বাঙালীর মুক্তি ও বন্ধনে বাংলাভাষার ভূমিকা

লেখক
খগেন্দ্রনাথ দাস

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে,  যে ভাষার যত প্রতিপত্তিই থাক না কেন অন্য অনেক কিছুর মত ভাষারও জন্ম ও মৃত্যু আছে৷’ (বর্ণ বিজ্ঞান, প্রভাতরঞ্জন সরকার, পৃঃ৩) কিন্তু একটি ভাষার মৃত্যুর পরেও তার ছাপ রেখে যায় একদা সেই ভাষা এই নির্ভরতা কতটা ফলপ্রসু তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে বাংলাভাষার বহু প্রথিতযশা সাহিত্যিকগণের সৃষ্টিরাজি৷ এহো বাহ্য, উপনিষদ ছাড়া তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কল্পনা করাই অসম্ভব৷ উপর্যুক্ত সাহিত্যিকগণের সৃষ্ট সাহিত্য বাংলাভাষার উৎসভূমির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত বলেই তাঁদের সৃষ্টিরাজি এতটা সমৃদ্ধ হতে পেরেছে, একথা অত্যুক্তি নয়৷ একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, ভাব যত উন্নত, উচ্চ, মহৎ সে ভাবকে প্রকাশ করার জন্য ভাষাও ততটাই সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন৷ অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ভাষার শব্দভাণ্ডারও গুণগত বিচারে যথেষ্ট সমৃদ্ধ না হলে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়৷ যে ভাষার  শব্দভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ সে ভাষাও তত উন্নত৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, নৈবেদ্য, সোনারতরী কাব্য বা তাঁর ধর্ম, শান্তিনিকেতন, আত্মশক্তি অন্তর্গত প্রবন্ধগুলিতে কবি যে ধরণের শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন তা অন্যরকম হলে তিনি কি ওই সমস্ত বিষয় ব্যক্ত করতে পারতেন? ভাব যেমন,তাকে প্রকাশ করার জন্য সে তদনুরূপ ভাষা ও শব্দাবলী দাবি করে৷

একটি ভাষায় কত মানুষ কথা বলেন তা দিয়ে সেই ভাষায় রচিত সাহিত্যের গুণাবলীর নিরিখে৷ তথাপি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ যা আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ করেছি৷ এখানে একথাও বিচার্য যে, ধর্ম ও ভাষা এই দুইয়ের মধ্যে মানুষ কোনটিকে অধিক গুরুত্ব দেবে? উত্তর-অবশ্যই ভাষাকে৷ কারণ ধর্ম মানুষের সৃষ্টি আর ভাষা প্রকৃতি সৃষ্ট৷ মানুষের চেয়ে প্রকৃতি অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী৷ ধর্ম যে কোন সময় পরিবর্তন করা যায় কিন্তু ভাষা, সেভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়৷ উদাহরণ স্বরূপ ইসলামের আগমনের আগেও বাংলায় বাংলাভাষা ছিল৷ বাংলার বহু মানুষ তাঁদের ধর্ম পরিবর্তন করিয়েছেন কিন্তু ভাষা পরিবর্তন করাতে পারেন নি৷ অবশ্য নতুন ধর্মের আগমন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অধিক সুগম হওয়ার ফলে বাংলাভাষার শব্দ ভাণ্ডারে উর্দু, আরবি, হিন্দি,ইংরেজি ভাষার শব্দের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে৷ ‘ধর্ম মানুষের সংস্কৃতিকে বহু পরিমাণে প্রভাবিত করে’ (হিন্দু ধর্ম, ক্ষিতিমোহনসেন, প্রস্তাবনা দ্রষ্টব্য) আর সংস্কৃতির বহু বিষয় ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ অর্থাৎ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি বহু পরিমাণে ভাষাকেও প্রভাবিত করে৷ এর পরিণতি ভাল কী মন্দ তা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে বিচার করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু এরফলে একটি নির্দিষ্ট ভাষা তার মূল ধারা থেকে ক্রমে সরে যাবে এটা নিশ্চিত৷

বর্তমানের বাংলা ভাষা সে বিচারে বহুমুখী আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে৷ হিন্দী, উর্দু-আরবী ও ইংরেজী--- এই সমস্ত ভাষা বিভিন্নভাবে বাংলাভাষাকে প্রভাবিত করছে৷ এই প্রভাবিত করার (যাকে আক্রমণ বলাই যুক্তিসঙ্গত) কারণ এবং প্রতিকারও ভিন্ন ভিন্ন৷ ইংরেজি আগ্রাসনের কারণ প্রধানত কর্ম সংস্থানজনিত৷ বাজার অর্থনীতির সুবাদে কর্মসংস্থানের বড় অংশ ব্যক্তিগত খণ্ডের বহুজাতিক সংস্থার উপর নির্ভরশীল৷ আর বহুজাতিক কোম্পানির প্রথম পছন্দ ইংরেজি৷ এর আরও একটি দিক রয়েছে, নিজেকে স্মার্ট করে তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টাতেও ইংরেজির প্রতি আস্থাশীল৷ যদিও এতে ইংরেজের একটা খোলস গায়ে জড়িয়ে কিছু পরিমাণে ইংরেজ হওয়ার আত্মগৌরব লাভ করা যায় কিন্তু ইংরেজি জানা বা ইংরেজী সাহিত্যের রসাস্বাদন সম্ভব হয় না৷ সেটি হলে অবশ্যই ভাল হত৷ বরং হচ্ছে ঠিক তার উল্টো কতকটা হাসজারু ধরনের কিম্ভূতকিমাকার, বাঙালি সমাজের মধ্যেই একটা স্বতন্ত্র সমাজ গড়ে উঠছে৷ এরচেয়েও ভয়ঙ্কর হিন্দীর আগ্রাসন অথবা যাকে বাঙালীর অহেতুক হিন্দী প্রীতি বলেও আখ্যা দেওয়া যায়৷ গরীব মানুষ সাধারণত তার চেয়ে বিত্তশালীর উপর সাহায্যের জন্য নির্ভর করে৷ বাংলা ভাষার  চেয়ে হিন্দী কোন দিক থেকেই সম্পদশালী নয়  অথচ বাঙালী আজ ভাষার ক্ষেত্রে বহু পরিমাণে হিন্দীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বাঙালীর চলায় -বলায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে৷ এই হিন্দী নির্ভরতার একাধিক  কারণ রয়েছে৷ এক সরকারী আনুকূল্য লাভের প্রয়াস৷ কিন্তু হিন্দী ভাষার প্রচার প্রসারের জন্য  কেন্দ্রীয় সরকার বিগত ৭৫ বছর ধরে  অর্থ বরাদ্দ করে এসেছে তার সিকি ভাগও বাংলা সহ ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলির জন্য করেনি৷ দুই, হিন্দী চলচ্চিত্র এই ভাষাটিকে প্রচার করার ক্ষেত্রে এক বড় ভূমিকা পালন করে এসেছে৷

অবশ্য যদিও ইংরেজি ও উর্দুর যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হিন্দী ভাষারও নাভিশ্বাস উঠছে৷ সুতরাং বাংলাভাষার কবি,সাহিত্যিক, নাট্যকার চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক অভিভাবক, সকলকেই অত্যন্ত সচেতনভাবে হিন্দী, উর্দু বা আরবি ভাষার উপর নির্ভর না করে সংস্কৃত ভাষার উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়াস করতে  হবে৷ সংস্কৃত মৃত ভাষা, দেব ভাষা ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখলে সংস্কৃত ভাষার আরও অধিক ক্ষতি হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই৷ বরং বিষয়টি ঠিক তার উল্টো৷ গরুর বাছুর কোন কারণে মায়ের দুধ না পেলে গোমাতার মনে সাময়িক কষ্ট হলেও হতে পারে কিন্তু বাছুরের মৃত্যু সুনিশ্চিত৷ ঠিক তেমনি বাংলাভাষা সংস্কৃত থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে তারও অকাল মৃত্যু নিশ্চিত৷

বাংলাভাষার সামনে আর এক বিপদ ধর্মীয় বিভাজনজনিত৷ বাংলাভাষা যখন  পূর্বী অর্দ্ধমাগধীর গর্ভ থেকে প্রসবিত হচ্ছিল তখন ইসলাম ধর্ম এদেশে আসেনি৷ ফলে সেদিনের  সেই নবজাতক  ছিল মূলত মায়ের উপর ও আংশিকভাবে কিছু দেশজ শব্দের উপ নির্ভরশীল৷ পরবর্তী সময়ে ইসলামের আগমন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাভাষার সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি ও শব্দের সংমিশ্রণ ঘটাতে থাকে৷ ‘চোখের জল’ স্বাভাবিক নিয়মেই ক্রমশ হয়ে উঠে ‘চোখের পানি৷’ কিন্তু এতে ‘চোখের জলে নাকের  জলে ’ এই্‌ প্রবাদবাক্যের কী হবে? আবার পানী অর্থাৎ ‘‘যা পান করা উচিত৷’ শব্দ থেকে  বাংলায় ‘পানী’ শব্দ এসেছে তাই ‘পানী’ বলা চলবে না৷ যে জল পান করা চলে কেবল-তাই ‘পানী’ (লঘুনিরক্ত শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার পৃঃ ৩৫৩)৷ তাই চোখের পানি’ লেখাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত সে বিচার ভাষাবিদগণ  করবেন৷

আমরা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাইছি, সেটি এই যে, আমরা বাংলাভাষাকে তার মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে অকাল মৃত্যুর দিকে যেন ঠেলে না দিই৷ আমরা এই বিষয়েও সম্পূর্ণ সচতেন যে,ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করাটা অবাস্তব৷ পৃথিবীর উন্নত ভাষাগুলি আকছার একে অপরের শব্দগ্রহণ করছে৷ আর এই গ্রহণের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে না৷ কিন্তু নানা কারণেই বাংলাভাষার এই মূল দিয়ে উভয়েই সমৃদ্ধ হচ্ছে বিপন্ন বোধ করছে না বা বিনষ্টির দিকেও এগুচ্ছে না৷ কিন্তু নানা কারণেই বাংলাভাষার এই মূল থেকে ক্রমশ সরে আসা অশুভ ঈঙ্গিত বহন করছে বলেই অনেকে মনে করেন৷ একটা সময় হয়তো এমন হবে যে, বাংলা বাক্য বাংলা শব্দের পরিবর্তে শুধুই হিন্দী, উর্দু আরবি বা ইংরেজি শব্দ দিয়ে বাংলা অক্ষরে লেখা হবে৷

বাংলাভাষার জন্য আরও একটি অশুভ সঙ্কেত তার উপভাষা ও বিভাষা সমূহ৷ বাংলার কোন কোন উপভাষা এমনও দাবি তুলছে যে, তাঁরা যে উপভাষায় কথা বলেন সেটি উপভাষা নয় এই পূর্ণাঙ্গ ভাষা৷ এই আত্মঘাতী বিশৃঙ্খলা রোধ করার জন্য  ভাষা উপভাষার সীমা নির্র্ধরণ করে বাংলাভাষার সাহিত্য সৃষ্টির  জন্য একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা আকৃতি বেঁধে দেওয়া৷  কলকাতা ও তৎসংলগ্ণ অঞ্চলের  কথ্য ভাষাটিই একসময় বাংলাভাষার  লেখ্যরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ আর আজ, আকছার উপভাষাগুলিতেও লেখালেখি হচ্ছে৷ এমন কী অসমের বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ ময়মনসিংহের উপভাষাকে ‘মিঞা ভাষা’ নাম দিয়ে গল্প কবিতা লিখছেন, আর দাবি করছেন যে,  এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা৷

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে প্রতিজন বাঙালির অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়৷ তাদের এই স্বীকৃতি কোনভাবেই অতিরঞ্জিত নয় অতি বাস্তব৷ এখন এই বাস্তবতাকে ধরে রাখার জন্য সঠিক পথ ধরে চরৈবেতি চরৈবেতি করে এগিয়ে চলা৷ ঋষিতুল্য সাহিত্যিকগণ বলেন যে, ‘সমাজ সংস্কার করার দায়িত্ব সাহিত্যিকের নয়৷’ কিন্তু একথা অস্বীকার করার কি কোন উপায় আছে যে, কবি রজনীকান্ত সেন এর গান---’’ মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা---’’

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবীদের হৃদয়ে প্রেরণার প্রবলস্রোত বইয়ে দিয়েছিল? শুধুই কি রজনীকান্ত,  অগ্ণিযুগের প্রত্যেক সাহিহিত্যকের রচনা কোন না  কোনভাবে  স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে৷ যেমন ফরাসী বিপ্লবের অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য করা হয়---জঁ জাক রুশো, মিরাবো ও ভলতেয়ারের মত সাহিত্যিকদের৷ উভয় বাংলার বর্তমান ক্ষয়িষ্ণুতার প্রতি লক্ষ রেখে আরও একটি রেঁনেশাঁ, অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের আশু প্রয়োজন বলে বাংলার বহু বিদ্বজ্জন অনুভব করেন৷ আর তেমন একটি স্বপ্ণকে সাকার করতে, ভারত তথা বিশ্বকে পথ দেখাতে, বাংলাকে, বাঙালী জাতিকে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে বিশ্বসভায়  একটি  উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করাতে সাহিত্যিকদেরই তো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে! আর তাঁদের এই কাজে সহায়ক হবে উন্নতমানের বাংলাভাষা  ও সাহিত্য৷ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক জয় হোক বাংলা ও বাঙালীর৷