যোগ মানুষের বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের কল্যাণের চাবিকাঠি

লেখক
আচার্য পরাবিদ্যানন্দ অবধূত

সারা পৃথিবীতে ‘যোগ’ এখন একটি বিশেষ জনপ্রিয় নাম৷ যদিও ‘যোগ’ শব্দটা হয়ে গেছে ‘যোগা’৷ এর উৎপত্তিস্থল প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষি তথা যোগীদের আশ্রম৷ কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে ‘যোগ’ থেকে জাত ‘যোগা’ শব্দটির দ্বারা আমরা যা বুঝি কেবলমাত্র বিশেষ রকমের শারীরিক কসরৎ অর্থাৎ exercise অর্থাৎ মহর্ষি পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার কেবলমাত্র ‘আসন’৷ না, এই আসন মানে যোগ নয়৷ আবার যদি আসনটিও দেহের জন্য ঠিকভাবে দৈনিক করতে হয় তাহলেও তা ঠিক শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে হয়---যাঁর শরীর বিদ্যা ও চিকিৎসা বিদ্যা সম্বন্ধে জ্ঞান আছে৷ যদি তা না করা হয় তবে লাভের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী থাকবে৷ উদাহরণ স্বরূপ---শীর্ষাসন৷ শীর্ষাসন সবাইকে করানো যায় না৷ যদি ধরুন কারুর হার্টের সমস্যা বা দাঁতের বা চোখের অথবা দেহের ঊধর্বাংশের কোন না কোন বড় সমস্যা আছে আর আপনি শীর্ষাসন করলেন, তার জন্য আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে৷ সর্বাঙ্গাসন যাঁরা হাই প্রেসারে ভুগছেন তাঁদের করা চলবে না৷ যদি করেন তবে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করবেন৷ আবার কোন কোন মানুষ আসনের সঙ্গে প্রাণায়ামও অভ্যাস করেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে কোন প্রাণায়াম করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করতে হবে, নচেৎ ক্ষতির সম্ভাবনা যা আপনার জানা নেই৷ প্রাণায়ামের আরো অনেক নিয়ম-কানুন আছে, এসব না জেনে প্রাণায়াম করা বিপজ্জনক৷

তাই এ সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের আসন, প্রাণায়াম বা যোগসাধনা সম্পর্কে, এর অতীত ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক দিকটাও জানতে হবে৷ যোগ বলতে যোগ সাধনা৷ সাধনার আদি প্রবর্তক সদাশিব৷ তিনি তন্ত্র সাধনারও আদিগুরু৷ আসলে তন্ত্রসাধনারই একটি সূক্ষ্ম-তর দিক হচ্ছে যোগসাধনা৷ বিভিন্ন প্রকারের যোগসাধনা আছে---যেমন হঠযোগ, রাজযোগ, অষ্টাঙ্গিক যোগ, রাজাধিরাজ যোগ ইত্যাদি৷ এসবের আদি প্রবর্তক কিন্তু সদাশিব৷ আজ থেকে ৭০০০ বছর পূর্বে সদাশিবের দেওয়া মূল তন্ত্র বা যোগ সাধনা যার অধিকাংশটাই হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রয়ে গিয়েছিল সহজিয়া সাধনা, রাজাধিরাজ যোগ সাধনা, অষ্টাঙ্গিক যোগ ও অন্যান্য কিছুতে অল্প পরিমাণে৷ আনন্দমার্গের সমগ্র সাধনা পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত সাধনাগুলির বিশুদ্ধ ও বৈবহারিক রূপ যদি ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ হয়, তাহলে এর বাকী প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রদত্ত৷ তিনি যেমন অষ্টাঙ্গিক যোগের দার্শনিক ও বৈবহারিক দিককে নানাভাবে উন্নত করেছেন, তেমনি রাজাধিরাজ যোগকে আজকের যুগের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ও আগামী কয়েক হাজার বছর পরেও উন্নততর মানুষের মানসিক-আধ্যাত্মিক প্রয়োগ বুঝে বা তাঁর সর্বজ্ঞ দৃষ্টিতে অবলোকন করে, সযত্নে নতুন করে তৈরী করেছেন ও সমৃদ্ধ করেছেন৷

তন্ত্র হচ্ছে--The practical spiritual cult. (বোধি জ্ঞানের বিজ্ঞান)যা কিনা আজ থেকে ৭ হাজার বছর পূর্বে সদাশিব দিয়েছিলেন৷ যা পরবর্তীকালে যোগ-তন্ত্র সাধনা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে৷ ২৩০০ বছর আগে মহর্ষি পতঞ্জলি হারিয়ে যাওয়া এই বিজ্ঞানকে আবার systematic ঢংয়ে আনলেন ও অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার সূত্র দিলেন৷ মহর্ষি পতঞ্জলি জন্মেছিলেন বর্ধমান জেলার পাতুন গ্রামে৷

এখন থেকে ২০০০ বছর আগে আার এক যোগী পুরুষ অষ্টবক্রমুনি বীরভূমের বক্রেশ্বরে রাজকুমার অলর্ককে ‘রাজাধিরাজ যোগ’ নামে উচ্চস্তরের যোগ সাধনা শিখিয়েছিলেন৷

অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অনেক কিছু, অনেক কিছুতে বেনোজল ঢুকেছে৷ তাই বর্তমান কালের উপযোগী করে ও আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বোধি জ্ঞান জাগানোর দিকে লক্ষ্য রেখে আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যোগসাধনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন৷

বর্তমানে ভৌত বিজ্ঞানের প্রভূত পরিমাণে উন্নতির ফলে আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে গতিময়৷ আমরা অতি অল্প প্রয়াসে অনেক বেশী পেতে চাই৷ বর্তমানের মানুষের বুদ্ধি এতই বেড়েছে যে একবুদ্ধি বা শতবুদ্ধি নয়, হয়েছে সহস্র বুদ্ধির অধিকারী৷

‘তাইতো সহস্র বুদ্ধির বাদানুবাদে

আমাদের জীবন হয়নি আবাদ,

সমাজ ও আমাদের জীবনকে করেছে বরবাদ৷’

প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ অন্তর্নিহিত এষণা আছে৷ সেই দিক দিয়ে মানুষে-পশুতে, মানুষে-উদ্ভিদে পার্থক্য হয়ে যায়৷ এই যে আধ্যাত্মিক এষণা সেটাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম৷ তাহলে মানুষের ধর্ম কী? মানুষ চায় নিজেকে বিস্তার করতে(Expansion), তার সঙ্গে সে চায় ঈশ্বরের (ভূমা) সঙ্গে মিলেমিশে এক হতে৷ সে চায় শান্তি, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, পরমা শান্তি৷৷ এগুলি হচ্ছে মানুষের বৈশিষ্ট্য৷

সংস্কৃতে দু’টি মূল ধাতু থেকে যোগ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে৷ একটি ‘যুজ্’, অপরটি ‘যুঞ্জ্’৷ ২+২=৪, ৩+৩ = ৬ এগুলি হল যোগ = Addition, ‘যুজ্’ ধাতু সঞ্জাত৷ আর ‘যুঞ্জ্’ ধাতু থেকে যে যোগ নিষ্পন্ন হয়েছে তার অর্থ কিন্তু Addition নয় Unification৷ উদাহরণ স্বরূপ---চিনি আর জলের মিশ্রণে চিনি বা জলের কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না৷ মিলে মিশে এক হয়ে যায়৷ কিন্তু চিনি ও লবন মেশালে দুইয়ের পৃথক অস্তিত্ব থাকছে৷ এটা Addition৷ আধ্যাত্মিক স্তরে যে যোগ তা যুঞ্জ্---ধাতু সঞ্জাত৷ অণুমন অর্থাৎ Unit Mind অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মন যখন পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের মনের Cosmic Mind এর সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যায় – তখন আর অনুমন অর্থাৎ unit mind এর আর কোনও পৃথক অস্তিত্ব থাকছে না ৷ একেই প্রকৃত পক্ষে যোগ বলা হয়৷  

 

প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে দু’টো আমি আছে৷ একটি হচ্ছে তার যে নাম---সেটি হচ্ছে তার ছোট আমি অর্থাৎ Unit Mind, আর বড় আমি হচ্ছে ঈশ্বরের অর্থাৎ পরমপুরুষের মন অর্থাৎ Cosmic Mind৷ ‘‘পৃথিবীতে নানা রকমের অস্তিত্ব আর তাদের কত রকমের নাম৷ সেই নামগুলি হচ্ছে ছোট আমি আর এই মহাবিশ্বের যিনি নিয়ন্ত্রক তিনি বড় আমি৷Cosmic Mind এক ও অবিভাজ্য৷ জীবমনের সঙ্গে পরমপুরুষের যে সংযোগ---এটাই যোগের সারকথা৷ এখানে ভক্তির মুখ্য ভূমিকা৷ এটি আধ্যাত্মিক স্তরের যোগ৷ এর জন্যে শরীরের ও মনের বিকাশও দরকার৷ তাই এসবও যোগের অঙ্গ৷ তাই যোগ জীবনের সার্বিক বিকাশের পথ৷ মানুষের জীবনে প্রত্যেকটি স্তরেই যোগের আবশ্যকতা আছে৷

পৃথিবীতে আজ উন্মাদ রোগগ্রস্তদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে৷ এতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে---আমাদের এই পৃথিবীতে মানসিক সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই৷ এছাড়া স্থূল শরীর ও আধ্যাত্মিক জীবনও আছে৷ আধ্যাত্মিক প্রগতির শেষ বিন্দু হচ্ছে পরমপুরুষ অর্থাৎ ঈশ্বর৷ যদি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক স্তরে যোগ থাকে আর জাগতিক ও মানসিক স্তরে যোগ না থাকে---তাহলে কী হয়? মানুষের অস্তিত্বের ভারসাম্য অর্থাৎ সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এই কারণেই জীবনের সর্বস্তরেই যোগের অনুশীলন প্রয়োজন আছে৷ মানুষের মধ্যে রয়েছে কত শত বৃত্তি৷ সেই কারণে মানুষের মন স্থির না থেকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে চলেছে৷ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের মূল বৃত্তি হচ্ছে পঞ্চাশটি৷ আর সেইগুলি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে দশ দিকে---অর্থাৎ ছ’টি প্রদিশ---পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর,দক্ষিণ, ঊধর্ব ও অধঃ৷ আর চারটি অনুদিশ---অর্থাৎ ঈশান, নৈঋৃত, অগ্ণি, বায়ু অর্থাৎ কুড়িটি গতিধারায় প্রধাবিত হচ্ছে৷ তাই আমাদের শরীরের বৃত্তি সংখ্যা ৫০× ২× ১০= ১০০০৷ মানুষের শরীরে সহস্রার জক্র কর্তৃক এই ১০০০ বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়, যাকে আমরা Medical science-এ Penial gland বলি৷ এই নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র অচেতন স্তরে অবস্থিত৷ তাই এই চক্র এক সহজ অভিব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধিত৷ এখন মানুষ যদি এই সব প্রবৃত্তিকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সামবায়িকভাবে সেগুলিকে পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের দিকে চালিত করার চেষ্টা করে তখন একে বলা হয় যোগ সাধনা৷ তবে ভক্তির সহায়তা ছাড়া পরমপুরুষের সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়৷

প্রাচীনকালে যোগীগণ বিভিন্ন ভাবে যোগের ব্যাখ্যা করেছেন৷ মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন---‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’ অর্থাৎ চঞ্চল মনের বৃত্তিগুলোকে বা বৃত্তির অভিব্যক্তিগুলোকে যদি নিরুদ্ধ বা স্তব্ধ করে দেওয়া হয় তা হ’ল যোগ৷ আমরা কিন্তু এই ধরণের ব্যাখ্যাকে বা অভিমতকে যোগের যথার্থ ব্যাখ্যা বলে মনে করি না, কারণ অজ্ঞান বা মুর্চ্ছা অবস্থায় মন কাজ বন্ধ করে দেয় অর্থাৎ নিরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তাকে যোগ বলা যাবে না৷ আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সর্বচিন্তা পরিত্যাগ নিশ্চিন্তে যোগ উচ্যতে’ অর্থাৎ মনেব যাবতীয় চিন্তা ভাবনা বা চিন্তা তরঙ্গকে মন থেকে সরিয়ে নিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়াও ঠিক আধ্যাত্মিক যোগ নয়, কেননা মন থেকে চিন্তা দূরীভূত হলেই আধ্যাত্মিক যোগ হয় না৷ যেমন দুঃখের সময় কোন মানুষ ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণের জন্যে শুয়ে পড়লেন, যেমন ধরুন এক ঘণ্টা৷ এই এক ঘণ্টা সময় তিনি মোটামুটিভাবে শান্তিতে কাটাবেন৷ এই সাময়িক চিন্তাহীনতার অবস্থাটা তো আর আধ্যাত্মিক যোগ নয়৷ তাই এই ব্যাখ্যাটাও গ্রহণযোগ্য নয়৷

এই প্রসঙ্গে তন্ত্রের ব্যাখ্যা কী? ‘সংযোগ যোগো’ ইত্যুক্ত জীবাত্মা-পরমাত্মনঃ’---অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যে সংযোগ তাই যোগ পদবাচ্য৷ আগেই বলা হয়েছে যোগের অর্থ Addition বা Unity নয় Unification৷ জীবমন যখন ঈশ্বরের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় তা-ই হ’ল যোগ৷ তখন মানুষ তার জীবনের চরম লক্ষ্যে উপনীত হয়৷ তাই যোগ হচ্ছে প্রগতির পথ৷ প্রতিটি মানুষের ক্রমোন্নতির মাধ্যমে এগিয়ে চলার পথ৷ যোগের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা হ’ল অধোগতির পথ---পশুত্বের পথ৷ আর যোগের পথে এগিয়ে চলা হ’ল দিব্য জীবনের পথ---জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ লাভের পথ৷ তাই যোগই হচ্ছে ধর্ম৷

এখন আমি আলোচনা করব প্রধানতঃ যোগাসন নিয়ে৷ প্রথমে আমি এর ইতিহাস ও বর্তমান সম্পর্কে কিছু বলতে চাই৷ ইতিহাসের আগে একটু বর্তমান সম্পর্কে বলব৷ যোগাসন নিয়ে বর্তমানে বিশ্ব তোলপাড়৷ যোগাসন দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যহ অনুশীলন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে৷ তা কিন্তু খুব একটা কেউ করছেন না৷ এই না করার ফল অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷ উদাহরণস্বরূপ শীর্ষাসন ও সর্বাঙ্গাসনের কথা আমি এর আগেই বলেছি৷

এখন ইতিহাসের সম্বন্ধে বলি৷ প্রাচীনকালের যোগীরা মানুষের দেহমনের পারস্পরিক সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ তাঁরা দৈহিক সুস্থতার জন্যেই কিছু কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যার দ্বারা মানুষের বিভিন্ন গ্রন্থি-উপগ্রন্থি glands and sub glands-এর ওপর প্রয়োজনমত চাপ সৃষ্টি করে বা চাপ বিমোচন করে তাদের সক্রিয় করতেন৷

হাজার হাজার বছর আগে ভারতের নির্জন অরণ্যে বাস করতেন অনেক যোগী-ঋষি৷ দেহ ও মনের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্যে তাদের প্রচেষ্টার বিরাম ছিল না৷ শান্তিময় পরিবেশে তারা তাদের একাকিত্বের সঙ্গী বিভিন্ন পশুপাখীর আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন৷ তারা কিভাবে বিচরণ করে, কিভাবে বিশ্রাম নেয়, অসুস্থ হলে কী করে, খাদ্য হজম করার জন্যে কী করে, কীভাবে তারা সহজাত আচরণের দ্বারা নিজেদের সুস্থ করে তোলে, সব কিছু দেখতেন৷ পশুপক্ষীর দেহভঙ্গী তাঁরা নিজেদের শরীরে ফুটিয়ে তুলতে তুলতে লক্ষ্য করেছিলেন দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও গ্রন্থিগুলিতে তা কেমন সূক্ষ্ম প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷ হাজার হাজার বছরের বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তারা পশুপাখীর অঙ্গভঙ্গিমা অনুসরণ করে শারীরিক অভ্যাসের কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যার নাম আসন৷

এই আসনগুলির নাম বিভিন্ন ভাবে রাখা হ’ত৷ যেমন (১) যেসব জীবজন্তুর দেহভঙ্গিমা কোনও বিশেষ বিশেষ আসনের জন্ম দিয়েছিল তার নামকরণও হয়েছিল সেই জীবের নামে৷ যেমন ভুজঙ্গাসন, শশঙ্গাসন, উড্ডয়ন, কুর্মাসন, মর্কটাসন, ময়ূরাসন ইত্যাদি৷ (২) কিছু আসন কিছু প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবের সমান৷ যেমন কুর্মকাসন, শলভাসন (পঙ্গপাল)৷ (৩) কিছু আসন বিশেষ বিশেষ গুণসম্পন্ন---সর্বাঙ্গাসন, যার দ্বারা সম্পূর্ণ দেহযন্ত্র উপকৃত হয়৷ (৪) আবার কিছু আসন যিনি প্রথম আবিষ্কার করেন তাঁর নামে রাখা হয়েছিল---যেমন মৎসেন্দ্রাসন (যোগী মৎসেন্দ্র্যনাথ কর্তৃক আবিষৃকত), এই আসনটি সম্পূর্ণ দেহযন্ত্রকে প্রভাবিত করে৷

আসন দুই প্রকার (১) স্বাস্থ্যাসন, (২) ধ্যানাসন৷ স্বাস্থ্যাসন বলতে বোঝায় সেই সমস্ত আসন যা প্রধানতঃ আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত আর ধ্যানাসন হ’ল যেগুলি প্রধানত মনের একাগ্রতা ও সাধনার সহায়ক৷ এখন প্রশ্ণ আমরা কেন আসন অভ্যাস করব? আসন --- (১) বিভিন্ন রোগের নিরাময় ঘটিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে, (২) দেহের নমনীয়তা বাড়ায়, (৩) দেহমনের সামঞ্জস্য রক্ষা করে৷ (৪) অবাঞ্ছনীয় চিন্তা মনে আসতে দেয় না৷ (৫) সূক্ষ্মতর ও উচ্চতর সাধনার জন্যে মনকে প্রস্তুত ও সাহায্য করে, (৬) গ্রন্থিগত ত্রুটি দূর করে আর গ্রন্থিরস ক্ষরণে সামঞ্জস্য আনে৷ এইভাবে আসনের মাধ্যমে মানুষের বৃত্তির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়৷

মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজি আসন অভ্যাসের ক্ষেত্রে কেবল আসনে সীমাবদ্ধ থাকেননি নি---আসনের সঙ্গে মুদ্রা, বন্ধ ও বেধকেও যুক্ত করেছেন৷ আসনের মাধ্যমে গ্রন্থি, স্নায়ু, পেশী, টিসু অর্থাৎ শরীরের সকল অংশের ব্যায়াম সংসাধিত হয়৷ আসনের দ্বারা শারীরিক সুখ বিধান ও মানসিক শান্তি দুইই লাভ হয়৷ এসব কারণে আসনের শারীরিক উপকারের কথা বলে শেষ করা যায় না৷ তাই বর্তমান বিশ্বে আজ আসন এত জনপ্রিয়৷ আসনের এই বিপুল জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা সত্ত্বেও বলব এ সম্পর্কে উপযুক্ত ও নিঃস্বার্থ নির্দেশনার অভাব রয়েছে৷

এছাড়া দৈনন্দিন আসন অনুশীলন করবার ঠিক পূর্ব মুহূর্ত্তে কিছু আবশ্যিক নিয়ম আর আসন অভ্যাসের অব্যবহিত পরে অন্য আরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়৷ যা আমি পরে বলব৷ স্মৃতিশক্তি, মেধা ও চিন্তাশক্তি বাড়ানোর খুব সূক্ষ্ম অথচ কার্যকরী আসন আছে যা সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়৷ এই সকল কারণে উপযুক্ত অভিজ্ঞ আচার্যের তত্ত্বাবধান ছাড়া আসন অভ্যাস করা উচিত নয়৷

মুদ্রা ঃ মুদ্রা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে স্নায়ু ও পেশীকে৷ মুদ্রা আসনের মত শারীরিক মানসিক হলেও এর বেশী অংশ মানসিক৷ তাই অধিকাংশ মুদ্রা মনকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে অভ্যাস করতে হয়৷ যেমন বায়বী মুদ্রা, আকাশী মুদ্রা, মানসী মুদ্রা ইত্যাদি৷ আবার কয়েকটি খুবই সূক্ষ্ম মুদ্রা আছে যা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চতর সাধনায় ব্যবহৃত হয়৷ আর কয়েকটি স্বাস্থ্য-মুদ্রা আছে যা মণিপুর চক্র ও স্বাধিষ্ঠান চক্র সংক্রান্ত রোগে দারুণভাবে কাজ করে৷ যেমন উড্ডয়ন অগ্ণিসার আগ্ণেয়ী মুদ্রা প্রভৃতি৷

বন্ধ ঃ বন্ধ একটি বিশেষ প্রকারের শারীরিক অবস্থান---যা স্নায়ু ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত করে তোলে৷ মুদ্রার মত এও বেশীরভাব মানসিক৷ তাই শরীর ও মনের ওপর এর সূক্ষ্ম প্রভাব আছে৷ জালন্ধর বন্ধ, মহাবন্ধ, মহাবেধ ও মহামুদ্রার অনুশীলন (বন্ধত্রয় যোগ) যুব বয়সীদের ও যোগ সাধকদের পরমবন্ধু৷ বন্ধ অভ্যাসের ফলে শরীরের বায়ুতত্ত্বও প্রভাবিত হয়৷

প্রাণায়াম ঃ পরমপুরুষের ভাবনা নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে প্রাণায়াম৷ মানসিক একাগ্রতা ও সাধনায় প্রাণায়াম খুবই সহায়ক৷ ‘‘প্রাণান্ যময়তি এষঃ প্রাণায়ামঃ’’ অর্থাৎ প্রাণায়াম হচ্ছে প্রাণবায়ুর নিয়ন্ত্রণ৷ সাধক প্রাণায়াম অভ্যাসের মাধ্যমে প্রাণেন্দ্রিয়কে (দশটি বায়ুর মিলিত নাম প্রাণেন্দ্রিয় এই দশটি বায়ু হ’ল প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, নাগ, কুর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়) শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে৷

প্রাণায়াম দু’প্রকার---হঠযৌগিক প্রাণায়াম (যা গুরুরা সচরাচর শেখান) আর আধ্যাত্মিক প্রাণায়াম (যুধিষ্ঠির বিদ্যা)৷

হঠযোগিক প্রাণায়াম---মনকে কোনও বিশেষ বিন্দুতে একাগ্র না করে ও পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের ভাবনা না নিয়ে এই প্রাণায়াম করা হয়৷ কিন্তু যখন মনকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে বসিয়ে পরমপুরুষের (ঈশ্বরের) ভাবনা সহ প্রাণায়াম করা হয় তখন তা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে পড়ে৷ প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন---তাই একে যুধিষ্ঠির বিদ্যা বা যুধিষ্ঠির প্রাণায়ামও বলা হয়৷ মন্ত্র ও নির্দিষ্ট চক্র ছাড়া যে প্রাণায়াম তা কিছু রোগের আরোগ্যের জন্যে ব্যবহৃত হয়৷ রোগটি ভাল হয়ে গেলে আর সেই প্রাণায়াম করা হয় না৷ হঠযৌগিক প্রাণায়ামের খারাপ দিক হ’ল তা ধীরে ধীরে মনকে জড়ত্বের দিকে নিয়ে যায়৷ ঠিক ঠিক পদ্ধতিতে আধ্যাত্মিক ভাবনা নিয়ে মনকে বিশেষ চক্রে বসিয়ে প্রাণায়াম করলে তা মনের বৃত্তি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভাবে উপযোগী হয়ে ওঠে৷ কারণ এই প্রাণায়ামের দ্বারা চক্রগুলি মজবুত হয় ও গ্রন্থিরসের ক্ষরণের মধ্যে সামঞ্জস্য আসে৷

নিয়ম নীতি ঃ (১) আসনের পূর্বে স্নান বা ব্যাপক শৌচ করতে হবে৷ (২) খোলা জায়গায় আসন করা চলবে না---আবার ঘরে যেন বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে৷ (৩) ঘরে যেন ধোঁয়া না ঢোকে৷ (৪) পুরুষেরা কৌপীন পড়বে, আর খালি গায়ে করবে৷ নারীরা আঁটসাট জামাকাপড় পরবে৷ (৫) কম্বল বা শতরঞ্চির ওপর আসন করতে হবে৷ এমনই আরও কিছু নিয়ম রয়েছে যা যোগ প্রশিক্ষক আচার্য বা আচার্যার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে৷

আসন মুদ্রা ও বন্ধের দ্বারা শরীরকে ঠিক রাখতে পারবেন, কিন্তু মনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ(control) করবেন? মন সবসময় চঞ্চল থাকে, মনের চঞ্চলতা সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ একটি হনুমান বা বাঁদর তাকে মদ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আবার তাকে একটা কাঁকড়াবিছে কামড়েছে---তখন সে যেমন অস্থির বা চঞ্চল হয়ে ওঠে মন তেমনি চঞ্চল স্বভাবের৷ একে নিয়ন্ত্রণ করবেন কী করে? এর জন্যে দরকার বিশেষ মানসিক অনুশীলন Mental exercise)৷ একেই বলা হয় ধ্যান meditation) বা সাধনা৷ এই ধ্যান খুবই সূক্ষ্ম ব্যাপার যা অভিজ্ঞ আচার্য বা আচার্যার কাছ থেকে ব্যষ্টিগতভাবে শিখে দু’বেলা অভ্যাস করতে হয়৷

এককথায় যোগ সাধনা হ’ল শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক---এই তিনেরই উন্নতির যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি৷ এইভাবে যোগের সাহায্যে আদর্শ মানুষ তৈরী হয়৷ আদর্শ মানুষেরাই গড়ে তুলতে পারে আদর্শ সমাজ৷ তা-ই যোগ যথার্থই বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের কল্যাণ-সাধনের চাবিকাঠি৷