বঞ্চিত বাঙলা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বাঙলার প্রতি বঞ্চনার বহর দিন দিন বাড়ছে৷ দিল্লির মসনদে শাসক পরিবর্তন হলেও বাঙলার প্রতি দিল্লির বৈষম্যমূলক আচরণের কোন পরিবর্তন হয়নে৷ বাম আমলেও এই একই অভিযোগে সংসদে সরব হতো বাম সাংসদরা৷ নরেন মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ঘটিত হওয়ার পর অনেকে ভেবে ছিল এবার বুঝি বাঙলার প্রতি দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে৷ কিন্তু এই জায়গায় নেহেরু থেকে নরেন্দ্রমোদি সরকারী নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি৷ ১০০দিনের কাজ, গ্রামীন আবাস যোজনা, গ্রামীন সড়ক যোজনা–বঞ্চনার তালিকা আর দীর্ঘ না করেও বলা যায় পূর্বতন সব সরকারের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে গত ১২ বছরে মোদি জমানার বঞ্চনা৷

তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দিল্লির বঞ্চনা, কেবল সাময়িক আর্থিক সাহায্যের ব্যাপারে নয়, সমস্ত ব্যাপারেই৷ আর এর ইতিহাস সত্যই যে সুদীর্ঘ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ স্বাধীনতা লাভের পরে যখন রাজ্য বিভাজন পর্ব শুরু হ’ল, কেন্দ্রীয় সরকার ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন৷ সে সিদ্ধান্ত যথার্থ কিনা, আপাততঃ এখানে তা বিচার্য নয়৷ আমরা দেখছি, কেন্দ্রীয় সরকার তার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে অন্যান্য রাজ্যের বিভাজন করলেন, কিন্তু বাঙ্লার ক্ষেত্রে কী হল বাঙালী ভাষাভাষী বহু এলাকা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার পরিবর্তে বিহার, ওড়িষ্যা, অসম প্রভৃতি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হ’ল৷ বাঙ্লার পশ্চিমাঞ্চলের খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ সিংভূম, ধানবাদ, বোকারো, রাঁচী জেলার সিল্লি, জোন্হা, সোনাহাতু ও তামার থানা, হাজারিবাগ জেলার গোলা, পেটারবার, জেরিডি ও দামোদরের দক্ষিণাংশ, সাঁওতাল পরগণা জেলার জামতাড়া, দুমকা, গড্ডা, দেওঘর, পাকুড়, রাজমহল (সাহেবগঞ্জবাদে), পুরোপুরি বাঙালী অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্লা থেকে কেটে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করা হল৷ পরে ওই বিহার থেকে ওই এলাকাগুলি আলাদা হয়ে নবনির্মিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে৷ বিহারের উত্তরপূর্ব অংশের পূর্ণিয়া জেলার কিষাণগঞ্জ মহকুমা ও পলাশী থানা ও অনুরূপ ভাবে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্লা থেকে কেটে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে৷ এমনিভাবে উত্তর বালেশ্বর, উত্তরপূর্ব ময়ূরভঞ্জ, উত্তর কেওনঝড় ও পূর্ব সুন্দরগড়ও বাঙালী এলাকা হওয়া সত্ত্বেও ওড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে৷ ওদিকে অসমের দক্ষিণাংশ গোয়ালপাড়া জেলা, কাছাড় জেলা, কামরূপ জেলার বড়পেটা মহকুমা, নওগাঁ জেলার লামডিং ও লংকা, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ, মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের সমতল অংশ খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশ বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা হলেও বাঙলা থেকে কেটে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে৷ আর তারপর ত্রিপুরাও তো বাঙালী অধ্যুষিত৷ এভাবে রাজনৈতিকভাবে বাঙলাকে কেটে ছোট পশ্চিমবঙ্গ তৈরী করা হয়েছে৷

বাঙলা ও বাঙালীর প্রতি দিল্লির বঞ্চনার আর একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ হ’ল স্বাধীনতার সময় বাঙ্লা ও পঞ্জাবও ভাগ হল৷ পশ্চিম পঞ্জাব পড়ল পাকিস্তানে আর পঞ্জাবের পূর্বাংশ পড়ল ভারতে৷ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পঞ্জাবের লোক বিনিময় হ’ল৷ পশ্চিম পঞ্জাবের হিন্দু জনগোষ্ঠী যারা ভারতে চলে এল, তাদের জমি, ঘরবাড়ী, অর্থ সাহায্য দিয়ে সুষ্ঠু পুনর্বাসন দেওয়া হল৷ কিন্তু পূর্ব বাঙ্লার যে সমস্ত হিন্দু পশ্চিম বাঙ্লায় এল, তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হল না৷ ফলে পূর্ব বাঙ্লা থেকে আগত লক্ষ লক্ষ বাঙালীদের জমি, ঘরবাড়ী, অর্থ সাহায্য কিছুই দেওয়া হ’ল না, তাদের পূনর্বাসনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা হ’ল না৷ ফলে ভয়ঙ্কর উদ্বাস্তু সমস্যা পশ্চিমবাঙ্লার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেন্দ্র নির্বিকার রইল৷ এমনি বহুভাবে কেন্দ্র পশ্চিমবাঙ্লাকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই বঞ্চনা করে আসছে৷ স্বাধীনতার আগেও দিল্লির তখ্তে যারা আসীন ছিল তারা স্বাধীনচেতা বাঙালীদের দেখতে পারত না, স্বাধীনতার পরেও দিল্লি বাঙ্লাকে বঞ্চনা করে চলেছে৷ সেই ট্র্যাডিসন সমানে চলেছে৷

সাম্প্রতিককালে বাঙ্লার অবিচ্ছেদ্য অংশ দার্জিলিংকে পশ্চিমবাঙ্লা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গোর্খাল্যাণ্ড গঠনের প্রক্রিয়ার পেছনেও রয়েছে মূলতঃ নেপাল থেকে আগত বিদেশী গোর্খাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ষড়যন্ত্র৷ সুকৌশলে সেই ষড়যন্ত্রের জালে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আটকানো হয়েছে৷ ফলে, মুখ্যমন্ত্রীও সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে জিটিএ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন৷

বাঙলা ও বাঙালীদের প্রতি দিল্লির এই বৈষম্যমূলক আচরণ, বাঙলাকে ধ্বংস করার এই ষড়যন্ত্র তথা বাঙলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা, শোষণের বিরুদ্ধে সমস্ত বাঙালীদের দলমত নির্বিশেষে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ সমস্ত প্রকার অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে হবে৷