ভয়াবহ জলসংকট ঃ সমাধান কোন্‌ পথে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আমরা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি জলের অপর নাম জীবন, কিন্তু এটা শুধু কথার কথা বলে আমাদের মনে হ’ত কারণ জল এত সহজপ্রাপ্য যে এর অভাব আমরা অতটা বুুঝিনি৷ যেমন বাতাস ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না, কিন্তু বাতাসের অভাবও কোনদিন হয়নি৷ তাই বাতাসের অভাব আমাদের জীবন সংকটের কারণ হবে সেটা উপলব্ধি করার মত পরিস্থিতি আসেনি৷ কিন্তু জলের অভাব যে কতটা বাস্তব ও ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা অন্তত ভারতে প্রায় দশটি রাজ্যের মানুষ উপলব্ধি করছে৷

কিন্তু কেন এই ভয়ঙ্কর জল সংকট? এই পরিস্থিতি এ রাজ্যেও হতে পারে৷ হতে পারে কেন, যেভাবে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে তাতে খুব শীঘ্রই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷

এর কারণ কি  প্রকৃতির রুদ্ররোষ --- না, এভাবে প্রকৃতির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না৷ তাছাড়া প্রকৃতির অকৃপন করুণায় রোদ হচ্ছে, আবার বর্ষায় অঢেল ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে ও ভূগর্ভের অভ্যন্তরে সুপেয় জল সঞ্চিত আছে৷ তবে?

প্রকৃতি অঢেল ভাবে সবকিছু দিয়ে চলেছেন৷ তাই আমরা এসবের মূল্য বুঝিনি৷ পরমপুরুষ মানুষকে প্রখর জ্ঞানবুদ্ধি দিলেও সেই জ্ঞানবুদ্ধিকে আমরা শুভপথে চালানোর পরিবর্তে অশুভ পথে চালিয়েছি৷ আমরা শুভের চিন্তা না করে অশুভের চিন্তাতে নিজেদের মগ্ণ রেখেছি৷ ফলে আমাদের চিন্তাধারাটাই অশুভ হয়ে উঠেছে৷

বর্ষাকালে প্রকৃতি অঢেল বৃষ্টি ঢেলে দেন, সেই জলকে সারা বছরের কৃষি-শিল্পের জন্যে বা পানের জন্যে সংরক্ষণ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা করেছি কি? করিনি৷ নদী খালগুলি ভরাট হয়ে গেছে৷ সেই নদী বা খাল গুলিকে সংস্কার করে বর্ষার জলকে ধরে রাখবার উপযুক্ত পরিকল্পনা করা হয়নি৷ নদী খালের স্থানে স্থানে ছোট ছোট জলাধার তৈরী করার ব্যবস্থা করলে বর্ষার জলকে ধরে রাখা যেত৷ গ্রামের পুষ্করিণীগুলিও বিশেষ করে বড় বড় পুষ্করিণী রাঢ়ের মত মালভূমি অঞ্চলে বাঁধগুলিও বালি মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে৷ সেগুলিকে গভীর করার প্রয়োজনীয়তাটা গভীরভাবে ভাবা হয়নি৷ ভূগর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভর করে আছে ছোট বড় গাছপালা---বনাঞ্চল৷ মানুষ যথেচ্ছভাবে পানীয় জলের জন্যে ও বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় কৃষিকাজের জন্যে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভ থেকে জল তুলে নিচ্ছে৷ শিল্পের জন্যে তো বর্ষাতেও ডিপ টিউবওয়েল থেকে জল তুলছে৷ এ সমস্ত কারণে ভূগর্ভের জলস্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে৷ যে পরিমাণ জল বর্ষায় মাটির ভেতরে প্রবেশ করছে তার বহুগুণ বেশী জল তুলে নেওয়া হচ্ছে৷

মূলতঃ এই সবই জলসংকটের মূল কারণ৷ অপরিণামদর্শী লোভী অসৎ মানুষ বে-পরোয়াভাবে বনাঞ্চল ধবংস করছে৷ তাছাড়া ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাওয়ার জন্যে গাছপালা বাঁচবার রসদ পাচ্ছে না৷ বনাঞ্চল ধবংসের এও একটা কারণ৷ আর, গাছপালা মেঘকে টানে, বৃষ্টি ঘটায়৷ বনাঞ্চল ধবংসের কারণে তাই তেমন মেঘ তৈরী হচ্ছে না, ফলে বৃষ্টির পরিমাণও কমে যাচ্ছে৷

এসব বুঝে প্রতিটি সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে বনাঞ্চল রক্ষা করা যায়৷ ভূগর্ভস্থ জলও সংরক্ষণ করা যায়৷ ব্যাপকভাবে নদী সংস্কার করে নদীগুলির স্থানে স্থানে ছোট ছোট জলাধার তৈরী করে, বড় বড় পুষ্করিণী করে বাঁধগুলির জলসংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়িয়ে যে সমস্ত জলাধার রয়েছে সেগুলির সংস্কার করে অধিক থেকে অধিকতর বর্ষার জলকে ধরে রাখতে হবে৷ এজন্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মত দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে৷

তাছাড়া, কৃষিতে জলের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করতে হবে৷ বর্তমানে ক্ষেত প্লাবিত করে যে সেচের জলের ব্যবহার করা হয়, আধুনিক পদ্ধতিতে এর চেয়ে অনেক কম জলে ভালভাবে চাষ করা যায়৷ সার জল মিশিয়ে কেবল ফসলের গোড়ায় জল দেওয়ার পদ্ধতিতে জলের প্রয়োজন যেমন অনেক কমবে, তেমনি ফসলও অধিকতর ভাল হবে৷ কেবল ফসলের গোড়ায় জল দেওয়ার জন্য আগাছাও এত জন্মাবে না৷ এই সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে আনতে হবে৷ এমনকি জলাভাবের সময় রাতের শিশিরকেও সংরক্ষণ করে গাছের গোড়া ভেজানোর প্রযুক্তি আবিষৃকত হয়েছে৷

মধ্যপ্রাচ্যে ছোট্ট ইহুদী রাষ্ট্র ইজরায়েল ব্যাপকভাবে সমবায়ের মাধ্যমে চাষ করে এই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে দেশের রুক্ষ মাটিতে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছে ও নিজেদের দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করে বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করছে৷ ইজরায়েলের কৃষি ব্যবস্থা প্রায় সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে প্রেরণা৷

এই রাজ্যেও জলসংকট ধীরে ধীরে গভীরতর হচ্ছে৷ এখন থেকেই উপযুক্ত ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও মারাঠাওয়াড়ার মত হবে৷ তাই অবিলম্বে সমস্ত রাজ্য সরকারগুলিকে ও কেন্দ্রের সরকারকে একযোগে দেশের জলসংকটের মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ও কৃষি আর শিল্পের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেমন জলরক্ষণ করতে হবে তেমনি দেশের শহরাঞ্চলের মত গ্রামাঞ্চলেও সর্বত্র মানুষ যাতে বিশুদ্ধ পানীয় জল প্রয়োজনমত পেতে পারে তার আশু ব্যবস্থা করতে হবে৷