লক্ষণ ঃ ঘন ঘন মূত্রত্যাগের ইচ্ছা, মূত্রনালীতে জ্বালা, ঘন ঘন পিপাসা ও মুখে মিষ্টি স্বাদ, পেশাবে মাছি বা পিঁপড়ে বসা, মাথা ধরা, চর্ম শুস্ক্ ও ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অল্প বয়সে চেহারা বৃদ্ধের মত হয়ে যাওয়া, সর্বাঙ্গে জ্বালাপোড়া প্রভৃতি লক্ষণের সমাবেশই এই রোগের লক্ষণ৷ প্রায়ই দেখা যায় এই রোগে চোখে ছানি পড়ে৷
কারণ ঃ বহুমূত্র রোগে মূত্রে যে শর্করা থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই৷ শর্করাযুক্ত বহুমূত্র রোগকে ‘সোমরোগ’ বা ‘মধুমেহ’ বলা হয়৷ শর্করাবিহীন বহুমূত্রকে ‘মূত্রাতিসার’ বা ‘উদকমেহ’ বলা হয়৷ মণিপুর চক্রের দুর্বলতাই এই রোগের কারণ৷ অগ্ণ্যাশয়–নিঃসৃত রসসমূহের একটি ধারা খাদ্যবস্তুকে জীর্ণ করতে সাহায্য করে, অপর একটি ধারা আমিষ ও শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যসমূহ থেকে শর্করা অংশকে পৃথক করে৷ওই শর্করা যকৃতের অংশবিশেষে সঞ্চিত থাকে ও প্রয়োজন মত দগ্ধ হয়ে শরীরকে উত্তাপ ও জীবনীশক্তি সরবরাহ করে থাকে৷ দীর্ঘদিনের অজীর্ণ, কোষ্ঠবদ্ধতা (সাধারণতঃ এতেও মল গুটলে গুটলে হয়ে থাকে), মানসিক শ্রম ও শারীরিক শ্রমের অভাব, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার বা অতিমাত্রায় শুক্রক্ষয়ের ফলে যকৃৎ দুর্বল হয়ে পড়লে এই শর্করা যকৃতে স্থানলাভ করতে পারে না ও তা ক্রমশঃ রক্তে গিয়ে জমতে থাকে আর তার ফলে রক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতাও অসম্ভব কমে যায়৷ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সেই সময় রক্তকে পরিষ্কার করার জন্যে রক্ত থেকে শর্করা অংশকে পৃথক করে দিতে চায় ও ওই শর্করা মূত্রের সঙ্গে দেহ থেকে নিঃসারিত হতে থাকে৷ শর্করাকে তরল অবস্থায় রাখবার জন্যে দেহে জলের প্রয়োজন হয়ে থাকে৷ তাই রোগী ঘন ঘন পিপাসা বোধ করে৷ মূত্রের সঙ্গে ব্যাপকভাবে শর্করা বহির্গত হয়ে যাওয়ায় রোগীর জীবনীশক্তি ক্রমশঃ কমে আসে৷
চিকিৎসা ঃ
প্রাতে ঃ উৎক্ষেপনমুদ্রা, কর্মাসন, অগ্ণিসার, উপবিষ্ট উড্ডয়ন, জানুশিরাসন, আগ্ণেয়ীমুদ্রা বা আগ্ণেয়ী প্রাণায়াম৷
সন্ধ্যায় ঃ যোগমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, ভূজঙ্গাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, ভস্ত্রিকাসন ও অগ্ণিসার৷
পথ্য ঃ বহুমূত্র রোগটি মূলতঃ অগ্ণ্যাশয় ও যকৃতেরই ব্যাধি৷ তাই এতে অগ্ণ্যাশয় ও যকৃতের সুস্থতার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে ও কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে অথচ পুষ্টিকর ও সহজে জীর্ণ হয় এইরূপ খাদ্যই রোগীকে গ্রহণ করতে হবে৷ সব রকমের ফলই এই রোগে সুপথ্য, বিশেষ করে পাকা কলা অত্যন্ত উপকারী৷ রোগীর পক্ষে আমিষখাদ্য অবশ্যই পরিত্যাজ্য৷ নিরামিষ প্রোটিনও অম্লধর্মী, তাই তার পরিমাণও যতদূর সম্ভব কমিয়ে ফেলা দরকার৷ সেজন্যে ভাত বা রুটি কম করে খেয়ে তরিতরকারীর ঝোল, কাঁচা কলার ঝোল, পটোল, ঢেঁড়স, ধুন্দুল, পলতা, লাউ, থোড়, মোচা, ডুমুর প্রভৃতি ক্ষারধর্মী খাদ্য অধিক পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত৷
বিধিনিষেধ ঃ বহুমূত্র রোগটি বুদ্ধিজীবীদের রোগ৷ যারা শারীরিক পরিশ্রম করে এ রোগ তাদের মধ্যে কচিৎ দেখা যায়৷ মস্তিষ্কের পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে অধিক পরিমাণে ঘরের মধ্যে থাকা, শারীরিক অলসতা, কোষ্ঠবদ্ধতা, অসংযম প্রভৃতি বিভিন্ন কারণেই রোগটিকে উৎপন্ন করে৷ আগেই বলা হয়েছে, রোগটি মূলতঃ অগ্ণ্যাশয় ও যকৃতের৷ তাই যে সকল খাদ্য ওই সকল গ্রন্থিকে বেশী উত্তেজিত বা অতিক্রিয় করে না, সেই সকল খাদ্যই গ্রহণ করা উচিত আর যে সকল কার্য ওই গ্রন্থিগুলিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে সেই সকল কার্যই অধিক পরিমাণে করা উচিত৷ যে শারীরিক শ্রমে বিমুখ তার বহুমূত্ররোগ সারা সম্ভব নয়৷ শরীরে আমিষ জাতীয় বা শ্বেতসার খাদ্যের প্রয়োজনও রয়েছে৷ তাই তাদের মধ্যে যেগুলি অম্লধর্মী নয়–ক্ষারধর্মী, সেগুলির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে রোগীর উচিত তার আমিষ ও শ্বেতসারের প্রয়োজন মিটিয়ে নেওয়া৷ এই জন্যে নারকোল, চীনে বাদাম (বিনা চীনীতে অল্প মধুসহ বা বিনা মধুতে বাদামের সরবত এই রোগে আহার–ঔষধ দুই–ই), দই , কলা প্রভৃতি অধিক পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত৷ মনে রাখা উচিত ‘ইনসুলিন’ ঢুব্দব্ভপ্তনুগ্গ প্রয়োগে এই রোগে রোগীর জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভবপর হলেও রোগারোগ্য সম্ভব নয়৷ সাধারণতঃ এই রোগী একটু লোভী হয়ে থাকে৷ তাই কখনও কখনও অত্যাধিক শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করার ফলে এই রোগ ফুটে ওঠে৷ রোগীকে লোভ সংবরণ করতে হবে ও উপবাস অভ্যাস করতে হবে৷
রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থায় নেবুর রস বা সামান্য ফলের রস সহ স–ম্বু উপবাস এক টানা দু’তিন দিন ধরে দিলে পেসাবে শর্করার মাত্রা খুবই কমে যায়৷ কখনও কখনও তাতে শর্করা পাওয়াই যায় না৷ এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে মূত্রাশয় বা দেহাভান্তরস্থ কোন কোন গ্রন্থিতে আঘাত লাগলেও সাময়িকভাবে মূত্রে শর্করা পাওয়া যায়৷ এই ধরণের ক্ষেত্রে ভুলক্রমে ‘ইনসুলিন’ ব্যবহার করা হলে রোগীকে ক্ষতিগ্রস্তই করা হয়৷ এরূপ অবস্থায় দেহের যে অংশ আহত হয়েছে তার জন্যে উপযুক্ত চিকিৎসা করা হলে পেসাব আপনা থেকেই শর্করামুক্ত হয়ে যায়৷
কয়েকটি ব্যবস্থা ঃ
১) হরীতকী, মুথা, লোধ ও বটফল সমানভাবে নিয়ে ফুটিয়ে তাদের ক্কাথ দু’তোলা পরিমাণ কিছু দিন প্রত্যুষে নিয়মিত পান করলে বহুমূত্র রোগে ফল পাওয়া যায়৷
২) আধ পোয়া আন্দাজ পেয়ারা পাতা ভালভাবে থেঁতো করে পূর্বদিন রাত্রে জলে ভিজিয়ে রেখে পর দিন সকালে সেই জল ছেঁকে নিয়ে পান করলে রোগের বাড়াবাড়ির সময় বিশেষ ফল পাওয়া যায়৷
৩) ক) যজ্ঞডুমুরের রস এক তোলা মধু সহ,
অথবা,
খ) তেলাকুচা পাতার রস এক তোলা, মধু সহ প্রত্যুষে লেহন করে খেলে বহুমূত্র প্রশমিত হয়৷
৪) ক) জাম আঁটির শাঁস এক আনা মধু সহ
অথবা,
খ) শুষ্ক্ শিমূল মূল চূর্ণ এক আনা মধু সহ লেহন করেখেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়৷
৫) রোগ বৃদ্ধির সময় এক ছটাক বাঁশ পাতা, আধ সের জলে ফুটিয়ে সেই জল আধ পোয়া থাকতে নাবিয়ে ছেঁকে পান করলে সদ্য সদ্য সুফল পাওয়া যায়৷
৬) গেঁটে দুর্বা, যজ্ঞডুমুর, আমলকী, হরীতকী, ধনে ও গন্ধ–মুথা সমানভাবে নিয়ে আধ সের জলে সিদ্ধ করে’ আধ পোয়া থাকতে নাবিয়ে এক সপ্তাহকাল প্রত্যুষে নিয়মিতরূপে পান করলে বেশ সুন্দর ফল পাওয়া যায়৷
(দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য–শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)