বিনা টিকিটে গঙ্গাস্নান

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাচীনকালের মানুষ যাঁদের গঙ্গা–যমুনার উপর খুব শ্রদ্ধা–ভক্তি ছিল তাঁরা ভাবতেন ঈশ্বরের করুণাই  অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়ে  গঙ্গাধারার রূপ পরিগ্রহ করে থাকে কারো গঙ্গাস্নানের আকর্ষণ কর্ত্তব্যের প্রেরণায়, কারো বা ধর্মোন্মাদনার প্রেষণায় কেউ বা গঙ্গাস্নান করেন ডগমা বা ভাবজড়তার বশবর্ত্তী হয়ে, আর কেউ বা পুরাণের কাহিনীকে গুরুত্ব দেন ক্ষলে৷ সত্যিই গঙ্গা ‘‘পতিত পাবনী’’ এ কথা ঠিকই যে গঙ্গা সুবিশাল আর্যাবর্ত্তের স্তন্যদাত্রী জননী৷ এও ঠিক যে নদীর বহমান ধারায় স্নান করলে তা শরীর মনকে স্নিগ্ধ করে৷ তবে গঙ্গাস্নানে কোন বিশেষ গুণ আছে কি না তা  পণ্ডিতেরা বিচার করে দেখতে পারেন৷ তবে আপাতঃদৃষ্টিতে তেমন গুণ আছে ক্ষলে মনে হয় না কারণ মীন ও অজস্র জীবজন্তু গঙ্গায় স্নান করে থাকে, তাদের মল–মূত্র নিত্য গঙ্গায় পতিত হয়৷ তারা গঙ্গা স্নান করে কতটা বৈকুণ্ঠের কাছে পৌঁছোয় তা কেউই  হলফ করে ক্ষলতে পারক্ষে না৷ তবে একথা ক্ষলক্ষ যে গঙ্গাস্নান হিসাবে মন্দ নয় যদি সেখানে জলক্ষিদূষণ না হয়ে থেকে থাকে৷ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বৈকুণ্ঠে নারায়ণের চরণোদক থেকে গঙ্গার উৎপত্তি৷ ৰাঙলার রাজা ভগীরথ তাঁর তপস্যার ক্ষলে গঙ্গাকে মর্ত্ত্যে আনয়ন করেন৷ আকাশ থেকে নীচে নাক্ষবার সময় গঙ্গার তোড়ে বসুন্ধরা যাতে বিদীর্ণা না হন তাই শিব তাঁকে জটায় আশ্রয় দিয়ে তাঁর গতিবেগ বা তোড় কমিয়ে দেন৷ কাহিনী অনুযায়ী গঙ্গা চতুর্ধারায় বিভক্ত হয়েছিল৷ তার একটি ধারা মর্ত্ত্যে  চলে আসে ঃ

‘‘স্বর্গেতে অলকানন্দা মর্ত্ত্যে ভাগীরথী 

দেক্ষলোকে মন্দাকিনী পাতালে ভোগবতী৷’’

 

সুতরাং গঙ্গাস্নান মানে বিষ্ণুর চরণোদকে স্নান৷ এই ভেবে ভক্ত পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নানে আকৃষ্ট হক্ষেন ক্ষৈ কি তাঁরা গঙ্গাকে বিষ্ণুর করুণার বিগলিত রূপ হিসেবে ভাবক্ষেন ক্ষৈ কি

অন্য কাহিনী অনুযায়ী গঙ্গা শিবের পত্নী৷ শিবজায়া গঙ্গার জলবিধৌত হতে কোন্ শৈব, কোন্ শাক্ত না চাইক্ষেন তাই গঙ্গা যে কেবল বৈকুণ্ঠনিবাসী নারায়ণের পাদোদক তাই নয় শাক্ত শৈবের কাছে গঙ্গা পুণ্যতোয়া৷

                ‘‘হরিপাদপদ্মবিহারিণ্

                গঙ্গে হিমবিধুমুক্তাধবলত্৷

*      *      *

                তব তটনিকটে যস্য নিবাসঃ

                খলু বৈকুণ্ঠে তস্য নিবাসমঃ৷

*      *      *

                ভাগীরথি সুখদায়িনি মাতস্তব

                জলমহিমা নিগমে খ্যাতঃ৷

*      *      *

                ‘‘দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি

                গঙ্গে ত্রিভুবনতারিণি তরলতরঙ্গে৷

                শঙ্করমৌলিনিবাসিনি বিমলে,

                মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে৷৷’’

*      *      *

                নাহং জানে তব মহিমানং,

                ত্রাহি কৃপাময়ি মামজ্ঞানম্৷’’

*      *      *

সুতরাং সাধারণ মানুষই নয়, জ্ঞানী–গুণীরাও গঙ্গাকে ক্ষিগলিত করুণা হিসেক্ষে দেখেছিলেন৷ তাই গঙ্গা–মহিমাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ অন্য নদীর সঙ্গে গঙ্গার গুণগত পার্থক্য খুব কম৷ বরং গঙ্গার তীরবর্ত্তী শিল্পকেন্দ্রগুলি যে পরিমাণ আবর্জনা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করে তাতে গঙ্গাস্নানে রোগ ক্ষৃদ্ধিও অক্ষশ্যই ঘটতে পারে৷

‘‘এক ডুক্ষ কাক ডুক্ষ দুই ডুক্ষ ক্ষ্যাঙ

তিন ডুক্ষে শরীর টান চার ডুক্ষে গঙ্গা স্নান৷’’

‘‘জাহ্ণবী–যমুনা বিগলিত করুণা’’

ক্ষর্দ্ধমান জেলার ক্ষেশীর ভাগ অংশই অ–গঙ্গার দেশ, তাই দেখেছি গ্রামাঞ্চলের সাদামাঠা অনেক মানুষই ক্ষলে থাকেন মরণান্তে তাকে যেন তিরপুণী (ক্ষর্দ্ধমানের গ্রাম্য মানুষ ত্রিবেণীকে ‘তিরপুণী’ ক্ষলে৷ ক্ষর্দ্ধমানের গ্রাম্য ছড়ায় আছেঃ

‘‘চালভাজা খেতে খেতে গলা হয় কাঠ

হেথা কোথা জল পাক্ষ সেই তিরপুণির ঘাট

তিরপুণির ঘাটাতে বালি ঝুরঝুর করে

সোনার গায় রোদ লেগেছে ডালিম ফেটে পড়ে৷’’)  ঘাটে দাহ করা হয়, ছাইগুলো যেন গঙ্গাজলেই শেষ আশ্রয় পায়৷

মনে পড়ে গেল আমার ছোট বয়সের পাড়াতুত এক ঠাকুমার কথা৷ ঠাকুমা রোজ ট্রেনে করে ছয় মাইল দূরবর্ত্তী গঙ্গায় ডুক্ষ দিয়ে আসতেন৷ অতি ভোরে বেরুতেন, ফেরবার সময় হাতে ছাপ, কপালে ছাপ, বুকে তিলক, নাকে রসকলি লাগিয়ে ফিরতেন৷ সবই করতেন.... কেবল করতেন না টিকিট৷ ইষ্টিশানে চেকারৰাৰু যখন হাত পেতে শুধোতেন –মা, আপনার টিকিটটা? কোলকুঁজো ঠাকুমা বাঁ হাতটা উপরের দিকে কেৎরে দিয়ে ক্ষলতেন–আ মরণ মিনসের ছেলে পেছনে রয়েছে দেখছ না টিকিটটা তার হাতেই রয়েছে৷

চেকারৰাৰু কোন কোন দিন শুধু হাসতেন, কেবল ক্ষলতেন–মা, রোজই তো ক্ষলেন ছেলে পেছনে আসছে৷ কই, এক দিনও তো আপনার ছেলের টিকি দেখতে পাই না৷

ঠাকুমা একটু ঝাঁঝালো ভাষায় ক্ষলতেন–আমার ছেলে কি ভিনদেশী নাকি যে মাথায় টিকি রাখক্ষে ৰাঙালী পোলা মাথায় টিকি রাখে না মরণ....মিনসের মরণ

একদিন আমি ৰুকে ক্ষল  নিয়ে সাহসে  ভর দিয়ে  শুধোলুম–হ্যাঁ গো ঠাকুমা, তুমি যে   গঙ্গাস্নান করো, কষ্ট করো, তিলক–ছাপ, চন্দন–ছাপ, তিলক–মাটি লাগাও, সেই যে নাকে রসগোল্লা না কী একটা লাগাও এ তো পুণ্যি করা ঠিক, কিন্তু বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করায় সব পুণ্যি তো বরবাদ হয়ে যাক্ষে....এ যেন সেই এক ভাঁড় গোদুগ্ধে এক ফোঁটা গোরোচনা৷

ঠাকুমা ক্ষললেন–খোকন, ওইখানেই তো ভুল করলি৷ বিনা টিকিটে ভ্রমণের পাপটার দিকে তাকিয়ে দেখলি কিন্তু গঙ্গাস্নানের পুণ্যিটার দিকে ভাল করে তাকালি না ৷ গঙ্গাস্নানে যে পরিমাণ পুণ্যি হয় বিনা টিকিটে ভ্রমণে সে তুলনায় পাপ একেবারেই অকিঞ্চিৎকর৷ তাই দু’য়ে যে গায়ে গায়ে শোধ হক্ষে তার জো নেই৷

                ‘‘একবার গঙ্গাস্নানে যত পাপ হক্ষে,

                পাপীদের সাধ্য নাই তত পাপ করে৷’’      (শব্দ চয়নিকা)