মানুষ তার প্রয়োজনের তাড়নাতেই এক সময় ১ হ’তে ৯ পর্যন্ত এই অঙ্কগুলি (Digits) আবিষ্কার করেছিল৷ এরপর বেশ কিছুদিন এই অঙ্কগুলিকে নিয়ে যে অসংখ্য সংখ্যা (Number) তৈরী করা যায়, এমন কথা কল্পনা করতে শেখেনি৷ তারপর কালক্রমে, শূন্য (Zero)–এর অস্তিত্বের কথা যখন কল্পনায় এসেছিল, তখনই অসংখ্য সংখ্যা তৈরী হ’তে শুরু করল দুরন্ত গতিতে৷ শুরু হ’ল দুই অঙ্ক–বিশিষ্ট, তিন–চার অঙ্ক, প্রভৃতি অসংখ্য সংখ্যা বিশিষ্ট সংখ্যা গঠনের চিন্তা–ভাবনা৷ প্রথমেই আবিষ্কার হ’ল স্বাভাবিক সংখ্যার অর্থাৎ ১ হ’তে ১০০ পর্যন্ত এই স্বাভাবিক সংখ্যাগুলি৷ এরপর হাজার, অযুত, লক্ষ, কোটি স্থানীয় সংখ্যাগুলিকে আবিষ্কার করল৷ এখানেই সংখ্যা তৈরী সমাপ্ত হ’ল না৷ শুরু হ’ল বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যা গঠনের প্রয়াস৷ আর এই বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যা তৈরীর জন্য ভারতের গণিতবিদরাই হয়েছিলেন অগ্রণী৷ পৃথিবীর কোন দেশই এই বৃহৎ সংখ্যার কথা নিয়ে বিশেষ চিন্তা করেনি৷ তাই, বৃহৎ সংখ্যা গঠনের সূতিকাগৃহ হ’ল এই ভারতবর্ষ৷ ভারত তথা বাংলার মুনিঋষিগণের অধিকাংশই একদিকে পরাজ্ঞান অর্জন ও অপরদিকে গণিত চিন্তায় মগ্ণ হ’য়ে গণিতের নিত্য নূতন আবিষ্কার করে গণিতের স্থান অনেক উচ্চ শীর্ষে উঠিয়ে দিয়েছেন৷
আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ণ হ’ল বৃহত্তম সংখ্যাটি কত তার পরিচয়ই বা কি হ’তে পারে সাধারণ ভাবে আমরা এর উত্তর কি দেব! এই প্রশ্ণটির উত্তর একটি দৃষ্টান্তর মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যাক৷ ধরা যাক, এক ‘হবু’ মন্ত্রিমহাশয় ব্রিগ্রেডে এক জনসভার ডাক দিয়েছেন৷ জনসভাতে লোকের সমাবেশ হয়ত ভালই হ’ল৷ এখন, যদি প্রশ্ণ করা যায়, এই জনসভায় কত লোকসংখ্যা হয়েছিল এর উত্তর হয়ত আমরা সাধারণ ভাবে বলে উঠব – ১০ বা ২০ হাজার নতুবা বড় জোর লাখ খানেক৷ আবার যদি বলা যায়, এখন ভারতের লোক সংখ্যা কত তা হ’লে আমরা সকলেই বলব – প্রায় ১২৭ কোটি৷ মোটামুটি কোটি পর্যন্তই আমরা সাধারণত শুনতে অভ্যস্ত৷ এরপর তেমন বিশেষ বড় বড় সংখ্যার খুব একটা প্রয়োজন হয় না৷ কোটিতেই আমাদের অধিকাংশ হিসাব–নিকাশ সেরে নিই৷ মোটামুটি কোটিতেই থেমে যাই৷ কিন্তু এই কোটির ঊর্দ্ধে আরও অজস্র বড় বড় সংখ্যার সন্ধান মিলেছে ভারতের গণিতজ্ঞদের রচিত সংহিতায়৷
ভাবতে বড় বিস্ময় লাগে যে, আজ থেকে প্রায় দুহাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্মেরও পূর্বে ভারতের মুনি ঋষিগণ তথা গণিতজ্ঞগণ কোটির উপর বেশ কিছু বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যার কল্পনা করেছিলেন৷ এক স্থানীক নামও নির্দ্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন৷
প্রাচীন কালে এই সব মুনিঋষিগণ বিভিন্ন সংহিতা রচনা করে বৃহৎ সংখ্যাগুলিকে এই সমস্ত সংহিতায় লিপিবদ্ধ করেন৷
উল্লেখযোগ্য সংহিতাগুলি হ’ল – বাজসনেয়ী সংহিতা, মৈত্রায়নী সংহিতা, কাঠক সংহিতা ইত্যাদি৷ এই সংহিতাগুলি যে যুগে রচিত হয়েছিল তখন ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন গণিতজ্ঞরা এত বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যার কথা কল্পনাও করতে পারেনি৷ এমনকি যে সমস্ত দেশ গণিতে দক্ষ ছিলেন তাঁরাও বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যার কল্পনা করতে পারে নি৷ যেমন – রোমান গণিতেও ১০০০ (Mille) বেশী কিংবা গ্রীক গণিতেও ১০,০০০ (Myriad) এর ঊর্দ্ধে কোন বৃহৎ সংখ্যার সন্ধান মেলেনি৷
বাজসনেয়ী সংহিতায় যে বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, স্থানীয় মান অনুযায়ী হ’ল –
এক ঞ্চ ১, দশ ঞ্চ ১০, শত ঞ্চ ১০০ সহস্র ঞ্চ ১০০০ অযুত ঞ্চ ১০,০০০, নিযুত ঞ্চ ১০০,০০০, প্রযুত ঞ্চ১০০০,০০০, অর্বুদ ঞ্চ ১০, ০০০, ০০০, ন্যর্বুদ ঞ্চ১০০, ০০০, ০০০, সমুদ্র ঞ্চ ১, ০০০, ০০০, ০০০, মধ্য ঞ্চ ১০, ০০০, ০০০, ০০০, অন্ত্য ঞ্চ ১০০, ০০০, ০০০, ০০০ মধ্য ঞ্চ ১০০০, ০০০, ০০০, ০০০, পরার্ধ কত বড় সংখ্যা, তা বাস্তবে একটা উদাহরণের মধ্য দিয়ে বুঝে নেওয়া যাক ১ ধর, যাক্ ‘সুরক্ষা’ নামক একটি চিট্ ফান্ড প্রতি বছরে এক হাজার কোটি (১০০০, ০০০০০০০) টাকা জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, এক পরার্ধ টাকা ক্যাপিটাল করেছে৷ এখন, ওই চিট ফান্ডটির এক পরার্ধ টাকা সংগ্রহের জন্য কত বছর সময় লেগেছিল ওই টাকা সংগ্রহ করতে চিট ফান্ডটির এক শতাব্দী সময় লেগেছিল, অর্থাৎ ১০০ বছর সময় লেগেছিল৷
কাঠক সংহিতার সহিত বাজসনেয়ী সংহিতার কিছু কিছু পার্থক্য আছে৷ পার্থক্য হ’ল – বাজসনেয়ীতে নিযুতের পর প্রযুত কিন্তু কাঠক সংহিতায় আগে প্রযুত ও পরে নিযুত৷ বাকি নামগুলি বাজসনেয়ীর মতই৷ তারপর মৈত্রায়নী সংহিতাতেও আগে পড়ে কিছু নামের পার্থক্য আছে৷ হিন্দু গণিত শাস্ত্রে পরার্ধের চেয়ে বড় সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে৷ পরার্ধকে দশগুন করলে এক অনন্ত সংখ্যাটি পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ এক অনন্ত ঞ্চ ১০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০ (১–এর গায়ে ১৩টি শূন্য)৷ বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ গণিতজ্ঞরা একটি ‘ললিত বিস্তর’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, আর এই গ্রন্থেই ‘তল্লক্ষণ’ নামক একটি বৃহৎ সংখ্যার উল্লেখ আছে৷ এক তল্লক্ষণ ঞ্চ ১–এর পিঠে ৫৩ টি শূন্য আছে৷
তল্লক্ষণের পর আরও একটি সুবৃহৎ সংখ্যার পরিচয় পাওয়া যায়৷ ৮৪ লক্ষকে (৮৪, ০০০০০) ৮৪ লক্ষ দিয়ে ২৮ বার পর পর গুণ করলে যে বিশাল সংখ্যাটি হয়, তাকেই বলা হয় ‘শীর্ষপ্রহেলিকা’৷ এই ‘শীর্ষপ্রহেলিকা’–কে স্থানীয় মানের আকারে লিখলে ১৯৪টি অঙ্কস্থান প্রয়োজন হবে৷ আজকের মানুষের কাছে এধরনের বিশাল বিশাল সংখ্যার কল্পনা এক অতি বিস্ময়কর ব্যাপার৷ হয়ত আমরা কেউ কেউ ভাবতে পারি, অবসর সময় কাটিয়ে দেওয়াই হ’ল এ ধরণের চিন্তার লক্ষ্য৷ কিন্তু এ ধরণের চিন্তা প্রয়োজনীয়তা কি তা এই সমস্ত গণিতজ্ঞরা তাদের রচনাতেই উল্লেখ করে গিয়েছেন – এগুলি বাস্তব সমাধানে, দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজ কর্মের হিসাবের জন্যই বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যার প্রয়োজন হয়৷ আর এই প্রয়োজনের তাড়নাতেই এই ধরণের সুবৃহৎ অঙ্কের সংখ্যাগুলি আবিষৃকত হয়েছিল৷
- Log in to post comments