বিভূতিভূষণ প্রসঙ্গে

লেখক
অভিজিৎ সেন

(শ্রদ্ধেয় অভিজিৎ সেন, তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে বিভূতিভূষণ সম্পর্কে সে অসাধারণ বত্তৃণতা করেছিলেন সেটির অনুলিখন করেছেন) রামকৃষ্ণ মণ্ডল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন (বি.এড.কলেজ)-এর বি.এড.বিভাগের শিক্ষার্থী কণিকা চক্রবর্তী৷

প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসতেন তিনি৷ তাই ছোট থেকেই জগতটাকে দেখতেন দুচোখ ভরে৷ উপভোগ করতেন পথের দৃশ্য, নজর এড়াতোনা মানুষের সুখ-দুঃখ৷ সাহিত্যে সেই ছাপই রেখে গেছেন বাংলা কথাসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷

বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভবঘুরে মানুষ৷ একেবারে গোড়ায় লেখা পড়া শুরু হয়েছিল তারই হাতে৷ তবে বছরের বেশিরভাগ সময়টা বাইরে বাইরে কাটত তাঁর৷ কাজ এবং ভ্রমণ দুই উদ্দেশ্যেই সেই স্বভাব পেয়েছিলেন পুত্র বিভূতিভূষণ৷ চিরকালই হেঁটে স্কুলে যেতেন অবশ্য সেটা দারিদ্র্যের কারণেই৷ তবে এই সময় পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতেন দু-চোখ ভরে৷ পথের সৌন্দর্য্যই তাঁর মনে প্রকৃতির প্রতি প্রেম জাগিয়ে তুলত৷ পরে এই ছাপ ফুটে উঠেছিল লেখায়৷

বিভূতিভূষণ-এর নিয়ে একটা মজার গল্প আছে৷ বিভূতিভূষণ-এর লেখাপড়ার গোড়ার দিনগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বর্ণপরিচয়৷ মাসের প্রথমেই সাড়ে সাত আনা পয়সা দিয়েই সে বর্ণপরিচয় কিনে রাখতেন মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার কাছে লেখা পড়া শুরু হয়েছিল বড়ো ছেলে বিভূতিভূষণ-এর৷ রোজ সকালে এক পয়সা দামের একটা বর্ণপরিচয় দিয়েই পড়া শুরু হত৷ সন্ধ্যার পরে সেই বইয়ের আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না৷ বাবার জেম্মা থেকে হরি রায়ের পাঠশালা, তারপরে হুগলী জেলার সাওগঞ্জ কেওটা, অবশেষে মহানন্দের কলকাতা বাসের কালে বৌবাজারের আর পুরী লেনের পাঠশালা এত দীর্ঘপথ পেরিয়ে সম্পন্ন হয় বিভূতিভূষণ-এর প্রাথমিক শিক্ষা৷ এর সঙ্গে পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার কাছে সংস্কৃতের মুগ্দবোধ ব্যাকরণ পাঠ৷ বিভূতিভূষণের স্কুলের নাম বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়৷ সেখানে ভর্ত্তি হওয়াটাও একটা গল্প৷ মহানন্দ বাড়িতে থাকতেন না৷ প্রবল অভাবের সংসারে ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার আশা পোষণ করতেন না মৃণালিনী দেবী অর্থাৎ বিভূতিভূষণ-এর মা৷ এদিকে বিভূতিভূষণ দেখতেন প্রতিবেশীর ছেলেরা বনগ্রামে গিয়ে স্কুলে ভর্ত্তি হয়৷ তাঁর ও খুব ইচ্ছে হল দ্বিধা কাটিয়ে কোনো এক ইংরেজী বছরের মাঝামাঝি গিয়ে ভর্ত্তি হলেন সেখানে৷ লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে সিঁদুর মাখানো টাকা নিলেন মৃনালিনী দেবীর হাত থেকে৷ কড়া নজর ছিল প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের৷ প্রথম দুদিন ভয়ে স্কুলে কমপাউণ্ড অবধি গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন বিভূতিভূষণ৷ তৃতীয় দিন তাকে ডেকে পাঠান প্রধান শিক্ষক৷ সিঁদুর মাখানো টাকা দেখে ঘটনা জানতে চান৷ জানার পরে ছাত্রের বেতন মাফ করে দেন৷ পড়াশোনা চলতে লাগল৷ তিনি যখন ক্লাস এইট, প্রয়াত হলেন পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে৷ ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ১৯১৮ সালে রিপন কলেজ থেকে ডিসটিংশন নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় পাস করেন বিভূতিভূষণ৷ তারপরে কিছুদিন এম.এ এবং ল ক্লাসে পড়েছিলেন৷ তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় বসিরহাটের মেয়ে গৌরী দেবীর সাথে বিয়ে হল তাঁর৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যেই মারা গেলেন গৌরী দেবী৷ বিভূতিভূষণ-এর পড়াশোনাতেও ইতি ঘটল৷ হুগলীর জাঙ্গীপাড়া মাইনর স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নিলেন৷ পরে জাঙ্গীপাড়া থেকে এসেছিলেন সোনারপুরের হরিনাভি স্কুলে৷ ইছামতিতে স্নান করতে গিয়ে ডুবে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ-এর বোন জাহ্ণবী দেবী৷ সেই ঘরের সূত্রেই প্রখ্যাত লেখকের ঠিকানা এসে পৌঁছায় ফরিদপুর জেলায় ছওগাও নিবাসী শরশীকান্ত চট্টোপাধ্যায়-এর দ্বিতীয় কন্যা রমা দেবীর কাছে৷ বাবার দেওয়া আকাশি নীল রঙের শাড়ি পরেই রমা দেবী দেখা করতে যান বিভূতিভূষণ-এর সঙ্গে৷ লেখক তখন বড়োই বিষন্ন৷ অটোগ্রাফ খাতায় সই করে লিখে দিলেন গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু, তারপর ২৯ বছর ব্যবধানের দুই মানব-মানবীর বন্ধুত্ব এবং চিঠি চালাচালি৷ রমা দেবী বিবাহের প্রস্তাব দিলেন৷ সময় চাইলেন বিভূতিভূষণ৷ মনে করিয়ে দিলেন প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর কথা৷ বোঝালেন নানাভাবে, বললেন আমার সাথে তোমার বয়সের তফাৎ অসম্ভব৷ তুমি না হয় ছেলেমানুষ বুঝতে পারছ না কিন্তু আমি একজন বয়স্ক লোক হয়ে কি করে তোমাকে ডোবাই৷ এমনকী এও বললেন দেখ৷ আমার গায়ের রোম এবং চুলে পাক ধরেছে৷ কিন্তু রমা দেবী নাছোড়৷ আপনাকে মাত্র দশদিনের জন্য স্বামী হিসেবে পেলে এই আমি ধন্য হয়ে যাব৷ ৩রা ডিসেম্বর,১৯৪০ সম্পন্ন হল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় বিবাহ৷ সাত বছর পর জন্ম হল পুত্র তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ বিভূতিভূষণ-এর প্রিয় ফল ছিল আম আর কাঁঠাল, ভালোবাসতেন চাঁপা, বকুল, শেফালি ফুল৷ বন্যফুলের মধ্যে পছন্দ করতেন ঘেঁটু আর ছোটো এরাঞ্চি, ঋজু বনস্পতিতেও আকর্ষণ ছিল তাঁর৷ গাছ আর মেঘমুক্ত রোদের দিনে দিগন্ত৷ এসব নিয়েই চলত তার পড়াশোনার নেশা৷ সাহিত্য পড়তেন সঙ্গে পড়তেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর উদ্ভিদবিদ্যা৷ শেষজীবনে নাকি পরলোকত্ব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন৷ পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন৷ তাই সারা বাড়িতে বইপত্র ছড়ানোই থাকত, আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন না৷ দৈনন্দিন রুটিনটাও ছিল ভারী মজার৷ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন৷ প্রবল গরম কিংবা শীত স্নান করতে যেতেন ইছামতী নদীতে৷ ফিরে লিখতে বসতেন৷ প্রথমে দিনলিপি, তারপর চিঠিপত্রের উত্তর৷ সাতটা নাগাদ প্রাতরাশ৷ ন’টা নাগাদ স্কুলের পথে যাত্রা৷ শোনা যায় গোপাল নগর উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে যাওয়ার সময় সদ্য ভাঙা গাছের ডাল বা বাঁশের কঞ্চি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে সঙ্গে যেতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জলযোগ সেরে ইছামতী অথবা বাওড়ের ধারে শক্তপোক্ত গাছের ডালের ওপর গিয়ে বসতেন৷ খানিকবাদে আবার পড়ানো৷ প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আসত তাঁর কাছে, পড়াতেন, গল্প করতেন, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে কোনো দিন আড্ডা দিতে যেতেন বাইরে৷ বাড়ি ফিরে সময়টা হয়তো একটা বেজে যেত৷ আর এই পুরো সময়টাই কৃতীতে নিরক্ষণ করতে তিনি৷ বিশেষত বিকেল ও বেশি রাতে গাছের ডালে বসে আকাশের বদলাতে থাকা রং দেখতেন ৷ গভীর রাতে দেখতেন গভীর কালো আকাশ৷ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়,---লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ আর সমস্ত দিব্যদৃষ্টির মতো এই দুটি প্রধান বিষয় বা বস্তু নিয়ে যা কিছু বলবার তা বলে গিয়েছেন৷ সেই দুইটি প্রধান বিষয় হল প্রকৃতি আর মানুষ৷ প্রকৃতির কথা কিছু হলেও মানুষ নিয়ে আরও ভয়ের কিছু বাস্তব চিত্র এঁকেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাইরে নরম কোমল মানুষটি কিন্তু ভেতরে ভেতরে শক্তই ছিলেন৷ সেইজন্য খুব কাছের মানুষদের জন্য উদাসীন হয়ে যেতেন৷ অনেক দিনের বন্ধু বিভূতিভূষণ সম্পর্কে এমনই ধারণা দিয়েছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী৷ স্বাধীনতার বছর তিনেক আগের কথা কলকাতায় মাঝে মধ্যেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে আর রাস্তায় দাঙ্গার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ একটি বালির বস্তার আড়ালে লুকিয়েছিলেন৷ তিনি শুকিয়ে কাঠ হয়ে ভয়ে বস্তাব পিছন থেকে কেবলই বন্ধু নীরদচন্দ্রকে বলেছিলেন, আমাকে ছেড়ে যেও না, ট্রামে তুলে দিও৷ কিন্তু যে মূহূর্তে ট্রাম এল নিরতচন্দ্র তাকে প্রায় রাস্তায় ঠেলে ফেলে দিয়ে বিভূতিভূষণ ট্রামে দৌড়ে উঠে গেলেন৷ একবার পিছন ফিরে তাকালেনও না৷ একবার এক বন্ধু বলেছিলেন, সন্ধ্যাবেলা ওয়েলিংটন স্কোয়ারে গেলে নাকি অ্যাংলা---ইণ্ডিয়ান প্রতি তাদের দেখা যাবে, তুমি যাবে? আমিও থাকব৷ বিভূতিভূষণ-এর বয়স তখন চল্লিশের বেশি৷ কথামতো নির্দিষ্ট সময় মতো তিনি সেখানে গিয়ে হাজির৷ নভেম্বর মাস শীতকাল, বেশ ঠাণ্ডা রয়েছে৷ বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর দেখলেন সব ভো-ভো৷ বন্ধুও নেই, তারাও নেই৷ রাতে গজগজ করতে করতে মেষে ফিরলেন৷ নীরদচন্দ্রের মতে, আসলে লেখার রসদ খুঁজতে তিনি জীবনটাকে এমন করেই চোখে দেখতে চাইতেন৷ তাই এসব কাণ্ড ঘটাতেন মাঝে মধ্যে৷ বি.এ পাশ করার পর প্রথম চাকরি পেয়েছিলেন হরিনাভ স্কুলে৷ কাজের ফাঁকে একদিন স্টাফ রুমে বসে আছেন একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বলল চলুন আমরা দুজনে মিলে বই লিখি৷ বিভূতিভূষণ কম বয়সী ছোকরার চাপল্য দেখে কথাটার কোনো গুরুত্বই দিলেন না৷ মনে মনে ভাবলেন বই তো দুরস্থ, কোনোদিন কোনো গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথাও আমার মনে আসেনি৷ পরের দিন স্কুলে পৌঁছে দেখেন যেখানে-সেখানে সাটা বিজ্ঞাপন৷ শীঘ্রই প্রকাশিত হইতেছে, শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস৷ ভাবলেন নিশ্চয়ই ওই টেপো ছোকরার কাজ৷ উপন্যাসের নামকরণও করে ফেলেছে সে ‘চঞ্চলা’৷ এদিকে সহকর্মীরা বিভূতিভূষণ-এর পিঠ চাপড়ে বললেন বাঃ মশাই আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি৷ কবে বেরোচ্ছে আপনার উপন্যাস? পরে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধু এবং ভ্রমণসঙ্গী যোগেন্দ্রনাথ সিংহকে বলেছিলেন, উপন্যাস তো দূরস্থ এমনকী তিনি যে আদও লেখক মন৷ বিজ্ঞাপনটা পুরো মিথ্যা একথা কাউকেই বলতে পারছেন না৷ প্রায়শই বিভূতিভূষণ তাঁর মুগ্দ পাঠিকাদের থেকে প্রেমপত্র গোছের চিঠি পেতেন ও বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতে, তিনি এইসব চিঠি ভালোই উপভোগ করতেন৷ সেইসব গল্প থেকে বেশ রসিয়ে বসিয়ে প্রাণের সখা নিরতসী চৌধুরীকে বলতেন৷ মির্জাপুর স্ট্রীটের এষ্টেটে আসার আগে হরিনাভি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ চাকরিটা ছাড়ার পেছনে একটা রোম্যান্টিক ঘটনা জড়িয়ে৷ ওই সময় তিনি স্কুলের কাছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন৷ তাদের একটি বিবাহযোগ্য তরুনী কন্যা ছিল৷ আড়ালে-আভাগে বিভূতিভূষণ-কে খেয়াল রাখত৷ বিভূতিভূষণ স্কুলে চলে গেলেই প্রায়শই মেয়েটি এসে এলোমেলো ঘরদোর গুছিয়ে দিত৷ বিভূতিভূষণ কিন্তু সব বুঝতে পারতেন৷ কিন্তু কিছু বলতেন না কারণ মেয়েটিকে তার বেশ লাগত৷ প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কখনই তার মন-মেজাজ ভালো থাকত না৷ ঠিকই তখনই এমন যত্নআত্তী তার ভালোই লাগত৷ মেয়েটি নিজেকে আমি আপনার দাসী সম্বোধন করে কয়েকটি চিঠিও লিখেছিল তাকে৷ কিন্তু হঠাৎ বিভূতিভূষণ ওই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন কারণ ওই মেয়েটির ওপর তিনি যতই মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন ততই বুঝতে পারছিলেন মেয়েটি কুলীন ব্রাহ্মণ, সমগ্রোত্রীয় নয়৷ কাজেই কোনো সম্পর্ক হলে পরিবার খুশি হবে না৷ আশে-পাশেও অনেক কথা হবে৷ এইসব ভেবেই তিনি কাউকে না জানিয়ে প্রায় লুকিয়েই কলকাতায় চলে আসেন৷ ফিরে এসে স্কুলে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন৷ পূজার ঠিক কয়েকদিন আগেই ঘাটশিলা চলে যেতেন বিভূতিভূষণ৷ ফিরতেন মাঘের শেষে৷ অথবা ফাল্গুনের গোড়ায়৷ আসলে তিরিশের দশকের শুরু থেকেই ঘাটশিলা আর গালুডির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর৷ পরে ঘাটশিলায় একটি বাড়িও কেনেন৷ প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর নাম দেন গৌরীকুঞ্জ৷ ১৯৪২ সালে ব্যারাকপুরে পুরোদস্তুর সংসারী হওয়ার পরেও ঘাটশিলায় গিয়ে মাস কয়েক তার অবসর যাপন চলতে থাকে৷ বছরের এই সময় সেখানে যেতেন তার সাহিত্যিক বন্ধুরা৷ প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বপতি চৌধুরী, গজেন্দ্র কুমার মিত্র, প্রবোধ কুমার সান্যাল৷ ছুটিটা ঘাটশিলাতে কাটত তাঁর৷ ফলে আড্ডা জমত আর সঙ্গে চলত প্রকৃতি দেখা, নির্জন এলাকায় একা একা ঘুরে বেড়াতেন৷ এতেল বেড়ের জঙ্গল, সুবর্ণরেখা নদী, পাণ্ডবশিলা, কাছিনদহ, রাতমোহনা ইত্যাদী জায়গা ছিল তার প্রিয়৷ শোনা যায় ফুলডুঙ্গরী পাহাড়ের পিছনে একটি পাথরের উপর বসে উপাসনা করতেন বিভূতিভূষণ৷ সামনেই তেমন একটা পাথর খণ্ড ছিল কূর্র্মকৃতি বলে বিভূতিভূষণ নাম দিয়েছিলেন কূমকূট৷ ঘাটশিলা তার এতই পছন্দ হয়েছিল যে, গজেন্দ্র কুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়কেও এখানে বাড়ি কিনিয়ে ছেড়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ততদিনে তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটা বেরিয়ে গিয়েছে৷ সময়টা ১৯৪৩-এর শেষদিক শীতকাল৷ বন-আধিকারিক যোগেন্দ্রনাথ সিংহের আমন্ত্রণে সারান্দার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ৷ সেই জঙ্গলে ভ্রমণ করার সময় লিখলেন ‘দেবযান’৷ মুগ্দ হয়েছিলেন এতটাই যে, একদিন রাত দেড়টা অব্দী জেগেছিলেন, মাথার উপর দ্বিতীয়ার চাঁদ, পাশে কোনা নদী৷ তার মধ্যে বসেই বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন---‘অরণ্যই ভারতের আসল বাপ’ সভ্যতার জন্ম হয়েছে এই অরণ্যে শান্তির মধ্যে৷ বেদ, আরণ্যক, উপনিষদ জন্ম নিয়েছে এখানে৷ এই শমাহিত স্তব্ধতায় নগরের কোলাহলের মধ্যে নয়৷ প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই চলে যান৷ তার বোন৷ দুই কাছের মানুষের মৃত্যুশোক অনেকটাই ভেঙে ফেলেছিল বিভূতিভূষণের মনকে৷ চলে এসেছিলেন কলকাতায়৷ একদিন টালিগঞ্জের কাছে দেখা পেলেন এক সন্ন্যাসীর৷ তার কাছ থেকে শুণলেন আত্মা তত্ত্বের ব্যাখ্যা৷ ঘোর চেপে গেল, শুরু হল তাঁর পরলোর চর্চা৷ সেই সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শিখলেন প্ল্যানচেট তথা মণ্ডল৷ এরপর এই পরলোক চর্চাই তাকে ঘিরে থাকে আমৃত্যু৷ এই পরলোক চর্চার নেশাতেই বিভূতিভূষণ যোগ দিলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে৷ এখানে তার আত্মা চর্চার প্রতি আগ্রহ আরও ঘন হল৷ জ্ঞান আরও বাড়ল৷ একাধিকবার নাকি তিনি প্ল্যানচেটে তার স্ত্রী গৌরী দেবীর সাথেও কথা বলেছেন৷ তার শোকে ভেঙে পড়েছেন কান্নায়৷ বিভূতিভূষণ এর আগেও বাংলার বহু রথী-মহারথী প্ল্যানচ্যাটে বিশ্বাসী ছিলেন৷ পরলোকচর্চার জন্য মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে৷ জাঙ্গীপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে তখন পড়াচ্ছেন বিভূতিভূষণ৷ সেখানেও শুরু হল তাঁর প্ল্যানচেটে কয়েকজন সঙ্গী সাথী জুটেও গেল৷ মাষ্টার প্রেতচর্র্চ করে জানাজানি হতেই স্কুলে ছাত্র কমতে শুরু করল৷ বেগতিক বুঝে স্কুল কর্তৃপক্ষ শেষমেষ তাড়িয়ে দিলেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে পরলোক চর্চায় ইতি টানেননি তিনি৷ দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণী দেবীর বাবা শরশীকান্ত ছিলেন তান্ত্রিক৷ তার কাছে থেকেও প্রেতচর্চা সম্পর্কে নানা কিছু জানতে চাইতেন৷ বিভূতিভূষণ তারানাথ তান্ত্রিকেও বোনা হয়েছে শ্বশুরমশাইয়ের কথা৷ ধীরে ধীরে এই চর্র্চ আড়াল আবডাল রেখে ঢুকে পড়তে লাগল তার উপন্যাস এবং গল্পে৷ এরপর এক ভৈরবীর কাছে শব সাধনার পাঠ নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন তার শেষ বয়স৷ শেষ বয়সে পরলোক চর্র্চ নিছক নেশা নয় তার কাছে৷ জীবনকে শুধু বস্তু পৃথিবীর গণ্ডিতে দেখতেন না৷ প্রেত-আত্মাদের সাথে নাকি নিয়মিত কথা বলতেন নিজের ঘোরে৷ অসুস্থ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে অদৃশ্য কাউকে বলছেন একে দেব না৷ এরপর অনেকেই মিলেই একসঙ্গে ঘুরতে গেলেন ফুলড়ুঙ্গরীর জঙ্গলে৷ হঠাৎ দলছুট হয়ে গেলেন৷ বনের মধ্যে দেখতে পেলেন একটা শববাহী ঘাট, একটা মৃতদেহ চাদর দিয়ে ঢাকা, চাদর সরাতেই চমকে উঠলেন বিভূতিভূষণ৷ এ দেহ যে তারই৷ তাঁর আত্মচিৎকার শুণে ছুটে এলেন বাকী সবাই৷ হয়তো হ্যালোসিনেশন কিন্তু এর কিছুদিন পরেই নশ্বর দেহ ত্যাগ করলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিনটা ছিল ১লা নভেম্বর,১৯৫০৷ বাংলার সাহিত্যের জগতকে অনাথ করে দিয়ে পরলোক গমন করলেন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷