ঋগ্বেদ মুখ্যতঃ স্তুতি সম্বন্ধীয় হলেও তাতেও অন্যান্য কথা ও কথনিকা রয়েছে৷ সেই সকল কথা ও কথনিকার সকল অংশ সমান আধ্যাত্মিক মূল্য বহন না করলেও তারা সুপ্রাচীন মানব ঐতিহ্যের প্রতিভূ......ক্রমঃদ্রুতিতে অগ্রসৃত মানব–মননের তথা সমাজ–সংরচনার একটি আলেখ্য৷ সেদিক দিয়ে বিচারে ঋগ্বেদ ভাষা, সাহিত্য ও অভিব্যক্তির জগতে বিশেষ মূল্য বহন করে৷ ঋগ্বেদীয় যুগে লিপি ছিল না সত্য কিন্তু ধবন্যাত্মক অক্ষর ও আক্ষরিক ব্যাহৃতি তথা ধবনিবিক্ষেপ.....প্রক্ষেপ ও উপন্যাস–রীতি (উপস্থাপিত করবার পদ্ধতি) ছিল৷ ঋগ্বেদে বিভিন্ন অক্ষরের জন্যে স্বতন্ত্র উচ্চারণ–রীতিও প্রচলিত ছিল যা ঋগ্বেদের অনুগামীরা পরবর্তীকালে গুরুপ্রমুখাৎ শিখে নিতেন৷ আমাদের ভাষা–সম্বন্ধীয় পুস্তকসমূহে আমি সে সম্বন্ধে কোথাও কোথাও অল্প–বিস্তর উল্লেখ করেছি৷ সুবিধা হলে বারান্তরে তা নিয়ে আরও আলোচনা করব৷
বেদে, বিশেষ করে ঋগ্বেদে ঋক্ ও সূক্তগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রেও একটা বিশেষ নিয়ম পরিদৃষ্ট হয়৷ সাধারণতঃ যে ঋকে পরমপুরুষকে যে নামে সম্বোধন করা হয়েছে ঋক্টির নামও তদনুযায়ী হয়৷ কোন বিশেষ নামে পরমপুরষকে সম্বোধন না করলে সূক্তের ও কোন কোন ক্ষেত্রে ঋকেরও নাম প্রথম শব্দটির সাহায্যে করে নেওয়া হয়ে থাকে৷ তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে–ঋক্গুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ বিশেষ ছন্দে রচিত হয়ে থাকে৷
ছন্দ মূলতঃ সাত প্রকারের–(১) গায়ত্রী, (২) উষ্ণিক, (৩) ত্রিষ্টুপ, (৪) অনুষ্টুপ, (৫) ক্ষৃহতী, (৬) জগতী ও (৭) পঙ্ক্তি৷ এছাড়া সেকালে সেইভাষায় (অর্থাৎ বৈদিক ভাষায়) কোন প্রামাণ্য ব্যাকরণ না থাকায়, যেখানে ছন্দের সঙ্গে তৎকালে প্রচলিত অলিখিত ব্যাকরণের কোন পার্থক্য দেখা দিতে, বিধি অনুযায়ী সেই অবস্থায় ছন্দের মর্যাদা রক্ষার জন্যে ব্যাকরণের নিয়ম লঙঘন করেও সুবিধাজনকভাবে কেটে–কমিয়ে–বাড়িয়ে বা ধবনি পরিবর্তন করেও কাজ চালাবার প্রথা বলবৎ ছিল৷
আমরা সাধারণতঃ যাকে গায়ত্রী মন্ত্র বলি ঋগ্বেদের সেই ঋক্টির (৩.১০.৬২) একটি স্বীকৃত নাম ‘সবিতৃ ঋক্’–গায়ত্রী মন্ত্র নয়৷ গায়ত্রী একটি ছন্দের নাম–মন্ত্র বা ঋকের নাম নয়৷ সংশ্লিষ্ট ঋক্টিতে পরমপুরুষকে ‘সবিতা’ - কেউ কেউ কন্যার নাম ‘সবিতা’ রেখে থাকেন৷ এটা অনুচিত৷ (‘সবিতৃ’ শব্দের প্রথমার একবচন) ‘সবিতা’ একটি পুংলিঙ্গবাচক শব্দ৷ ‘সবিতা’ অর্থ স্রষ্টা, জনক বা পিতা৷ ‘সবিতা’–র স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘সবিত্রী’–ণিজন্তে ‘সাবিত্রী’৷ সূর্য পৃথিবীর জনক৷ এজন্যে সূর্যকেও ‘সবিতা’ বলা হয়ে থাকে৷ক্ষ–(‘সূ’ ধাতু তৃণ্/তৃচ্ প্রত্যয় করে শব্দটি নিষ্পন্ন হচ্ছে) নামে সম্বোধন করা হচ্ছে৷ তাই ঋক্টির নাম হয়েছে ‘সবিতৃ ঋক্’৷ ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে একটি সূক্তের গোড়ার দিকে রয়েছে–
‘‘নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং
নাসীদ্রজো ন ব্যোমাপরো যৎ....’’
সূক্তটির গোড়ার দিকে ‘নাসদ’ শব্দ রয়েছে তাই সূক্তটির নাম ‘নাসদীয় সূক্ত’৷
প্রথমোক্ত সবিতৃ ঋক্টি রচিত হয়েছে গায়ত্রী ছন্দে৷ গায়ত্রী ছন্দে প্রতিটি লাইনে থাকে আটটি করে মাত্রা (syllable) সম্পূর্ণ হয় তিনটি লাইনে অর্থাৎ মোটমাট থাকে ২৪টি মাত্রা (syllable)৷ ঋক্টি হচ্ছে ঃ–
‘‘তৎসবির্তুর্বরেণ্যং
ভর্গোদেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’’৷
ঋক্টিকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই–দ্বিতীয় লাইইনে ৮টি মাত্রা (syllable) রয়েছে–(১) ভর্, (২) গো, (৩) দে, (৪) ব, (৫) স্য, (৬) ধী, (৭) ম, (৮) হি৷ তৃতীয় লাইনে রয়েছে ঃ (১) ধি, (২) য়ো, (৩) যো, (৪) নঃ, (৫) প্র, (৬) চো, (৭) দ, (৮) য়াৎ৷ কিন্তু প্রথম লাইনে দেখছি ৭টি মাত্রা–(১) তৎ, (২) স, (৩) বি, (৪) তুর্, (৫) ব, (৬) রে, (৭) ণ্যং অর্থাৎ একটি মাত্রা কম পড়ছে৷ তাই এক্ষেত্রে উচ্চারণ করবার সময় তৎকালের প্রচলিত অলিখিত ব্যাকরণ–বিধিকে উল্লঙঘন করেও উচ্চারণ করতে হ’ত ও আজও করতে হয়–(১) তৎ, (২) স, (৩) বি, (৪) তুর্ (৫) ব, (৬) রে, (৭) ণি, (৮) অং৷ মন্ত্রটির পূর্বে ‘ ওং ভূর্ভুবঃ–স্বঃ ওং’, সর্বশেষে আর একটি ‘ওং’ যুক্ত হচ্ছে৷ সেগুলি মূলতঃ ঋগ্বেদীয় নয়–অথর্ববেদীয়৷ পরমব্রহ্মের সপ্তলোকাত্মক বিকাশ ভূঃ ভুবঃ–স্বঃ–মহ–জন–মন্ত্রে এদের সামূহকি নাম ব্যাহৃতি৷ কিন্তু সপ্তলোকের জন্যে যেখানে সংক্ষেপে স্থূল–সূক্ষ্ম ও কারণ জগৎ অর্থে কেবল ভূ–র্ভুবঃ–স্বঃ–এই তিন লোকের নাম করা হয়ে থাকে, তখন তার জন্যে ‘মহাব্যাহৃতি’ শব্দটি ব্যবহৃত হ’ত৷ এগুলি ঋগ্বেদীয় মৌলিক সবিতৃ ঋকের অংশ বা অঙ্গ নয়৷ সবিতৃ ঋক্কে বৈবহারিক ক্ষেত্রে উচ্চারণ করবার সময় বলা হয়–
‘ ওং ভূ–র্ভুবঃ–স্বঃ ওং তৎসবির্তুর্বরেণ্যং৷
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওম্’’৷
এই মহাব্যাহৃতির সংযুক্তিতে সবিতৃ ঋকের অর্থৰোধ দৃঢ়তর হয়৷ সেইজন্যে এই সংযুক্তি৷ মহাব্যাহৃতির সংযুক্তিতে মন্ত্রটির অর্থ স্পষ্টীকৃত হয়ে দাঁড়ায়–‘‘এই ভূ–র্ভুবঃ–স্বঃ অর্থাৎ স্থূল–সূক্ষ্ম–কারণাত্ জগতে সবিতার অর্থাৎ পিতার বরেণ্য জ্যোতিকে আমরা ধ্যান করছি যাতে তিনি আমাদের ধী’–কে (ৰুদ্ধি–মেধাকে) সৎপথে পরিচালনা করেন৷ এই মন্ত্রটির সাহায্যে পরমপুরুষের কাছ থেকে অধ্যাত্ম জগতের দিক্–দেশনা প্রাপ্তির এষণা জাগিয়ে তোলাকেই বলা হয় বৈদিকী দীক্ষা৷ তৎ–পরবর্তীকালে মানুষ যখন আধ্যাত্মিক পথে চলবার সাধনামার্গের উপযুক্ত নির্দেশনা পায় সেই নির্দেশনাকে বলা হয় তান্ত্রিকী দীক্ষা৷ এই বৈদিকী দীক্ষা ঋগ্বেদীয় সবিতৃ ঋকের ওপর মোটামুটি ভাবে নির্ভরশীল ছিল বলেই কেবলমাত্র প্রাচীনত্বের গুণেই নয়, আধ্যাত্মিক মূল্যের কথা ভেবেও ঋগ্বেবেদকেই প্রধান বেদ হিসেবে প্রাচীনকালে মনে করা হ’ত, যদিও আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে বস্তুতান্ত্রিক জগতের সন্তুলন–সাধক হিসেবে যজুর্বেদের গুরুত্ব ঋগ্বেদকে ছাপিয়ে গেছল৷ ধবনিগত তথা উচ্চারণগত বিচারে যজুর্বেদ ঋগ্বেদ থেকে অনেকটা ভিন্ন৷ যজুর্বেদের বেশি মাখামাখি ছিল তন্ত্রের সঙ্গে৷ আর অথর্ববেদ তো প্রায় প্রতি পদবিক্ষেপেই তন্ত্রের সঙ্গে