চাই যোগ্য নেতৃত্ব

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্র গণতন্ত্রের মুখোশে দানবীয় রূপ নিয়েছে৷ নির্দয় শোষণের শিকার সাধারণ মানুষ, প্রতিবাদের কন্ঠরুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, মানব সমাজের সার্বিক বিকাশের পথ বন্ধ৷ পুঁজিবাদের অর্থে পালিত রাজনৈতিক দলের নেতারাও পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত৷ শোষণ ও নিপীড়নে জর্জরিত মানুষের দিকে তাকাবার সময় নেই৷

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক তঞ্চকতার পরিণতিতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অনাচার ব্যাভিচারে ভরে যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে মানবজাতিকে, মানব সমাজকে এই দুর্বিসহ অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে, শোষণ ও নিপীড়ণের অবসান ঘটাতে প্রয়োজন সামাজিক অর্থনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার৷ যে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন, অর্থাৎ আর্থিক ক্ষমতা তুলে দিতে হবে প্রতিটি অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের হাতে৷ এই ধরণের সামাজিক অর্থনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা মানুষ অনুভব করছে৷ কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে মানুষ এগিয়ে আসতে পারছে না৷ তাই পুঁজিবাদের তৈরী সামাজিক অর্থনৈতিক সংকট থেকে মানুষকে মুক্ত করতে প্রয়োজন উপযুক্ত আদর্শ নেতৃত্বের৷

প্রাউট যেমন সমস্ত প্রকার শোষনের বিরোধী ও শোষণ মুক্তির সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা দিয়েছে ও বাস্তব সম্মত কর্মসূচী দিয়েছে, তেমনি তা বাস্তবায়িত করতে যোগ্য নেতৃত্বের কথাও বলেছেন৷ প্রাউটের দৃষ্টিতে সেই যোগ্য নেতৃত্ব হবে শারীরিক সক্ষম, নৈতিকতায় দৃঢ় ও আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত৷

মানুষ যূথবদ্ধ জীব৷ কোনও একজন মানুষ বেশীক্ষণ একা থাকতে পারে না৷ একা থাকলেই বলতে শোনা যায়---‘আর পারি না বাবা! একা থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে৷’ বেশীক্ষণ একা থাকলেই আর একজনের সঙ্গ পেতে প্রাণ-মন আকুপাকু করে৷ যূথবদ্ধ মানুষ একসঙ্গে থাকলেও সবার শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, মেধা, বুদ্ধি সমান নয়৷ যে মানুষ এইসব গুণগুলোয় অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে থাকে, যূথবদ্ধ সমাজে তাকে সবাই নেতা বলে মেনে নেয়৷ তাই যূথবদ্ধ সমাজকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে উপযুক্ত নেতার প্রয়োজন হয়৷ মানুষও তার প্রয়োজন ও স্বার্থের তাগিদে সেই নেতৃত্বকে স্বীকার করে নেয়৷ এই নেতৃত্বকে মানতে গিয়েই সমাজে ব্যষ্টিপূজা শুরু হয়৷ এর ফলে ব্যষ্টি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়৷ এই ব্যষ্টিপূজা অনেকেই পছন্দ করেন না৷ তবু নেতৃত্ব দেবার গুণ যার মধ্যে থাকে সমাজ তাকে নেতা রূপে মেনেই নেয়৷ তাই সমাজে ব্যষ্টিপূজা চলছে, চলবেও৷

এখন এই নেতা নির্বাচনে মানুষকে অনেক বেশী সচেতন হতে হবে৷ নতুবা হিতে-বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ নেতৃত্বের দোষে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসে৷ ইতিহাসে অনেক ধবংসের কারণ, অনেক বিপর্যয়ের কারণ ব্যষ্টি নেতৃত্বের ত্রুটি অথবা দানবীয় স্বভাব৷

মহান দার্শনিক ও প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রাউট দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে ---‘নেতা চিনতে হবে তার বিদ্বত্তা, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, অগ্রগামীতা, ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রাস্তুত্য ইত্যাদি গুণ দেখে৷’ কারণ সমাজে দৃঢ় সংরচনা, যূথবদ্ধ জীবনের শৃঙ্খলা, সব কিছু নির্ভর করে বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের ওপর৷ উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সমাজ সংরচনা জীর্ণ-দীর্ণ হয়ে যেতে পারে, যূথবদ্ধ জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে৷ ব্যষ্টির খেয়াল-খুশীতে, ব্যষ্টির ঔদ্ধত্বে জনসাধারণকে দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়৷

ব্যষ্টিতন্ত্রের এই ত্রুটির ফলেই সমাজে যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়৷ বর্তমান শাসনতন্ত্রে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এই যৌথ নেতৃত্বকে বলা হয় গণতন্ত্র৷ কিন্তু এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দৃঢ়চেতা, সৎ, নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ নেতৃত্বের যখন অভাব হয় তখন গণতন্ত্র দানবতন্ত্রে পরিণত হয়৷ দলীয় ক্যাডার-কর্মী, চ্যালা-চামুণ্ডাদের মর্জি-মাফিক জনগণকে চলতে হয়৷ ক্যাডার-কর্মীদের খেয়াল-খুশীতে জনগণকে অযথা অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়৷

তাই কি ব্যষ্টি একনায়কতন্ত্র, কি গণতন্ত্র দৃঢ়চেতা সৎ, নেতৃত্বের অভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বাঁধে৷ পাশবিকতার প্রকাশ ঘটে৷ তাই সমাজে একান্তভাবে প্রয়োজন আদর্শ নেতৃত্ব৷ প্রাউট তথা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সদ্‌বিপ্র সূত্র বর্তমান নেতৃত্বের সংকটের সমাধানের পথ দেখিয়েছে৷ শারীরিক সক্ষম, দৃঢ়চেতা ও আধ্যাত্মিক নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত সদ্‌বিপ্রই আদর্শ নেতৃত্ব দিয়ে সমাজকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷

9রাজনৈত