আজ সমস্যাসংকূল পৃথিবীর বুকে সকল সমস্যা সমাধানের যে পথটি অনুসরণ করা ও তাকে স্মরণ করে চলার বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, তা হ’ল মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সর্বানুসূ্যত দর্শনের পথ৷ তিনি বলেছেন, ‘সংগচ্ছধবং’ মন্ত্র নিয়ে এক সঙ্গে চলাই হ’ল ধর্ম৷ এক সঙ্গে চলতে হলে সংঘবদ্ধভাবে চলতে হবে৷ মানুষ কুসংস্কার, অজ্ঞানতাবশতঃ, ধর্মান্ধতা জাত-পাতের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে বিরোধ করছে৷ সেই সব বন্ধ করে এক হয়ে কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতির ঐক্যসূত্রে একত্রিত হয়ে সকল প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ প্রথমেই মনে রাখতে হবে আমরা সকলেই মানুষ৷ আপেক্ষিক জগতে বৈচিত্র্যের মধ্যে যে ঐক্য বিদ্যমান সেটা হ’ল মানবিক মূল্যবোধ৷একই পৃথিবীর স্তন্যে আমরা পালিত৷ আমাদের তাই মনে রাখতে হবে যে, ‘হর গৌরী আমাদের পিতা মাতা, আর ত্রিভূবন আমাদের স্বদেশ৷ ঈশ্বরের সৃষ্ট পৃথিবীতে জীব-জন্তু গাছপালা সকলের সঙ্গে পারস্পরিক যুক্ত৷ কেউই গুরুত্বহীন নয়৷ সবাই সবাইয়ের কাছে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত ও বন্ধনে আবদ্ধ৷ আমাদের সমাজবদ্ধভাবে এগোতে হবে, কারণ এগিয়ে চলাই হ’ল লক্ষ্য৷ থেমে থাকা যাবে না, আর চলাই হ’ল সৃষ্টির প্রবাহ৷ কিন্তু চলার পথে নানান বাধাকে ঠেলে এগোতেই হবে৷ সেটা হ’ল সংগ্রাম৷ সংগ্রামই হ’ল জীবন৷ কিন্তু নানা দিক থেকে নানা বাধা আসে৷ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধা দূর করে চলতে হলে অবশ্যই জীবনে যে সকল শোষণ চলার পথে আসে সেই সার্বিক শোষণমুক্তির আন্দোলন দরকার৷ সামাজিক জীব হিসাবে মানুষকে আন্দোলন করতেই হবে৷ এটাই ‘সমাজ’ আন্দোলন৷ সমাজের বুকে শোষিতদের অবশ্যই শোষকদের চিহ্ণিত করে আন্দোলনের মাধ্যমে এগোতে হবে৷ শোষক স্বার্থান্ধ হয়ে সংকীর্ণ স্বার্থে শোষণ করে, তাদের স্বার্থপূরণে৷ এই যে শোষণ, এতে সমাজের বৃহত্তর অংশ শোষিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে৷ তাই সংঘবদ্ধ হয়ে যদি সমাজে বসবাসকারীরা এক হয়ে এগোতে না পারে তাহলে তাদের অগ্রগতি হবে না৷ তারা শোষিতই হবে৷ তাই আজ প্রয়োজন, সমাজের সকল শোষিতদের আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সকল দিকে যে শোষণ চলছে সেটা বুঝে নিয়ে সকল মানুষ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক হয়ে তীব্র আন্দোলন৷ সেটার থেকে সরে আসলে চলবে না৷ আজ সামগ্রিকভাবে সামাজিক আন্দোলন দরকার৷ একেই বলে সমাজ আন্দোলন৷ কেউই ছোট নয়, জাত-পাতের মিথ্যা ভেদাভেদ সৃষ্টি করে মানুষ মানুষকে খাটো করে রেখেছে৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মানবতার মুক্তির জন্যে সমাজ আন্দোলনের আহ্বান করেছেন৷ মানুষ উন্নত আধ্যাত্মিক জীব৷ আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষকে বুঝে নিতে হবে এ জগতে কেউ ছোট নয়৷ সবাই ঈশ্বরের সন্তান আর বসুন্ধরার সকল সম্পদ ভোগ করার অধিকার সকল মানুষের৷ যারা তাদের বঞ্চিত করছে তারা হ’ল তাদের শোষক ও অমিত্র৷ তারা বন্ধু নয়, সেটা জানতে হবে বুঝতে হবে৷ আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সকল প্রকার শোষণমুক্ত হয়ে প্রত্যেক মানুষ আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হোক---একটাই তাঁার ইচ্ছা৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সকল মানুষের জন্যে আনন্দমার্গ দর্শন দিয়েছেন৷ আর এই দর্শনেই তিনি প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব দিয়েছেন, যার নাম ‘প্রাউট’ দর্শন---সেটি আর্থিক ও সামাজিক দর্শন৷ অধিকার অর্জন করতে হয়, অধিকার কেউ দেয় না৷ পৃথিবীর বুকে একদল মানুষ কোটি কোটি মানুষকে শোষণ করে সম্পদ ভোগ করছে৷ সেটা হচ্ছে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা৷ জড়বাদী সাম্যবাদী নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাম করে বিশেষ এক পার্টির একনায়কতন্ত্র চলে৷ সেটাও কোনভাবেই কাম্য নয়৷ ৷ তাই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র হ’ল মানুষের এগিয়ে চলার একমাত্র পথ৷ সবাই বাঁচুক ও সবাইকে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়াই হ’ল মানবতার ধর্ম৷ শোষণমুক্ত হয়ে সমাজগুলি যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে তখনই সেই এক বিশ্বরাষ্ট্র সৃষ্টি হবে৷ ভারতের ৪৪টি সমাজ আর পৃথিবীর প্রায় ২৪৬টি সমাজ ইয়ূনিটগুলি সব দিক থেকে সার্থক স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল হয়ে গড়ে উঠুক৷ সেখানে কেউ ছোট নয়৷
সমাজের মুক্তি আনবে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র৷ গণতন্ত্র মন্দের ভাল৷ কিন্তু গণতন্ত্র যদি রাজনৈতিক দলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ও ধনীদের অঙ্গুলী হেলনে চলে তাহলে গণতন্ত্র কখনই কল্যাণের পথ দেখাতে পারবে না৷ যদি সৎ নীতিবাদী, আধ্যাত্মিক পথের পথিকগণ সেবক হিসাবে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন ও সমবায় আন্দোলনকে উৎপাদন ও বণ্টনে অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে সমাজে সামাজিকীকরণ আনতে পারে ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের কল্যাণধর্মী কিছু আলো মানুষ দেখতে পাবে, নচেৎ নয়৷ দীর্ঘ ৭৭ বছরে গণতান্ত্রিক শাসনে হতভাগ্য মানুষ ভারতে ভিখারী থেকে আরও ভিখারী হয়েছে৷ লোভী শাসকগণ নিজেদের স্বার্থে তাদের অন্ধকারের দিকে কি টেনে নিয়ে যাচ্ছে না? আজ দলতন্ত্রের সর্বনাশা অবৈজ্ঞানিক পথে গণতন্ত্র কি ধর্ষিত হচ্ছে না? এর সদুত্তর কে দেবে? বর্তমান পৃথিবী ধনতান্ত্রিক শোষণে অক্টোপাশের বন্ধনজালে আবদ্ধ৷ মুক্তির পথ হ’ল প্রাউটের প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র৷
- Log in to post comments