তুক্গুণ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আগেকার দিনে  সব নানান ধরণের ঝাড়-ফঁুক, তুক-তাক, ডাকিনীতন্ত্র, যক্ষিণীতন্ত্র, যোগিনীতন্ত্র ইত্যাদির নাম দিয়ে নানান জিনিসের চর্র্চ চলত৷ জিনিসগুলো ভাল কি মন্দ তা নিয়ে আলোচনার  সময় এটা নয়৷ তবে ওই সব জিনিসগুলির মানব সমাজে তেমন কোন কল্যাণ করতে পারিনি৷ ডাকিনী-ডাইনি৷ শোণা যায়  ডাকিনীতন্ত্রে প্রতিষ্টিত হতে গেলে মেয়েদের নাকি প্রথমেই  ওই বিদ্যাপ্রয়োগ করে নিজের স্বামী  অথবা পুত্রকে হত্যা করতে হয়৷  তবেই এই তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ  করা যায়৷ সেই জন্যে ডাইনীরা ছিল সর্বকালে ঘৃণ্য৷ তবে ডাইনী ভেবে অনেক নিরপরাধ মেয়েদের ওপরও অত্যাচারও চলত ....আজও হয়তো চলে৷ তবে ডাইনী যে আজও সমাজে একেবারেই  নেই তা বলছি না ৷ মেয়েদের মধ্যে একটা ছড়াই আছে ‘‘জনম গেল ছেলে খেয়ে/ আজ বলে ডাইনী’’৷ অর্র্থৎ আমি কি আজকের ডাইনী গো! আমি এতকাল অনেক ছেলেকে খেয়েছি, এতদিন পরে তোমরা আমাকে ধরছ ডাইনী বলে’৷

ভুত নাবানো, প্রেত নাবানো, যক্ষ-যক্ষিণী নাবানো, বাড়িতে ইঁট ফেলানো, হাড় ফেলানো--- এগুলি সমস্তই ডাকিনীতন্ত্র..... তুক-তাকের কাজ৷ এখনও ক্কচিৎ কখনো খবরের কাগজে দেখবে , ‘‘অমুক বাড়িতে ক্রমান্বয়ে হাড় পড়ছে, অমুক বাড়ীতে ইঁট পড়ছে৷’’--- এগুলিও অবিদ্যা তন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ--- এক কথায় অভিচার ক্রিয়া৷ এই অভিচার ক্রিয়া যখন সামাজিকতার বিরুদ্ধে চলে যায় যেমন ঘুষ নেওয়া, পাপকে সমর্থন করা, পাপীর স্বভাব সংশোধনের পূর্বে  তাকে ক্ষমা করা--- এগুলোকে বলে ব্যভিচার (বি---অভি---চর্ ঘঞ্)৷ তুকতাকের কথা বলতে গিয়ে  একটা গল্প মনে পড়ল৷ থাকতুম তখন রংপুরে৷ শহরের কাছ দিয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে তার নাম সম্ভবতঃ ধরলা৷  বর্র্ষ ছাড়া অন্যসময়ে নদীটির তেমন কোন পরাক্রম দেখা যেত না৷

একদিন সন্ধ্যে হয় হয়৷ নিয়মমাফিক বেড়িয়ে সেই মাত্র ফিরেছি৷ পাশের  বাড়ীর গবা (সুস্নাত ভট্টাচার্য) আমাকে  বললে --- ওই যে লোকটাকে দেখছেন.... ওই মাঝারি চেহারা, ঝতে পারছেন রংটা মেটে মেটে, ভালভাবে লক্ষ্য করলে মনে হয় পিছনের দিকের চুলগুলি একটু বড় বড়  ওটা টিকি বা ঝঁুটি নয়, পেছনের দিকে চুলগুলো  ও একটু ড় ড় রেখে থাকে৷ হ্যাঁ, বেশীরভাগ সময় ছাই রঙের  প্যাণ্ট  পরে, আজও পরে রয়েছে৷

তখন সন্ধ্যে হয় হয়৷  তাই গবার বর্ণনার সঙ্গে আমি ঠিকভাবে মিলিয়ে নিতে পারলুম না৷ ৷ জিজ্ঞেস করলুম ---গবা ওর পুরো নামটা কী?

গা বললে --- জোসেফ অনিল কুমার ভৌমিক৷

আমি ললুম--- ও করে কী?

গা বললে---ও নানান  ধরণের তুকগুণ জানে৷

আমি ললুম---গুণ!

গা বললে---হ্যাঁ, ওই যে কীসব অবিদ্যা তন্ত্র-টন্ত্র হয় না, তারই একটা নাম গুণ, কেউ কেউ বলে তুক্গুণ আর এ সব ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ তাদেরও লা হয় গুণী৷

আমি বললুম--- এগুণের  সঙ্গে সত্ত্ব-রজঃ-তমোগুণের কোন  সম্পর্ক আছে নাকি রে?

গা এক গাল হেসে ললে--- না, না, জিনিসটা লোক ঠকানো কিনা বলতে পারছি না,  তবে লোকে  মানে.... ভয় পায়৷ ভূত ছাড়ানো, ভূতে ধরানো, বাটি চালানো, আরো কত কী ও জানে!৷ ভূত নর্াাতেও নাকি পারে!

আমি ললুম--- তাই নাকি !

গা বললে--- আপনার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দোব৷

আমি ললুম--- না, ওর গুণের কথা শুণেই আমার ভয় করছে, গা শির্শির্ করছে...গায়ে কাঁটা দিচ্ছে৷ আমি দূরে থেকেই নমস্কার জানাচ্ছি৷

গা আরো একটু হাসল৷ হেসে বললে--- না, আপনার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেবো৷ আগে তো ওকে বলে রাখব যাতে ও আপনার সামনে কোনো তুকগুণ না করে৷

গবার সঙ্গে আর বেশী কথা হয়নি৷

খেয়েদের রাত্রিতে শুয়ে পড়লুম৷ খাটের পাশে আমার মাথার কাছে ছিলএকটা জলভর্ত্তি  কঁুজো৷ তখন রংপুরের জলের বিশেষ প্রশংসা ছিল না৷ আমি আলাদা করে ফিল্টার  করা জল ব্যবহার করতুম৷ থাকত ওই কঁুজোতেই৷

শুলুম তো ঠিক সময়েই  কিন্তু পোড়ার চোখে  ঘুম আর আসেই না৷ ডান পাশ, বাঁ পাশ, এপাশ, ওপাশ .... কেবল পাশেরই খেলা.... একবারও ফেল নয়৷ হঠাৎ একটা  হালকা তন্দ্রা  নেবে এল৷ ভাবলুম---যাক, তারিয়ে নাক ডাকানো যাবে, চুটিয়ে  ঘুমানো যাবে৷

মাঝরাতে কেমন যেন  একটা কী হয়ে গেল! হঠাৎ দেখলুম আমার বাঁ পাশের কুঁজোটার  কাছেই শূন্যে  ভাসমান  একটি মুখ৷ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকেই, নজরটা কটমটে৷

আমি ললুম--- কে তুমি  বাছাধন এত রাত্তিরে  বিরক্ত করতে এসেছে!  তোমার  কি আর কাজকম্ম কোন কিছু  নেই! মুণ্ডুটা অর্র্থৎ মুখটা ললে--- মুই তোক্ খাম৷

আমি ললুম --- মোক্?

মুণ্ডুকে ললুম--- তোর শরীর লতে তো কেবল মুখটা! মুখ দিয়ে আমায় খাবি  আর  তোর গলা দিয়ে আমি বেরিয়ে আসব৷  তাতে তোর লাভটা কী হর্ে?

মুণ্ডু ললে--- ভয় দেখাতে এসেছি৷

আমি ললুম--- এ কীরকম বিটকেল মানসিকতা! শেষে খিটকেলের একশেষ হবে৷  আমার সঙ্গে লেগে তুই পার পাবি!

সে হাঃ হাঃ করে হাসল৷  ঘরের চারিপাশ কেঁপে উঠল৷ আমি মারলুম  এক লাথি৷ মুণ্ডুটি আবার নীচে নেবে এল--- ঠিক আগের বারের যেখানে  ছিল সেই খানে  নেবে এল৷ সে ললে--- তুই ভয় পাচ্ছিস না?

আমি ললুম--- না

সে ললে--- তোর খাটটা আমি ওপরের ছাতের দিকে তুলে দের্া৷

আমি ললুম--- ওসব করে তোর লাভ কী হবে!

সে ললে --- একটু ভয় দেখানো হবে৷

আমি ললুম--- তবে রে.... এখন একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, তুই বড় গুণী না আমি বড় গুণী৷ তোর গুণের  সঙ্গে আমার হাতের গুণের পরীক্ষা হোক৷

আমি খাট থেকে উঠে তার টিকিটা ধরে জোরে তার মুণ্ডুটা ঘোরাতে  লাগলুম ......বোঁ..বোঁ...বোঁ..শোঁ... শোঁ...শোঁ৷ তারপর মুণ্ডুটা ছঁুড়ে ফেলে দিলুম জানালা দিয়ে ঘরের বাইরের দিকে৷

মুণ্ডুটা আর ফিরল না৷ হাতে কঠিন কোন কিছুর স্পর্শ পেলুম৷ ঠাহর করে দেখি মুণ্ডুটা ছঁুড়তে গিয়ে আমি হাতে করে জোরে একটা ঘুষি চালিয়েছি কঁুজোটার ওপর৷ কঁুজোটা ভেঙ্গে ফুটিফাটা৷ ঘরময় জল...জল৷  যে মুঠোটা দিয়ে মুণ্ডুটার টিকিটা ধরেছিলাম একবার মনে হল হাতে যেন টিকিটা লেগে রয়েছে৷ তার সঙ্গে কিছুটা রক্তও৷ আরেকবার ভাল করে তাকালুম৷ দেখলুম টিকিও নেই, রক্তও নেই, তবে কোন কিছু যে ধরেছিলুম তার প্রমাণ স্বরূপ হাতে একটা হালকা ব্যাথা রয়েছে৷ যদ্দুর সম্ভব মনে হয় জিনিসটা ঘটেছিল স্বপ্ণে৷ প্রশ্ণ জাগল---ঠিক  কি স্বপ্ণ? না, সেটা ছিল জেগে থাকার অবস্থা? না, সেটা ছিল না-জাগা না ঘুমানো অবস্থা?

ঘরটার মধ্যে কেমন একটা অস্বাভাবিক ভাব! কেমন যেন একটা খাঁ....খাঁ.... কেমন যেন একটা অশরীরী ফিসফাস! না, চারিদিকে তাকালুম, ঘরের কোণগুলো তন্নতন্ন করে দেখলুম কেউই নেই৷ রয়েছি আমি আর রয়েছে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া ফুটিফাটা সেই কঁুজোটা৷

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই  গবাকে ডেকে পাঠালুম৷ ললুম--- গা, চল তো একটু নদীর দিকে৷

গবা বললে--- এ সময় তো ওদিকে কেউ থাকে না৷

আমি ললুম--- এমনি একটু যেতে চাই৷ আমি তো পথঘাট চিনি না৷ তুই চিনিস, তাই৷

গা ললে--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তবে দু’জনে দুটো লাঠি হাতে নিয়ে নি’৷

গার সঙ্গে গেলুম! শহর থেকে শে কিছুটা দূরে৷

জায়গাটা ঠিক শ্মশান নয়, তবে মনে হয় সূদূর অতীতে শ্মশান ছিল৷

জায়গাটার একটু কাছাকাছি এলুম৷ গা বললে--- একটা মৃতদেহ রয়েছে না!

আমি ললুম--- তাই তো মনে হচ্ছে৷

দু’জনে তার কাছাকাছি গেলুম৷

আমি ললুম--- মৃতদেহ নয়.... হাতটা নড়ছে...একটা পা-ও সময় সময় ছঁুড়ছে....নাড়ছে৷

আরো একটু কাছে গিয়ে গবা ললে--- এই সেই জোসেফ.... কাল রাত্তিরে যার কথা বলছিলুম৷ রাতে ওর বাড়ীতে গিয়ে আমাদের মধ্যে যে কথাবার্র্ত হয়েছিল তা-ও ওকে  লেছিলুম৷

সে লেছিল --- শুণলুম.... ভাল, ভাল৷

আরেকটু কাছে গেলুম৷ লোকটা তখন হয় অচেতন,না হয় অর্ধচেতন৷ মুখটা দেখে অবাক হয়ে গেলুম৷ রাত্তিরে সেই ঘটনায় যে মুখটা দেখেছিলুম এটা হুবহু সেই মুখ৷

গাকে  ললুম--- একটু টিকির কাছটা দেখ তো!

দেখা গেল টিকির কাছে  একগোছ চুল কে যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে৷ সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে দরদরিয়ে রক্ত৷

সেই রক্তপাতের ফলেই এ অচৈতন্য বা অর্ধ-চৈতন্য হয়ে রয়েছে৷

আমরা তাকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে পৌঁছে দিলুম৷

এটা কি সেই তুক্ গুণ! তর্ে কি এরও নাম গুণ?

আমার কথাটি ফুরোল/ নটে গাছটি মুড়োল?    

 

উৎস

শব্দ চয়নিকা ২৪/১০৮