বাঙলার সম্পদেই বাঙলার উন্নয়ন সম্ভব

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

১৩ই অক্টোবর নোতুন পৃথিবীতে প্রবীন প্রাউটিষ্ট নেতা শ্রীপ্রভাত খাঁ বলেছেন,‘‘বাংলার উন্নয়নের জন্য দিল্লীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না৷ বাংলার সম্পদেই বাংলার উন্নয়ন সম্ভব৷ প্রকৃতির অকৃপণ দানে বনজ,কৃষিজ, জলজ, খনিজ কোন সম্পদেরই বাংলায় অভাব নেই৷’’ অতীব সত্যকথা৷

পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রধান কৃষি ফসলগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে ঃ (ক) খাদ্য ফসল,(খ) অর্থকরী ফসল,(গ) বাগিচা ফসল৷

(ক) খাদ্যফসল ঃ ধান ঃ ধান পশ্চিমবঙ্গের প্রধান কৃষি ফসল৷ আমন, আউশ, বোরো---পশ্চিমবঙ্গে এই তিনপ্রকার ধান জন্মে৷ আপন ধানের চাষই বেশি হয়৷ মেদিনীপুর জেলা আমন ধান উৎপাদনে প্রথমস্থানের অধিকারী৷ আউশ ধান উৎপাদনে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রথম৷ বর্ধমানে বোরো ধানের চাষ সর্বাপেক্ষা বেশী৷ পশ্চিমবঙ্গে ধান উৎপাদন হয় প্রায় ১১১৮ লক্ষ মেঃটন৷ গমঃ সবচেয়ে বেশি গম চাষ হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায়৷ এছাড়া গম উৎপাদক জেলাগুলি হলো নদীয়া, বীরভূম, মালদহ, দার্জিলিং ও বাঁকুড়া৷ ১৯৯৪-৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন হয় ৬.৩৫ লক্ষ টন৷ ভুট্টাঃ পশ্চিমবঙ্গে অধিক বৃষ্টিপাত সম্মন্ন জেলা-যথা দার্জিলিং এর তরাই অঞ্চল, কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় ভুট্টার চাষ অধিক হয়৷ যবঃ খাদ্যশস্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে যবের তেমন চাহিদা নেই৷ মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলাতে বেশির ভাগ যব উৎপাদিত হয়৷ নদীয়া, জলপাইগুড়ি বর্ধমান জেলাতেও অল্পবিস্তর যবের চাষ হয়৷ জোয়ার ঃ জোয়ারেরও চাহিদা খাদ্যশস্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে কম৷ সাধারণতঃ এর চাষ হয় পশুখাদ্য হিসাবেই৷ মালদহ, বীরভূম, বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, কুচবিহার, মুর্শিদাবাদ জেলায় কমবেশি জোয়ারের চাষ হয়ে থাকে৷ ডালঃ পশ্চিমবঙ্গে ডালের চাহিদা অত্যধিক৷ ধান কাটার পর ঐ জমিতে ডাল চাষ হয়ে থাকে৷ ডাল উৎপাদক জেলাগুলি হলো নদীয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, পশ্চিম দিনাজপুর প্রভৃতি জেলা৷ মুগ, মুসুর, কলাই ছোলা---আরো অনেকরকম ডাল উৎপন্ন হয়৷ ১৯৯৪-৯৫ সালে ৩.১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে ডাল উৎপন্ন হয় ২.০৮ লক্ষ মেঃটন৷  পাটঃ পশ্চিমবঙ্গে অর্থকরী ফসল হিসাবে ধানের পরেই পাটের স্থান৷ সর্বাধিক পাট উৎপন্ন হয় মুর্শিদাবাদ আর নদীয়া জেলায়৷ এছাড়া বর্ধমান, ২৪পরগণা, হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহ, পশ্চিমদিনাজপুর, কুচবিহার প্রভৃতি জেলাতেও পাট চাষ হয়৷ ইক্ষু ঃ সবচেয়ে বেশি ইক্ষু চাষ হয় নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলাতে৷ এছাড়া বীরভূম, বর্ধমান ও মালদহ জেলাতেও যথেষ্ট ইক্ষু চাষ হয়৷ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ইক্ষু উৎপন্ন হয় ১২০ হাজার মেট্রিকটনের বেশি তো কম নয়৷ তৈলবীজঃ পশ্চিমবঙ্গে তৈলবীজের মধ্যে প্রধান সরিষা ও রাই৷ এছাড়া আরো আছে তিল, তিসি, চীনাবাদাম প্রভৃতি৷  উৎপাদক জেলাগুলো হলো---নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার৷ বছরে তৈলবীজের মোট উৎপাদন ৪ লক্ষ ৪হাজার মেট্রিক টন৷ তামাক ঃ উৎকৃষ্টমানের না হলেও পশ্চিমবঙ্গের তামাক একটি অর্থকরী ফসল৷ তামাকের চাষ হয় কুচবিহার জলপাইগুড়ি পশ্চিম দিনাজপুর ও নদীয়া জেলায়৷

(গ) বাগিচা ফসল ঃ চাঃ চা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক ফসল৷ দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলায় চায়ের চাষ হয়৷ বছরে চা উৎপাদনের পরিমাণ মোটামুটি ১৬৮২ লক্ষ কেজি৷ ভারতের মোট উৎপন্ন চায়ের প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ এখানে প্রস্তুত হয়৷ চা রপ্তানি করে প্রতিবছর ভারত প্রচুর বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে৷ সিঙ্কোনাঃ কুইনান প্রস্তুত হয় সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে৷ বলা যেতে পারে কুইনানই ম্যালেরিয়া রোগ নির্মূল করেছে৷ কুইনাইন উৎপাদনের জন্য দার্জিলিং জেলার মংপু বিখ্যাত৷ তুঁতগাছ ঃ তুঁতগাছের চাষ হয় রেশম-কীট পালনের জন্য৷ রেশম উৎপাদন হয় গুটি পোকা থেকে৷ পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক তুঁতগাছের চাষ হয় মালদহে৷ এছাড়া, পশ্চিম দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলাতেও তুঁতগাছের চাষ হয়ে থাকে৷ ফলঃ পশ্চিমবঙ্গে হরেকরকম ফল উৎপন্ন হয়৷ মুর্শিদাবাদ ও মালদহ তো আমের জন্য বিখ্যাত৷ দার্জিলিং এর কমলালেবু শীতকালে বাজার ছেয়ে যায়৷ এছাড়া, হুগলী, হাওড়া ও ২৪পরগণা জেলায় কলা, পেয়ারা, জাম,আম, তরমুজ, লিচু-আরো কত যে ফল উৎপন্ন হয় তা ইয়ত্তা নেই৷

খনিজ সম্পদ ঃ কয়লা ঃ কয়লা উত্তোলনে বিহার ও মধ্যপ্রদেশের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান তৃতীয়৷ ভারতে উৎপাদিত কয়লার ৩০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গেই পাওয়া যায়৷ পশ্চিমবঙ্গে বছরে প্রায় ২কোটি টন কয়লা উত্তোলিত হয়৷ ফায়ার-ক্লে ঃ ফায়ার-ক্লে অর্থাৎ অদাহ্য মাটি উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের স্থান তৃতীয়৷ ফায়ার-ক্লে দ্বারা যে ইট প্রস্তুত হয় সেই ইট ইস্পাত চুল্লি গাঁথার কাজে লাগে৷  চিনামাটি ঃ চিনামাটি পাওয়া যায় বীরভূমের মহম্মদ বাজার আর বাঁকুড়া মেজিয়ায়৷ কাপ প্লেট তৈরী, মৃৎশিল্প, রবার শিল্প,বয়ন শিল্প, কাগজ শিল্প ও রং শিল্পে এর ব্যবহার হয়ে থাকে৷ চুনাপাথর ঃ সিমেন্ট শিল্পে ব্যবহৃত হয় চুনাপাথর৷ এই চুনাপাথর পাওয়া যায় পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায়৷ ডলোমাইট ঃ লৌহ ও ইস্পাতশিল্পে ডলোমাইট অপরিহার্য৷ এই ডলোমাইট পাওয়া যায় জলপাইগুড়িতে৷ উলফ্রাম ঃ ইস্পাতকে শক্ত করার জন্য উলফ্রাম ব্যবহৃত হয়৷ উলফ্রাম পাওয়া যায় বাঁকুড়া জেলায়৷ ম্যাঙ্গানিজ ঃ ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া যায় মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ী অঞ্চলে৷ ম্যাঙ্গানিজ ব্যবহৃত হয় লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে৷

শক্তিসম্পদ ঃ তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ---এই দুইপ্রকার বিদ্যুৎ শক্তি পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত হয়৷ পশ্চিমবঙ্গে কয়লার প্রাচুর্যের জন্য তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন যথেষ্ট হয়৷ উৎপাদিত বিদ্যুতের  মধ্যে ৯৮ শতাংশ তো তাপবিদ্যুৎ৷ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অধীনস্থ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো---ব্যাণ্ডেল, সাঁওতালদি, গৌরীপুর, দিশেরগড়, বেলুড়,হাওড়া ও কোলাঘাটে অবস্থিত৷ আর দুর্গাপুরে আছে দুর্গাপুর প্রোজেক্টে লিমিটেড সংস্থার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এছাড়া কলকাতা বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্র্পেরেশন-এর অধীনস্থ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো হল--- টিটাগড়, মূলাজোড়, কাশীপুর ও মেটিয়াবুরুজ৷ এছাড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট৷ ১৮৯৭ সালে ভারতে প্রথম জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা রূপায়িত হয় পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিং জেলার সিদরাপঙ নামকস্থানে৷ আর আছে জল ঢাকা বিদ্যুৎ প্রকল্প, ময়ূরাক্ষী প্রকল্প, দার্জিলিং-এর ছোট রঙ্গীত প্রকল্প, বিজনবাড়ির জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মাইথন বাঁধের বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গে সরবরাহ করা হয়৷ বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাবার জন্য গড়ে উঠেছে কোলাঘাট, ডালখোলা ও ফরাক্কায় নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ অতএব, যে রাজ্যের সম্পদ-ভাণ্ডার এতো সমৃদ্ধ সে রাজ্যের পক্ষে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক  অঞ্চল  হতে বাধা কোথায়?