আগেকার দিনে সব নানান ধরণের ঝাড়-ফঁুক, তুক-তাক, ডাকিনীতন্ত্র, যক্ষিণীতন্ত্র, যোগিনীতন্ত্র ইত্যাদির নাম দিয়ে নানান জিনিসের চর্র্চ চলত৷ জিনিসগুলো ভাল কি মন্দ তা নিয়ে আলোচনার সময় এটা নয়৷ তবে ওই সব জিনিসগুলির মানব সমাজে তেমন কোন কল্যাণ করতে পারিনি৷ ডাকিনী-ডাইনি৷ শোণা যায় ডাকিনীতন্ত্রে প্রতিষ্টিত হতে গেলে মেয়েদের নাকি প্রথমেই ওই বিদ্যাপ্রয়োগ করে নিজের স্বামী অথবা পুত্রকে হত্যা করতে হয়৷ তবেই এই তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করা যায়৷ সেই জন্যে ডাইনীরা ছিল সর্বকালে ঘৃণ্য৷ তবে ডাইনী ভেবে অনেক নিরপরাধ মেয়েদের ওপরও অত্যাচারও চলত ....আজও হয়তো চলে৷ তবে ডাইনী যে আজও সমাজে একেবারেই নেই তা বলছি না ৷ মেয়েদের মধ্যে একটা ছড়াই আছে ‘‘জনম গেল ছেলে খেয়ে/ আজ বলে ডাইনী’’৷ অর্র্থৎ আমি কি আজকের ডাইনী গো! আমি এতকাল অনেক ছেলেকে খেয়েছি, এতদিন পরে তোমরা আমাকে ধরছ ডাইনী বলে’৷
ভুত নাবানো, প্রেত নাবানো, যক্ষ-যক্ষিণী নাবানো, বাড়িতে ইঁট ফেলানো, হাড় ফেলানো--- এগুলি সমস্তই ডাকিনীতন্ত্র..... তুক-তাকের কাজ৷ এখনও ক্কচিৎ কখনো খবরের কাগজে দেখবে , ‘‘অমুক বাড়িতে ক্রমান্বয়ে হাড় পড়ছে, অমুক বাড়ীতে ইঁট পড়ছে৷’’--- এগুলিও অবিদ্যা তন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ--- এক কথায় অভিচার ক্রিয়া৷ এই অভিচার ক্রিয়া যখন সামাজিকতার বিরুদ্ধে চলে যায় যেমন ঘুষ নেওয়া, পাপকে সমর্থন করা, পাপীর স্বভাব সংশোধনের পূর্বে তাকে ক্ষমা করা--- এগুলোকে বলে ব্যভিচার (বি---অভি---চর্ ঘঞ্)৷ তুকতাকের কথা বলতে গিয়ে একটা গল্প মনে পড়ল৷ থাকতুম তখন রংপুরে৷ শহরের কাছ দিয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে তার নাম সম্ভবতঃ ধরলা৷ বর্র্ষ ছাড়া অন্যসময়ে নদীটির তেমন কোন পরাক্রম দেখা যেত না৷
একদিন সন্ধ্যে হয় হয়৷ নিয়মমাফিক বেড়িয়ে সেই মাত্র ফিরেছি৷ পাশের বাড়ীর গবা (সুস্নাত ভট্টাচার্য) আমাকে বললে --- ওই যে লোকটাকে দেখছেন.... ওই মাঝারি চেহারা, ঝতে পারছেন রংটা মেটে মেটে, ভালভাবে লক্ষ্য করলে মনে হয় পিছনের দিকের চুলগুলি একটু বড় বড় ওটা টিকি বা ঝঁুটি নয়, পেছনের দিকে চুলগুলো ও একটু ড় ড় রেখে থাকে৷ হ্যাঁ, বেশীরভাগ সময় ছাই রঙের প্যাণ্ট পরে, আজও পরে রয়েছে৷
তখন সন্ধ্যে হয় হয়৷ তাই গবার বর্ণনার সঙ্গে আমি ঠিকভাবে মিলিয়ে নিতে পারলুম না৷ ৷ জিজ্ঞেস করলুম ---গবা ওর পুরো নামটা কী?
গা বললে --- জোসেফ অনিল কুমার ভৌমিক৷
আমি ললুম--- ও করে কী?
গা বললে---ও নানান ধরণের তুকগুণ জানে৷
আমি ললুম---গুণ!
গা বললে---হ্যাঁ, ওই যে কীসব অবিদ্যা তন্ত্র-টন্ত্র হয় না, তারই একটা নাম গুণ, কেউ কেউ বলে তুক্গুণ আর এ সব ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ তাদেরও লা হয় গুণী৷
আমি বললুম--- এগুণের সঙ্গে সত্ত্ব-রজঃ-তমোগুণের কোন সম্পর্ক আছে নাকি রে?
গা এক গাল হেসে ললে--- না, না, জিনিসটা লোক ঠকানো কিনা বলতে পারছি না, তবে লোকে মানে.... ভয় পায়৷ ভূত ছাড়ানো, ভূতে ধরানো, বাটি চালানো, আরো কত কী ও জানে!৷ ভূত নর্াাতেও নাকি পারে!
আমি ললুম--- তাই নাকি !
গা বললে--- আপনার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দোব৷
আমি ললুম--- না, ওর গুণের কথা শুণেই আমার ভয় করছে, গা শির্শির্ করছে...গায়ে কাঁটা দিচ্ছে৷ আমি দূরে থেকেই নমস্কার জানাচ্ছি৷
গা আরো একটু হাসল৷ হেসে বললে--- না, আপনার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেবো৷ আগে তো ওকে বলে রাখব যাতে ও আপনার সামনে কোনো তুকগুণ না করে৷
গবার সঙ্গে আর বেশী কথা হয়নি৷
খেয়েদের রাত্রিতে শুয়ে পড়লুম৷ খাটের পাশে আমার মাথার কাছে ছিলএকটা জলভর্ত্তি কঁুজো৷ তখন রংপুরের জলের বিশেষ প্রশংসা ছিল না৷ আমি আলাদা করে ফিল্টার করা জল ব্যবহার করতুম৷ থাকত ওই কঁুজোতেই৷
শুলুম তো ঠিক সময়েই কিন্তু পোড়ার চোখে ঘুম আর আসেই না৷ ডান পাশ, বাঁ পাশ, এপাশ, ওপাশ .... কেবল পাশেরই খেলা.... একবারও ফেল নয়৷ হঠাৎ একটা হালকা তন্দ্রা নেবে এল৷ ভাবলুম---যাক, তারিয়ে নাক ডাকানো যাবে, চুটিয়ে ঘুমানো যাবে৷
মাঝরাতে কেমন যেন একটা কী হয়ে গেল! হঠাৎ দেখলুম আমার বাঁ পাশের কুঁজোটার কাছেই শূন্যে ভাসমান একটি মুখ৷ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকেই, নজরটা কটমটে৷
আমি ললুম--- কে তুমি বাছাধন এত রাত্তিরে বিরক্ত করতে এসেছে! তোমার কি আর কাজকম্ম কোন কিছু নেই! মুণ্ডুটা অর্র্থৎ মুখটা ললে--- মুই তোক্ খাম৷
আমি ললুম --- মোক্?
মুণ্ডুকে ললুম--- তোর শরীর লতে তো কেবল মুখটা! মুখ দিয়ে আমায় খাবি আর তোর গলা দিয়ে আমি বেরিয়ে আসব৷ তাতে তোর লাভটা কী হর্ে?
মুণ্ডু ললে--- ভয় দেখাতে এসেছি৷
আমি ললুম--- এ কীরকম বিটকেল মানসিকতা! শেষে খিটকেলের একশেষ হবে৷ আমার সঙ্গে লেগে তুই পার পাবি!
সে হাঃ হাঃ করে হাসল৷ ঘরের চারিপাশ কেঁপে উঠল৷ আমি মারলুম এক লাথি৷ মুণ্ডুটি আবার নীচে নেবে এল--- ঠিক আগের বারের যেখানে ছিল সেই খানে নেবে এল৷ সে ললে--- তুই ভয় পাচ্ছিস না?
আমি ললুম--- না
সে ললে--- তোর খাটটা আমি ওপরের ছাতের দিকে তুলে দের্া৷
আমি ললুম--- ওসব করে তোর লাভ কী হবে!
সে ললে --- একটু ভয় দেখানো হবে৷
আমি ললুম--- তবে রে.... এখন একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, তুই বড় গুণী না আমি বড় গুণী৷ তোর গুণের সঙ্গে আমার হাতের গুণের পরীক্ষা হোক৷
আমি খাট থেকে উঠে তার টিকিটা ধরে জোরে তার মুণ্ডুটা ঘোরাতে লাগলুম ......বোঁ..বোঁ...বোঁ..শোঁ... শোঁ...শোঁ৷ তারপর মুণ্ডুটা ছঁুড়ে ফেলে দিলুম জানালা দিয়ে ঘরের বাইরের দিকে৷
মুণ্ডুটা আর ফিরল না৷ হাতে কঠিন কোন কিছুর স্পর্শ পেলুম৷ ঠাহর করে দেখি মুণ্ডুটা ছঁুড়তে গিয়ে আমি হাতে করে জোরে একটা ঘুষি চালিয়েছি কঁুজোটার ওপর৷ কঁুজোটা ভেঙ্গে ফুটিফাটা৷ ঘরময় জল...জল৷ যে মুঠোটা দিয়ে মুণ্ডুটার টিকিটা ধরেছিলাম একবার মনে হল হাতে যেন টিকিটা লেগে রয়েছে৷ তার সঙ্গে কিছুটা রক্তও৷ আরেকবার ভাল করে তাকালুম৷ দেখলুম টিকিও নেই, রক্তও নেই, তবে কোন কিছু যে ধরেছিলুম তার প্রমাণ স্বরূপ হাতে একটা হালকা ব্যাথা রয়েছে৷ যদ্দুর সম্ভব মনে হয় জিনিসটা ঘটেছিল স্বপ্ণে৷ প্রশ্ণ জাগল---ঠিক কি স্বপ্ণ? না, সেটা ছিল জেগে থাকার অবস্থা? না, সেটা ছিল না-জাগা না ঘুমানো অবস্থা?
ঘরটার মধ্যে কেমন একটা অস্বাভাবিক ভাব! কেমন যেন একটা খাঁ....খাঁ.... কেমন যেন একটা অশরীরী ফিসফাস! না, চারিদিকে তাকালুম, ঘরের কোণগুলো তন্নতন্ন করে দেখলুম কেউই নেই৷ রয়েছি আমি আর রয়েছে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ফুটিফাটা সেই কঁুজোটা৷
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গবাকে ডেকে পাঠালুম৷ ললুম--- গা, চল তো একটু নদীর দিকে৷
গবা বললে--- এ সময় তো ওদিকে কেউ থাকে না৷
আমি ললুম--- এমনি একটু যেতে চাই৷ আমি তো পথঘাট চিনি না৷ তুই চিনিস, তাই৷
গা ললে--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তবে দু’জনে দুটো লাঠি হাতে নিয়ে নি’৷
গার সঙ্গে গেলুম! শহর থেকে শে কিছুটা দূরে৷
জায়গাটা ঠিক শ্মশান নয়, তবে মনে হয় সূদূর অতীতে শ্মশান ছিল৷
জায়গাটার একটু কাছাকাছি এলুম৷ গা বললে--- একটা মৃতদেহ রয়েছে না!
আমি ললুম--- তাই তো মনে হচ্ছে৷
দু’জনে তার কাছাকাছি গেলুম৷
আমি ললুম--- মৃতদেহ নয়.... হাতটা নড়ছে...একটা পা-ও সময় সময় ছঁুড়ছে....নাড়ছে৷
আরো একটু কাছে গিয়ে গবা ললে--- এই সেই জোসেফ.... কাল রাত্তিরে যার কথা বলছিলুম৷ রাতে ওর বাড়ীতে গিয়ে আমাদের মধ্যে যে কথাবার্র্ত হয়েছিল তা-ও ওকে লেছিলুম৷
সে লেছিল --- শুণলুম.... ভাল, ভাল৷
আরেকটু কাছে গেলুম৷ লোকটা তখন হয় অচেতন,না হয় অর্ধচেতন৷ মুখটা দেখে অবাক হয়ে গেলুম৷ রাত্তিরে সেই ঘটনায় যে মুখটা দেখেছিলুম এটা হুবহু সেই মুখ৷
গাকে ললুম--- একটু টিকির কাছটা দেখ তো!
দেখা গেল টিকির কাছে একগোছ চুল কে যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে৷ সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে দরদরিয়ে রক্ত৷
সেই রক্তপাতের ফলেই এ অচৈতন্য বা অর্ধ-চৈতন্য হয়ে রয়েছে৷
আমরা তাকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে পৌঁছে দিলুম৷
এটা কি সেই তুক্ গুণ! তর্ে কি এরও নাম গুণ?
আমার কথাটি ফুরোল/ নটে গাছটি মুড়োল?
শব্দ চয়নিকা ২৪/১০৮