক্রকষ’  শব্দের অর্থ হল কোন কিছুকে সাজিয়ে গুজিয়ে আসর মাত করে দেওয়া--- কোন অসুন্দর জিনিসকে সাজানোর গুণে সুন্দর ক’রে  দেওয়া --- অভিনয়ের সময় গ্রীণরুমে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নানান বস্তুর সাহায্যে অনুপম করে সাজিয়ে দেওয়া৷ যে কালো কুচ্ছিৎ ভুতুম প্যাঁচার মত দেখতে তাকেও  রজতোজ্জ্বল শিবতুল্য করে তোলা, পেত্নী-শাঁকচুন্নীকে তিলোত্তমা করে গড়ে তোলা৷ আলোছায়ার খেলা দেখিয়ে কচুরিপানায় ভরা এঁদোপুকুরকে নীল মহোদধিতে পরিণত করে তোলা৷ এ সই ক্রকষ৷ ক্রকষের খেলা প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল৷

আমার এক বন্ধু ছিল--- নাম ছিল ৰুবাই৷ ৰুবাই-এর দিদির ডাক নাম ছিল টেৰী৷ ভাল নাম এখন মনে  পড়ছে না---সম্ভবতঃ অনিন্দিতা৷ ৰুৰাইয়ের দিদির তখন বিয়ের কথা চলছে৷ নানান দেশ থেকে ৰরপক্ষ আসছে কনের ইন্টারবিউ (উপস্থিত পরীক্ষা) নিতে৷ যাদের  কনে  পছন্দ হচ্ছে তাদের সঙ্গে পাওনা-গণ্ডায় দানে-খাঁইয়ে মিলছে না৷  যাদের পছন্দ হচ্ছে না, তারা বলে যাচ্ছে--- গিয়ে জানৰ......লিখে জানৰ৷ কন্যাপক্ষ এসব টেকনিক্যাল  ভাষার (প্রযুক্তিগত বাগ্বিন্যাস) মর্ম ৰোঝেন৷ গোড়ার দিকে তাঁরা থালা সাজিয়ে  ষোড়শোপাচারে পাত্রপক্ষকে আপ্যায়ন করতেন৷  শেষের দিকে সারতে লাগলেন একটা ছোট সাইজের রসগোল্লা, একটা তেকোণা নিমকি আর এক গ্লাস চা দিয়ে ৷ পাত্রী টেৰী গরমকালে ঘামে ভিজতে ভিজতে, আর শীতকালে ঠাণ্ডায় ঠক্ ঠক্ ক’রে কাঁপতে কাঁপতে ইন্টারবিউ দিয়ে  আসতে লাগল৷ পছন্দ অনেকেরই হ’ল৷ কিন্তু দেনাপাওনায় মিলল না৷ তাই কোন জায়গায় বিয়ে কেঁচে গেল, কোন জায়গায় হ’তে হ’তে ফস্কে গেল৷

একবার পাত্রপক্ষ এলেন ভাটপাড়া থেকে৷ তাঁদের আবার ভারী বায়নাক্কা৷ তাঁরা মেয়ের পা জলে ভিজিয়ে মেয়েকে হাঁটতে ললেন---পায়ের ছাপ দেখৰেন যে মেয়ে খড়ুমে-পা  কিনা অর্থাৎ পায়ের  সামনের দিকের ছাপ ও পেছনের  ছাপের মাঝে সংযোজক  ছাপ থাকছে কিনা৷ যদি থাকে তবে মেয়ে লক্ষ্মীশ্রী লে গণ্য হবে৷ যদি সংযোজক ছাপ না থাকে তবে সে মেয়ে অলক্ষ্মী  ৰলে গণ্য হৰে৷

সেদিন দেখলুম টেৰী প্রত্যেকটা পরীক্ষাতেই  লেটার মার্ক পেয়ে পাশ করে গেল কিন্তু বিপর্যয় দেখা গেল শেষ মুহূর্তটিতে৷ এই ইন্টারবিউয়ের কিছুদিন আগে টেৰী একবার গেছল মামার ৰাড়ী নদে জেলার মুড়াগাছায়৷ ওর মামা-মামীমার  সঙ্গে টেৰী ফিরে তো এল...সঙ্গে নিয়ে এল ওখানকার হাঁড়িভরা নামজাদা ছানার জিলিপি আর  কাঁচাগোল্লা৷ কিন্তু অজ্ঞাতসারে সঙ্গে করে নিয়ে এল হাড়-কাপানো মি -ওপচানো সেকালকার মালোয়ারী জ্বর, আজকাল যাকে শিক্ষিতরা ‘ম্যালেরিয়া  লে থাকেন৷

এককালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এই ম্যালেরিয়া  জ্বর প্রবল প্রতাপে  রাজত্ব করত৷ লোকে লক্ষ্য করে দেখলে যেখানে সাধারণতঃ ৰদ্ধ জলাশয় আছে সেখানেই এর প্রাদুর্র্ভব৷ ভারতে এই রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল কিছুটা পার্বত্য এলাকায়, তরাই অঞ্চলে ও  পূর্বভারতে৷ খুঁটিয়ে দেখে  আরও  নজরে পড়ল যেখানে  ৰড় ৰড়  জলাভূমি, লি,ৰাওড়, হাওড়, ৰাদা, জলা আছে সেখানেই এই রোগের প্রাদুর্র্ভব৷ রোগটি ব্যাপক আকারে দেখা দিত অসমে, বাঙলার ময়মনসিং জেলায়, রাজশাহী, যশোর, নদীয়া ও বর্দ্ধমানে৷ রোগটির  কোন ধা নাম গোড়ার দিকে ছিল না৷  সার্হেরা ভাবতেন খারাপ জলাভূমি এলাকায় রোগটি হয়৷ তাই নাম দিলেন  mal-areal-fever) অর্থাৎ খারাপ এলাকার জ্বর৷ পরবর্ত্তী কালু নামটি পালটে করে দেওয়া হল ম্যালেরিয়া ফিবার বা ম্যালেরিয়ার জ্বর৷  বাঙলা ভাষায় শব্দটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে করে দেওয়া হ’ল মালোয়ারী জ্বর৷ বর্ধমানের নামডাক যে কেবল চাষেতেই তা নয়৷

 এই ম্যালেরিয়া জ্বরেও বর্ধমান হয়ে উঠল সার সেরা৷  সেখানে ম্যালেরিয়া জ্বরের রাশ   নাম হল বর্ধমান জ্বর ৷ তোমরা  জান তো, বাঙলার প্রতিটি মানুষের তিনটি নাম৷ একটি হল তার ডাক নাম--- যে নাম ৰাড়ীতে পাড়াতে চলে৷ দ্বিতীয়টি  চলে  সুকলে-কলেজে-কোর্টে-কাছারীতে৷  সেটাকে আমরা বলি  ভাল নাম, উত্তর ভারতে লে শুভ নাম৷ তৃতীয় নামকে লে রাশি নাম বা রাশ নাম--- তা ঠিকুজি--কোষ্ঠীতে থেকে যায়৷ ব্যবহারে ড় একটা লাগে না৷ উত্তর ভারতে  লে থাকে---

‘‘এক এক  মিঞআ কা তীন তীন নাম

ফৈজু-ফৈজল-ফুজুল্ ইমাম্৷

তনীগো নুংগা দস্তরখান

তনীগো ঘোড় ৰাৰুর্চিখান’৷

সেকালের মহামান্য সরকার  ৰাহাদুর বর্দ্ধমানে এক নামজাদা ৰিলিতি ডাক্তার পাঠিয়েছিলেন এই রোগের সঙ্গে যথাযথভাবে পঞ্জা লড়ার জন্যে৷ চিকিৎসক অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন প্রচুর৷ কিন্তু ম্যালেরিয়াকে শাঈস্তা করা তো দূরের কথা,  বর্দ্ধমান জ্বরকে কায়দায় আনতেই পারলেন না৷

হ্যাঁ,বাঙলায় যেখানে ছিল মজা নদী বা হাওড় বা ৰিল  ৰেশী, সেখানেই রোগটি ৰেশী ছড়িয়েছিল৷ দামোদরে বাঁধ দেওয়ার ফলে দামোদরের শাখানদীগুলি  মজে গিয়ে মশার জন্মপীঠে পরিণত  হয়েছিল৷ সেজন্যে বর্দ্ধমান হয়েছিল ম্যালেরিয়ার---ডিপো মজে গেছল খড়িনদী, বাঁকা নদী, গাঙ্গুড়, নদী বেহুলা, কানা নদী, কানা-দামোদর সাই৷ ঠিক তেমনি পদ্মার পূর্ৰাভিমুখী গতির ফলে মজে গেছল ভাগীরথী, জলঙ্গী, খড়ে ,ভৈরব, নবগঙ্গা, কুমার , চিত্রা প্রভৃতি--- মজে গেছল গড়াই, মধুমতী, আড়িয়লখাঁ, পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, ফুলেশ্বরী--- মজেছিল আত্রাই, গড়ল , হুড়া সমুদ্র (হুড়া সাগর)৷ তারই  ফলশ্রুতিতে উৎসন্নে গেল নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর, দ্ধমান ও রাজশাহী৷ সুতরাং  বর্দ্ধমান মালোয়ারিতে সেরা হলেও  এটা তার গায়ে-লাগোয়া প্রতিবেশী নদীয়া সহ্য করবে কেন মুখবুজে৷ তার ভাগীরথী মজেছে, খড়ে মজেছে, মাথাভাঙ্গা-ইচ্ছামতী মজেছে...মজেছে, অঞ্জনা, কঙ্কনা, বুড়িগঙ্গা, মুড়িগঙ্গা, যমুনা, ভৈরব, কুমার, গড়াই, পাগলাচণ্ডী৷ ভাগ্যিস তখন চুর্ণী নদীটা ছিল  না৷  থাকলে হয়তো সেও মজতো--- নদীয়াকে একেবারে ধনে-প্রাণে মজাতো৷ তাই মালোয়ারিতে সেও বর্দ্ধমান কে টেক্কা দিতে শুরু করলে৷  কেষ্ নগর শহরে সূর্র্যেদয় থেকে  সূর্র্যস্ত পর্যন্ত আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে একটি ধবনিই উত্থিত হচ্ছিল---‘‘বল হরি, হরি বোল’’৷

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)