ছাঁয়া এঁকে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

সেবার পুজোর ছুটিতে সময়টা নিরিবিলি কাটাব বলে রাঁচিতে এসে একটা হোটেলে আস্তানা নিয়েছিলুম৷ জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে রেখে স্নানটা সেরে নিতে বাথরুমে এসে দেখি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ৷ বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি এমন সময় সেই হোটেলের আরো দুজন বোর্র্ডর স্নান করতে এসে সেখানে দাঁড়ালেন৷

দু’চারজন লোক এক জায়গায় জড়ো হলেই গল্পগুজব আলাপ পরিচয় শুরু হয়৷ তাই আমরা পরস্পরের সঙ্গে কর্থাবার্তা বলতে লাগলুম৷ তাঁরা যখন আমার পরিচয় পেলেন, বিস্ময়ে ফেটে পড়ে একজন বললেন, আপনার মত একজন লোকই ম্যানেজার খুঁজছেন৷ চলুন এখনি দেখা করবেন৷ কাজটা  বড়ই জরুরী৷ এই বলে তিনি আমাকে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেলেন৷

ম্যানেজার আমার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনিই বিখ্যাত গোয়েন্দা বিকাশবাবু! আমাদের এ বিপদে রক্ষা করতেই হবে৷ এই বলে ম্যানেজার তখন তাঁর বিপদের কথা খুলে বললেন৷ রোজই বোর্ডারদের কারো না কারো জিনিস হারাচ্ছে৷ তাঁরা এসে আমার উপর তম্বি করে যাচ্ছেন৷ হোটেলের বদনাম হতে শুরু হয়েছে৷ এইভাবে আর কিছুদিন চললে হোটেল আমার শিকেয় উঠবে৷ ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে৷ এই বলে ম্যানেজার আকুল হয়ে আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন৷ তাঁর অনুরোধ এড়াতে  না পেরে তাঁকে সাহস দিয়ে বলি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷ ম্যানেজারকে তো মুখে আশ্বাস দিলুম কিন্তু কি উপায়ে  যে কোন কিনারা হবে তার কোন সূত্র না পেয়ে দিশাহার হয়ে পড়লুম৷ শেষে মাথায় একটা বুদ্ধি এল৷

সেদিন রাতে শুতে যাবার আগে আমার টাকা পয়সা সব বার করে শব্দ করে করে ঘরে যে হোটেলের টেবিলটা ছিল তার টানায় রাখতে লাগলাম৷ তারপর টেবিলের উপর টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে শুয়ে পড়লুম৷ শুয়ে পড়বার আগে দরজাটা খুলেই দেখি চশমা-পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে৷ আমায় দেখেই সে সরে পড়ল৷

মাঝরাতে খুট করে একটা শব্দ হতে চেয়ে দেখি দেয়ালে একটা ছায়া পড়েছে৷ বুঝতে পারলুম টেবিল ল্যাম্পটা আড়াল করে যে দাঁড়িয়েছে এটা তারই ছায়া৷ আর সেই লোকটাই যে সকলের জিনিস সরায় সেটা বুঝতেও দেরি হল না৷

আমি ভাবলুম লোকটাকে ধরতে গেলে যদি সে পালায় তাহলে তাকে চোর বলে সনাক্ত করলেও প্রমাণ অভাবে তার অপরাধ গণ্য হবে না৷ আমার মাথার বালিশের নীচে একটা পেন্সিল ছিল৷ তাই সেই পেন্সিলটা দিয়ে ছায়ার মাপে তার সব ধারে  দাগ কেটে দিলুম৷ একটা মানুষের মাপ আঁকা হয়ে গেল৷ এত নিঃশব্দে উঠেছিলুম যে সে টের পেলে যখন ছায়া আঁকাটা শেষ করে তাকে ধরতে গেলুম৷ আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সে তক্ষুনি পালিয়ে গেল৷

তার পরদিন সকালে ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়ে বললুম, আপনার হোটেলের বিপদের একটা কিনারা করেছি৷ এখনি চোরকে ধরে দেব৷ হোটেলের সব লোককে এই ঘরে ডেকে  পাঠিয়ে বললুম, আপনার হোটেলের বিপদের একটা  কিনারা করেছি৷ এখনি চোরকে ধরে দেব৷ হোটেলের  সব লোককে এই ঘরে ডেকে আনুন৷

ম্যানেজারের আদেশে সকলেই এসে ঘরের বাইরে ভিড় করে দাঁড়াল৷ আমার ঘরের সব জানালা বন্ধ৷ ভেতরটা অন্ধকার৷ টেবিলের উপর ল্যাম্পটা জ্বলছে৷ একজন করে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়, আমি দেওয়ালের দিকে ফিরে বলি, এ নয়৷

সব শেষে গত রাতের সেই লোকটি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে আমি বলে উঠলাম, এই লোকটাই আসামী৷ এর কাছেই সব কিছু পাবেন৷

ম্যানেজার বিস্মিত হয়ে বললেন, এই লোকটা আমাদের  সব থেকে বিশ্বাসী কর্মচারী৷

তখন ম্যানেজারকে রাত্রের সব ঘটনা খুলে বলি৷ তারপর দেওয়ালের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখাই লোকটার  ছায়ার সঙ্গে আমার পেন্সিলের দাগ হুবুহু মিলে গেছে৷

এই বলে বিকাশদা থামলেন৷ গল্পটি তিনি আমাদের তাঁর কলকাতার বাড়িতে বসে বলছিলেন৷ আমাদের মধ্যে সুকান্তর ছিল একটু খুঁতখুঁতে মন৷ সে বললে, বিকাশদা, যখন তুমি লোকটার ছায়ারছবি আঁকছিলে তখন সে কোন শব্দ শুনে সাবধান হয়নি এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? বিকাশদা গভীরভাবে বললেন, লোকটা কালা ছিল যে৷