আর.জি.কর কোন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়৷ সারা দেশে, শুধু দেশ কেন সমগ্র মানব সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে এই ধরণের নারকীয় ঘটনা৷ অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, সামাজিক ভেদবিদ্বেষ নৈতিক অধঃপতনে মানব সমাজ এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন৷ এই সমস্যার আশু সমাধান না করলে মানবজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে৷
সমস্যার সমাধান করতে হলে সমস্যার গভীরে গিয়ে কারণগুলো খুঁজে বার করতে হবে৷ আর.জি.করের ঘটনা একটি সামাজিক ব্যধি৷ পুলিশ প্রশাসন আইন-আদালত অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে মাত্র, সমাজ থেকে এই ব্যাধি নির্মুল করতে পারবে না৷ কারণ রাষ্ট্র-যন্ত্র এই ব্যাধির উৎস নয়৷ অপরাধীর কঠোর সাজা হোক, রাষ্ট্রযন্ত্রে পরিবর্তন আসুক তথাপি সমাজ থেকে এই ব্যাধি দূর হবে না৷
এই পৈশাচিক ব্যধির মূলে আছে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, কুশিক্ষার প্রভাব৷ সংস্কৃতি বলতে বোঝায় মানব মনের সামূহিক অভিব্যক্তির মধ্যে যে পরিশীলিত ভাব--- তাই মানব সংস্কৃতি৷ মানব মনের সূক্ষ্ম ও মাধূর্যপূর্ণ অভিপ্রকাশই মানুষকে মনুষ্যত্বের শিরোপা পরিয়েছে৷ এই মানব সংস্কৃতিই বিবর্তনবাদের ক্রম বিকাশে মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিয়েছে৷ তবু মানুষ আজও তার অতীত জীবনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে না৷ এর জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার ও উন্নত জীবন চর্চার যাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক অনুশীলন৷ এই অনুশীলন না থাকায় মানুষ পাশবিক বৃত্তির তাড়নায় পৈশাচিক আচরণ করে৷ মানব সমাজকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার গুরু দায়িত্ব শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক জগতের কুশিলবদের৷ কিন্তু আজ সাংস্কৃতিক জগতের ধারক বাহকেরা সমাজ ঘটনের দায়িত্ব ভুলে শুধুমাত্র দেহগত সুখের তাড়নায় সৃষ্টি করে চলেছে নগ্ণ চলচিত্র, অশ্লীল সাহিত্য, রুচিহীন গান---যা মানুষকে নৈতিক অধোগতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ আর.জি.করের ঘটনার মতো সামাজিক ব্যধির মূলে আছে মানুষের এই নৈতিক অধঃপতন৷ কোন প্রতিবাদ আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজকে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়৷
ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাও আর একটি কারণ৷ শুধু আর একটি কারণই নয়, এই সামাজিক সংকটকে শিক্ষার সংকটও বলা যায়৷ মনে রাখতে হবে শিক্ষার সঙ্গে সমাজের গভীর সম্পর্ক৷ তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতিশিক্ষা অবশ্যই থাকতে হবে৷ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই নীতিবাদের শিক্ষা তথা সামাজিক মূল্য, মানবীয় মৌলনীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনি সমস্ত প্রকার ভাবজড়তা ও সংকীর্ণতা মুক্ত উদার মনের মানুষ হতে হবে৷
আদর্শ সমাজ ঘটনে অর্থনীতিকেও উপেক্ষা করা যায় না৷ সামাজিক তথা সভ্যতার এই সংকটের অন্যতম কারণ অবশ্যই আর্থিক বৈষম্য, অর্থ এমন এক বিষয়---যার অভাব মানুষকে অধোগতির দিকে নিয়ে যায়, আবার উপযুক্ত শিক্ষা না থাকলে অর্থের প্রাচুর্য মানুষকে অধঃপথে ঠেলে দেয়৷ আর.জি.করের ঘটনায় জড়িতরা কেউ তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর বা দারিদ্র নয়৷ যথেষ্ট উচ্চবৃত্ত শ্রেণীর মানুষ!
আর.জি.কর ঘটনার প্রতিবাদ আন্দোলন আর একটা বিষয় স্পষ্ট করলো---আজ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও চিন্তা রাজ্যে বুদ্ধি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ প্রায় চল্লিশ বছর আগে মানুষকে এই বিষয়ে সতর্ক করে গেছেন প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ কিন্তু মানুষ কোন শিক্ষা নেয়নি, তাই আর.জি.কর কাণ্ড যেমন দ্বিপদ জীবের পৈশাচিকতার নগ্ণপ্রকাশ তেমনি আর.জি.কর নিয়ে আন্দোলনও মানবিকতার সীমা লঙ্ঘন করে গেছে৷
বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে সমস্ত প্রকার সমস্যার সমাধান করে আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে হলে আনন্দমার্গ দর্শনকেই পাথেও করতে হবে৷ আনন্দমার্গের অর্থনীতি---প্রাউট, সমাজনীতি--- নব্যমানবতাবাদ সংস্কৃতি--- শিল্প, কলা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও আধ্যাত্মিক সাধনাই মানব সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম৷
- Log in to post comments