ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা পালন ছাড়া বিকল্প পথ নেই

লেখক
সঞ্জীব বিশ্বাস

 

আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা ‘‘হিন্দি, হিন্দুি ও হিন্দুস্তানের’’ বীজ মন্ত্রের মাহাত্ম্যে স্বপ্ণাবিষ্ট তারা তো আছেনই, দ্বিতীয়ত ১৬টি মার্কসবাদী গোষ্ঠীর হিন্দু শ্রেণীর একটা বড় অংশও উক্ত বীজ মন্ত্রে আস্থা জ্ঞাপন করতে ঝুঁকে গেছে৷ তারপর থাকে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের ‘তেনারা’৷ তবে প্রদেশ কংগ্রেস দলটির জন্ম লগ্ণ থেকেই বাংলার প্রতি কখনো সাপ, আবার বিপদ দেখেতে পেলে ওঝার ভূমিকায় অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিজেদের কর্ম দক্ষতার পরিচয় দিতে আবহেলা করেনি৷ এমতাবস্থা বৃহৎ বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের পূর্বা–পর মূল্যায়নে গেলে দেখা যায় এই জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশই বাংলার জন্যে ‘‘ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা’’ কোন দিনই পালন করেনি৷ আর একবিংশতকেও যে খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির প্রতি উক্ত সম্প্রদায়ের দায়িত্ববোধ বেড়েছে তা মোটেই নয়৷ কেননা স্বাধীনতার পরবর্ত্তী কাল থেকে এই একবিংশতকেও দেখা যাচ্ছে রাজ্যের জেলাগুলিতে বহিরাগত ভাষা গোষ্ঠীর জবরদখল দেখিয়ে আমরাই বাংলার জমি হস্থান্তর ঘটিয়ে বাঙলীর সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ক্রমহ্রাস করতে আইনি ও রাজনৈতিক সমর্থন দিতে কোন দিনই পিছিয়ে নেই৷ এই পরিস্থিতে বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে বলতে হয় একটা আত্মঘাতী প্রবণতায় সবাই উন্মত্ত৷ আর একক ভাবে রাজনীতির মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যায় বৈয়ষ্টিক স্বার্থের মোহান্ধ ছাড়া জাতি ও রাজ্যের স্বার্থ কোথাও দেখা যায়না৷ এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বলতে বোঝায়  স্বার্থ বনাম স্বার্থের লড়াই৷ তাই সরকার বিরোধী নেতৃত্বের বলার অবকাশ নেই এই যে পশ্চিমবঙ্গের  সার্বিক ধ্বংসের জন্যে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলই সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী৷ অথবা সরকারী দলও বলতে পারেনা অতীতের শাসক গোষ্ঠী রাজ্যের অধঃপতনের মূল কান্ডারী৷ কারণ স্বার্থ বনাম স্বার্থের লড়াইয়ে কুযুক্তি ও তর্কের শেষ নেই৷ সুতরাং প্রশ্ণ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকরা আমাদেরকে জানাবেন কি স্বাধীনতা পরবর্ত্তী মুহূর্তে সম্পদের মূল্যায়নে যে রাজ্যটি প্রথম ছিল, আজ ৬৮ বছর পরে সেই রাজ্যটিই দেউলিয়া হয়ে পড়ল কেন এই অধঃপতনের জন্যে দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের রাজনীতিকরা নিজেদের দায় দায়িত্বের কথা স্বীকার করবে না কেন এই যখন রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি তখন সরকার বিরোধী বা ক্ষমাসীন দল একে অপরকে দোষারোপ করে কোন যুক্তিতে আসলে মিথ্যাচারী বাক যুদ্ধকেই এ রাজ্যের মানুষ উচ্চ মানের রাজনীতি বলে বিশ্বাস করে বলেই রাজনীতিকরা অবাধে আস্ফালন প্রকাশ করতে পারছে৷ কিন্তু সুস্থ কোনও সমাজে এধরনের দুষ্কর্ম কোন দিনই চালানো সম্ভব হত না৷

বস্তুত অতীতের বৃহৎ বঙ্গ থেকে আজকের খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের তথ্য সমূহের পর্যালোচনায় যদি আমরা যাই তাহলে অব্যশ্যই দেখতে পাব আমাদের লোভ ও লাভের স্বপ্ণবিলাসের জন্যে গোটা হিন্দু বাঙালী সম্প্রদায় আজ বিপদাপন্ন৷ এখানে প্রশ্ণ উঠতে পারে জনসাধারণ তো এর জন্যে দায়ী নয়৷ যা কিছু অতীতে ঘটে গেছে আর আজও ঘটে চলেছে তার জন্যে নেতৃত্ব দায়ী হবে না কেন এই প্রশ্ণের মধ্যে অবশ্যই আংশিক সত্যতা আছে৷ কিন্তু এক তরফা ভাবে বাঙ্গালী নেতৃত্বকে বেইমান, প্রতারক রূপে সাব্যস্ত করা ঠিক নয়৷ কেননা ওরাও তো বাঙালী সমাজ থেকে উঠে এসেছে৷ দ্বিতীয়ত তারা লাভ ও লোভের তাড়নায় বিভ্রান্ত থাকলেও তাদের পিছনে একটা জনসমর্থন না থাকলে নেতায় পর্যবষিত হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়৷ এই পরিস্থিতিতে সঠিক মূল্যায়ন হবে এই যে, আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে বাংলাকে বাঁচাতে ‘‘ঐতিহাসিক দায়–দায়িত্ব’’ পালন করতে ব্যর্থ৷ পরিবর্তে আমরা সবাই মিলেই কখনো পাঠান, কখনো মোগল, কখনো ব্রিটিশ, পরিশেষে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের হাতে বাংলার ভাগ্য তুলে দিয়ে নিজেরা নৈবদ্যের সাজানো কাঁটালি কলা রূপে রাষ্ট্রীক, সামাজিক ও আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে চেয়েছি৷ তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে যখনই স্বার্থের উপর আঘাত এসেছে তখনই সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণী সমাজের বঞ্চিতদের অভিযোগকে তুলে গোষ্ঠী তৈরী করে হঠকারী উৎপাত, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত চালিয়ে শর্তভঙ্গ ও সুবিধা প্রদানে অস্বীকার করার প্রতিশোধ নিতে বিপক্ষের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে বারে বারে বাংলায় ডেকে আনা হয়েছে৷ অথচ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের পরিবর্তন ঘটালেও সমাজের দালাল ও সুবিধা ভোগী শ্রেণী ছাড়া সাধারণ বঞ্চিত বাঙালীর কোনও পরিবর্তন ঘটেনি৷ এই ছিল গত কয়েকশত বছরের প্রথা৷ এই প্রথার বাইরে বাঙালীরা নিজেদের কথা কোনদিনই ভাবতে শেখেনি৷ আজ একবিংশতকেও রাজ্যের বাঙালীরা দালাল ও সুবিধা ভোগী শ্রেণীর স্বার্থের বাইরে থেকে রাজ্য–রাজনীতিকে যেমন দেখতে শেখেনি, তেমনই রাজ্যের কথাও ভাবতে পারছেনা৷ কারণ জনসাধারণ জানেনা দালাল ও সুবিধাভোগীদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে বাঙালীর কি সর্বনাশ পর্দার আড়ালে ঘটে গেছে৷

বস্তুত বাঙালীরা কোন দিনই অতিবিশাল জাতিসত্ত্বার কথা ভাবতে গেল না৷ ভাবতে পারল না বিশাল ভূখণ্ডের বাসিন্দা হয়েও আমরা আমাদের শাসক হতে পারব না কেন প্রশ্ণ জাগল না এত বিশাল জাতি হয়েও বাংলার কিছু দালাল ও সুবিধা ভোগীর সৌজন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৃহৎ বঙ্গকে অবাধ লুন্ঠনের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছি কেন কেউ ভাবল না এই বিশাল ভূখণ্ডে আমাদের পরিচিতির বাহক না থাকে তবে শকুন যেভাবে বিশাল মৃতদেহ ছিড়ে খায়  তদরূপ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তার দোসর পোষাকী বাঙালীরা মিলে নিজেদের স্বার্থে বাংলাকেও ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে জাতিগত এই ভাবনা বাঙালীদের ছিল না বলেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বৃহৎ বঙ্গকে ৭ খণ্ডে বিভক্ত করে বিশ্বের মধ্যে একক ভাষাভাষী বিশাল জনগোষ্ঠীকে মূষিকে পরিণত করে দিল৷ অথচ বাঙালী জাতিটার যদি সেন্টিমেন্টাল লিগাসী থাকত তাহলে বিশ্বের মধ্যে এক ভাষী জনগোষ্ঠী হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্মান পাওয়ার অধিকারী ছিল৷ এই  পরিস্থিতিতে সাত খণ্ডে বিভক্ত বঙ্গবাসীর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ দুটি খণ্ডই বিশ্বে বাংলাভাষী বলে পরিচিত৷ তবে এই একবিংশতকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য হারাতে বসেছে৷ যদিও বিষয়টা এখনো বেসরকারী পর্যায়ে রয়ে গেছে৷ এমতাবস্থায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে রাখা দরকার এই যে সেই শুভ দিন আর খুব বেশী দূরে নেই, যেদিন কোন এক অজ্ঞাত গোষ্ঠীবর্গ রাজ্যের দেওয়ালে দেওয়ালে পোষ্টার সেটে দাবী তুলবে এই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কারা অবিলম্বে সরকার জানিয়ে দিক৷

বস্তুত তখনই দালাল ও সুবিধা ভোগী পোষাকী নেতা নির্ভর হিন্দু বাঙালীদের ভাগ্যে নেমে আসতে পারে একটা আত্মবিলাপ৷ কারণ তখন বিপদ দেখলে হিন্দু পোষাকী বাঙালীদের অতি ধূর্ত শ্রেণীটা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী৷ যেমন অতীতে এমনই ঘটনা ঘটিয়ে ছিল পূর্বপাকিস্তানের পোষাকী বাঙালীদের অতি ধূর্ত ও বিশ্বাসঘাতক শ্রেণীটা৷ কি ঘটেছিল সেদিন এসম্পর্কে পুরানো ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় পূর্বপাকিস্তান ঘোষণার পরে পরেই শিক্ষিত তথা উচ্চবৃত্তের একটা বড় অংশই চলে গেছিল দিল্লিতে৷ অপর আর একটি অংশ চলে গেল কলিকাতার জনারণ্যে৷ এই উচ্চবৃত্তের অংশটি পূর্বপাকিস্তান ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে খুবই তৎপরতার সঙ্গে দেশ ছাড়ার পিছনে সব থেকে বড় যে রহস্যটি লুকিয়ে আছে তার অনুসন্ধান কেন হয়নি এটাও এক রহস্যাবৃত ঘটনা৷ এই শ্রেণী দেশ ত্যাগ করে দিল্লি যাবার পিছনে কারা প্রকৃত গাইড করেছিল ও আর্যবলয়ে যেখানে বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল সেখানে রাতারাতি ওই বঙ্গজদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার পিছনেও সন্দেহের অবকাশ থেকেই গেল৷

ইতিহাসের পটভূমিকায় বৃহৎ বঙ্গের সাত খণ্ডের মধ্যে এক খণ্ড হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ৷ দ্বিতীয়ত অতি সংক্ষেপে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে যে বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি তা হল বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায় বাংলার জন্যে ‘‘ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা’’ কোন দিনই পালন করতে দেখা যায়নি৷ পরিবর্তে পোষাকী বাঙালী নেতৃত্বের ওপর ভরসা রেখে লাভবান হতে যে পারেনি তার ঐতিহাসিক প্রমাণ তথ্যের যৎকিঞ্চিত আলোচনাও এই প্রবন্ধে হয়েছে৷ এমতাবস্থায় আগামী দিনের জন্যে যে সন্দেহটা প্রকট হয়ে উঠতে চলেছে সেটা হবে লোভ ও লাভে উন্মত্ত পোষাকী রাজনীতির সভা সুন্দর হিসাবে বাঙালী নেতাদের হাতে পশ্চিমবঙ্গ পরিচালনার দায়ভার থাকবে ঠিকই, কিন্তু সরকার পরিচালিত হবে পর্দার আড়াল থেকে৷ সুতরাং হিন্দু বাঙালীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে এক্ষণে রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে নিজেদের পরিচিতি বহনকারীর দরকার৷ এখানে হীনন্মন্যতায় ভুগলে পূর্বপাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের চাইতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী হিন্দুদের৷ এই পরিণতির কথা মাথায় রেখে চলতে পারলে এখনো বাঁচার পথ আছে বলে ধারণা৷ বাঙালী হিন্দুদের পরিণতির কথা অবশিষ্ট ভারতের মানুষেরা অনেক দিন আগে থেকেই জেনে গেছে৷ তাই বিদ্বজ্জনেরা গত শতাব্দীর ৯৪ সালেই ‘‘ভারতীয় সংবিধান ও ইতিহাস’’ নামে এক পাঠ্যপুস্তকে লিখে দিয়েছেন যে ‘‘বাঙালীদের কোনও দেশ ছিল না’’৷ এরা রাষ্ট্রহীন জাতি৷ সুতরাং হিন্দু বাঙালীরা কোথায় যাবেন এই ভাবনাটা আগেই ভাবা উচিত৷