সম্প্রতি কলকাতার তথাকথিত অভিজাত স্কুল নামে পরিচিত জি.ডি.বিড়লা স্কুলে সাড়ে চার বছরের এক শিশুর ওপর যৌন নির্র্যতন ঘটার পর একদিকে যেমন শিশুটির-স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তেমনি সারা দেশে ছেলেমেয়েদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা ও তাদের ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে শঙ্কিত৷
সম্প্রতি আবার অন্য এক স্কুল এম. পি. বিড়লা স্কুলেও সাড়ে তিন বছরের মেয়ের ওপর স্কুলের দুই শিক্ষাকর্মীর অনুরূপ যৌন নির্যাতনের খবর সামনে এসেছে৷ এই ঘটনাটি সেপ্ঢেম্বরে ঘটেছিল৷ থানায় যথারীতি ডায়রী করা হয়েছিল৷ অভিযুক্তদের ছবিও মেয়েটি চিহ্ণিত করেছে৷ কিন্তু তাদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি৷
বলা বাহুল্য, এমন ঘটনা বহু ঘটছে৷ এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের মনে তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে গভীর আতঙ্ক দেখা দেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার৷
সমস্যা যে কত গভীর তা সহজেই অনুমেয়৷ বিদ্যালয়গুলি হ’ল প্রকৃতপক্ষে মানুষ গড়ার কারখানা৷ শিশু তো একেবারে কাঁচা মাটির তালের মত৷ এই কাঁচামাটির তালকে দিয়ে মৃৎশিল্পী যেমন মূর্ত্তি গড়তে চাইবে তাই তৈরী হবে৷ বাঁদরও হতে পারে, সুন্দর মানুষও হতে পারে৷ এটা নির্ভর করবে শিল্পীর ওপর৷
তাই স্কুল-কলেজের (একেবারে লেখার প্রাইমারী থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত) শিক্ষক-শিক্ষিকা, সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের শিক্ষা-কর্মীদেরও দায়িত্ব অপরিসীম৷ স্কুল-কলেজে যে ধরণের মানুষ গড়া হবে--- তারাই ভবিষ্যতে সর্বদিক থেকে সমাজের কর্ণধার৷
তাই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকার (যে কোনও শিক্ষাকর্মীরও) নিয়োগের সঙ্গে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের অনেক তফাৎ আছে৷
কেননা, এখানে যাদের নিয়োগ করা হবে, তাদের হাতে ভবিষ্যৎ সমাজের কর্ণধার তৈরী হবে৷ কেননা ভবিষ্যৎ সমাজ তাদের কর্ণধারদের ওপর নির্ভরশীল৷
কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ সে দৃষ্টিতে করা হয় না৷ আর দশ-পাঁচটা ক্ষেত্রে যেমনভাবে কর্মী নিয়োগ করা হয়৷ এখানেও তাই করা হয়৷
প্রাউট-প্রবক্তা শিক্ষানীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘‘ শুধুমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাগত অভিজ্ঞানপত্র থাকলেই কাউকে শিক্ষকতা করার অধিকার দেওয়া হবে--- এমন কোন কথা নেই৷ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, ধর্মনিষ্ঠা, সমাজসেবা, পরার্থ পরতা, ব্যষ্টিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলীও থাকতে হবে৷’’
বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের এই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য তো দেখার কোনও ব্যাপারই নেই, উপরন্তু খঁুটির জোরে অত্যন্ত অযোগ্য মানুষও এই ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়৷ মোটা টাকার বিনিময়ে শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ বর্তমানে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু এর ভবিষ্যৎ যে কতটা ভয়ঙ্কর, তা বুঝতে এখন আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷
শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যকরণ বা সরকারীকরণ এর একটা বড় কারণ৷ শিক্ষাদান বা বিশেষ মহত্ব আছে এ ব্যাপারটি আজকের সমাজ পরিচালকের মাথাতেই নেই৷ যাঁরা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরাও যেমন অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মত মুনাফা অর্জনের উপায় বলে মনে করেন, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মীরাও তাদের এ কাজটিকে অন্যান্য চাকুরীর মতই মনে করেন৷ তাঁরা এটাকে কেবল অর্থ-রোজগারের উপায় রূপে ভাবেন এর বেশি কিছু নয়৷
আর সরকারী শিক্ষা-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তো শিক্ষাব্যবস্থার পুরোমাত্রায় রাজনীতিকরণ হয়েছে৷ রাজনৈতিক দলগুলির ধ্যান-জ্ঞান হয় ক্ষমতা অধিকার বা অধিকৃত ক্ষমতাকে যেন-তেন প্রকারে ধরে রাখা আর সেই লক্ষ্যে বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থাকেও শ্রেফ হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়৷
অর্র্থৎ সহজ কথায় আদর্শহীনতা৷ আজ সর্বক্ষেত্রে আদর্শ হীনতার সংকট দেখা দিয়েছে৷ পদ,-অর্থ ও ক্ষমতা ভোগের বৃত্তের মধ্যে আজ সমাজের সমস্ত ক্রিয়াকর্মকে বেঁধে ফেলা হয়েছে৷ আদর্র্শ, কর্তব্য দায়িত্ব দায়বদ্ধতা- এই সবমূল্যবোধ গুলি আজ যেন কর্পুরের মত উবে যাচ্ছে৷ অথচ এগুলিই সমাজের প্রাণ৷ এই প্রাণকে বাদ দিলে সমাজটা পরিণত হয়৷ তা দুর্গন্ধ ও রোগজীবানুর ডিপোতে পরিণত হয়৷ আজ তা-ই হতে চলেছে৷
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে এই অবক্ষয় থেকে উদ্ধার করাটা অত্যন্ত জরুরী৷ আজকের সমাজের সমস্ত শিক্ষাবিদদের, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত, সমাজ সচেতন ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন৷
- Log in to post comments