আত্মোন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আজকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হ’ল নৈতিকতার সমস্যা৷ সৎ, নীতিবাদী, কর্তব্য সচেতনতার অভাব৷ আজকের মানব সমাজের আর যত সমস্যা তার মূল কিন্তু এইটাই৷

এই সমস্যার কথা দেশের প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবীরাই বলছেন৷ সমাজের সমস্ত নেতৃস্থানীয় ব্যষ্টিও এটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন৷ এই সমস্যা সমাধানের যথার্থ পথ সবাই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন৷

নিঃসন্দেহে এই সমস্যার সমাধান হ’ল, সর্বাত্মক জীবনদর্শন ও তার অনুশীলন৷ কেমন হবে সেই জীবন দর্শন? তা নিশ্চয়ই কোন জড়বাদী দর্শন হবে না৷ কারণ, এটা সর্ববাদী সম্মত যে মানুষের  অভাব অনন্ত৷ এইটাই মানব মনের বৈশিষ্ট্য৷ এই বৈশিষ্ট্যটা পশুর মধ্যে নেই৷ একটা পশু---সে গোরু-ভেড়া-কুকুর যাই হোক---তাদের পেট ভরলেই আর কিছু চায় না৷ বা আরও একটু বিস্তৃতভাবে বলা যায়, আহার-নিদ্রা-ভয় ও বংশবিস্তার---এর মধ্যেই পশুজীবন আবদ্ধ৷ এছাড়া তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই৷ কিন্তু মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য হ’ল, অল্পে মানুষ সন্তুষ্ট নয়৷ সে চায়---আরও চায়৷ কবির ভাষায়---‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না৷ মানুষ এক শত টাকা পেলে, সে দু’শ টাকা চায়৷ দু’শ পেলে হাজার টাকা চায়, এমনি করে মানুষের চাহিদা লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি যতই ছাড়িয়ে যাক, তার চাহিদা তৃপ্ত হবে না৷ আজ যার পেটে অন্ন নেই, অর্থ পেলে সে বাড়ী চায়, বাড়ী পেলে গাড়ী চায়৷ তার চাহিদার অন্ত নেই৷ গোটা পৃথিবীটার আধিপত্য পেলেও সে অন্যান্য গ্রহের আধিপত্য চাইবে৷

অর্থাৎ এক কথায়, মানুষের অভাব অনন্ত৷ কিন্তু পৃথিবীটা বা পৃথিবীর সম্পদ তো সীমিত৷ তাই সীমিত পার্থিব সম্পদ---যা-ই সে পাবে, তাতে সে সন্তুষ্ট নয়৷ সে আরও চাইবে৷ এইটাকে কেন্দ্র করেই যত লড়াই, যত দুর্নীতি, যত শোষণ, যত অপরাধ৷

হ্যাঁ ঠিক, যার জীবনের নূ্যনতম চাহিদার অর্থাৎ বাঁচার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন---অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, আবাস প্রভৃতি---তা যাদের মেটেনি, তাদের সেটা চাওয়াটা মোটেই অপরাধ নয়৷ সমাজে এই নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারাণ্টী না থাকার কারণেও লড়াই, দুর্নীতি, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে৷ কিন্তু সমাজে যাদের এই নূ্যনতম চাহিদা পূরণ হয়েছে, তারাও তো দুর্নীতি পরায়ণ, শোষক, অপরের ন্যায্য অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে তৎপর৷ বরং অর্থনৈতিকভাবে এই সচ্ছল মানুষগুলোই অনেক অনেক বেশি দুর্নীতিপরায়ণ, শোষণকারী ও লুঠেরার ভূমিকা নিয়ে চলছে৷

তাদের অপরাধ দু’রকমের৷ প্রথমটা এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক বিশ্বস্রষ্টা৷ তিনিই সবার পিতা৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে সমস্ত সম্পদে সকলের অধিকার রয়েছে৷ মানুষের উচিত, জগতের সম্পদ সবাই মিলে মিশে ভোগ করা৷ কিন্তু তা না করে নিজের, ব্যাপক অর্থে, ভাই-বোনদের অভাবে শুকিয়ে মরতে দেখে নিজেরা নিশ্চিন্তে আত্মসুখে মগ্ণ৷ এটা একটা অপরাধ৷ কর্তব্য পালন না করার অপরাধ৷ আর একটা অপরাধ, ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করার অপরাধ---যা অত্যন্ত মারাত্মক৷ এই দুই অপরাধই মানুষ হিসেবে মানুষের কর্তব্য না করার অপরাধ৷ কেননা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলাই মনুষ্যত্ব৷ এইটাই হ’ল সমসমাজতত্ত্ব৷ কেবল আত্মসুখে মগ্ণ থাকা---আত্মসুখতত্ত্ব প্রকৃত মানুষের ধর্ম নয়---নৈতিকতা-সম্মত নয়৷ সমসমাজ- তত্ত্বইপ্রকৃত মানুষের ধর্ম---এটাই নৈতিকতার গোড়ার কথা৷

এটাই মূল নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ৷ আমরা এই মূল্যবোধটুকু হারিয়ে ফেলছি, এইভাবে নৈতিকতার দিক থেকে---মনুষ্যত্বের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়ছি৷ এই নীতিহীনতা, মনুষ্যত্বহীনতা থেকে মানবসমাজকে বাঁচাতেই হবে৷

তার পথ কী? তার পথ ব্যাপক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ সমাজের সর্বস্তরে স্কুল-কলেজের শিক্ষা থেকে শুরু করে সেমিনার, সভা-সমিতি, সমস্ত গণমাধ্যম---পত্র-পত্রিকা, আকাশবাণী, দুরদর্শন, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী কর্মসূচীর মাধ্যমে আজ ব্যাপক নৈতিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান প্রয়োজন৷  এটাও মনে রাখতে হবে, আধ্যাত্মিকতা নৈতিকতার ভিত্তি৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া নৈতিক শিক্ষা---কেবল ‘এটা কর, ওটা কর-না’ এই নীতিশিক্ষা দৃঢ়তা লাভ করবে না৷ আধ্যাত্মিকতাহীন  নৈতিকতা যে কোনো মুহূর্ত্তে সামান্য ধাক্কায়, প্রবৃত্তি বা প্রলোভনের ঝড়ে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে৷

আধ্যাত্মিকতা মানে রিলিজিয়ন নয়, সাম্প্রদায়িক ধর্মমত নয়৷ আধ্যাত্মিকতা হ’ল মনকে ক্ষুদ্র জড়মুখী না করে ভূমামুখী করা, অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের দিকে ধাবিত করা৷ এর জন্যে চাই অনুশীলন৷ সনিষ্ঠ অনুশীলন৷ মনকে সীমিত জড় ভোগ্যবস্তুর মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তাকে অনন্ত ভূমা সত্তার মধ্যে পরিব্যাপ্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে৷ ঋষিরা বলেছেন, ‘নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম্‌’৷ এই সত্য বুঝতে হবে---উপলব্ধি করতে হবে, ‘অল্প পার্থিব সম্পদে প্রকৃত সুখ বা শান্তি নেই, ভূমাতেই প্রকৃত শান্তি---প্রকৃত আনন্দ’৷ ভূমাই আনন্দস্বরূপ৷ সেই আনন্দ’ পাওয়ার জন্যে সবাইকে চেষ্টা করতে হবে৷ তাহলে ‘লোভ-প্রলোভনে’র মরীচিকার বিভ্রান্তি থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারবে৷

আর সেই বোধ যত জাগবে ততই আত্মস্বার্থের সংকীর্ণ গণ্ডী ছেড়ে মানুষ সমষ্টিস্বার্থের কথা ভাবতে অভ্যস্ত হবে৷ শুধু ‘নিজে বাঁচ’ নয়, ‘বাঁচ ও বাঁচাও’ এই ‘সমবায়’ নীতি নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে প্রকৃত ‘উন্নয়নে’র পথ ধরে সবাই এগিয়ে চলতে হবে৷