একটি প্রাচীন ৰাংলা গানে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে ব্যবহূত হয়েছিল৷ গানটি রচনা করেছিলেন সুবিখ্যাত পাঁচালী গায়ক দাশরথি রায়–সংক্ষেপে দাশু রায়৷ ৰাংলার এই জন্মসিদ্ধ প্রতিভা দাশু রায় কবিতায় কথা বলতে পারতেন......পারতেন গানেও কথা বলতে৷ সংস্কৃত শাস্ত্রেও ছিল তাঁর প্রচণ্ড দখল......আর প্রচণ্ড দখল ছিল যেমন ৰাংলায় তেমনি সংস্কৃতেও৷ তার সঙ্গে তিনি ছিলেন মজলিশী মেজাজের মানুষ৷ লোককে হাসাতে পারতেন দারুণ৷
সেই যে গল্প আছে না! দাশু রায় একবার ৰর্দ্ধমান জেলার একটা প্রকাণ্ড মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সেকালে ৰর্দ্ধমান জেলার গ্রামগুলি ছিল খুব ৰড় ৰড় আর দূরে দূরে অবস্থিত৷ এখনও দেখবে, ৰাংলার ৰড় ৰড় গ্রামগুলির বেশীর ভাগই ৰর্দ্ধমান জেলায়৷ সেকালের সেই মাঠে রাত্তিরে তো বটেই, এমনকি দিনে দুপুরেও লেঠেলরা ওৎ পেতে বসে থাকত রাহাজানির উদ্দেশ্যে৷ একবার দাশু রায় ওই ধরনের একটা ৰড় মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সন্ধে তখন হৰ–হৰ৷ দাশু রায় যাচ্ছিলেন একটা ৰড় ৰট গাছের পাশ দিয়ে৷ হঠাৎ গাছের ওপর থেকে লাফিয়ে নেৰে পড়ল কয়েকজন লেঠেল৷ তারা দাশু রায়কে ৰললে–তোমার কাছে যা কিছু আছে সৰ দিয়ে দাও৷
দাশু রায় ৰললেন–আমি গরীব ব্রাহ্মণ......আমি দান–টান ৰুঝি না......আমি পরিগ্রহ ৰুঝি৷ তোমাদের সঙ্গে যা কিছু আছে তোমরাই সে সৰ আমাকে দাও৷
ডাকাতরা পড়ল মহা ফ্যাসাদে৷ ৰামুণ দান চাইছেন৷ না দিয়েই বা থাকে কি করে! আবার এদিকে না কাড়লে ডাকাত হিসেবেই বা মান বাঁচে কী করে৷ তারা তখন দাশু রায়কে ৰললে–তোমাকে চিনেছি ঠাকুরমশায়, তুমি তো দাশু রায়৷ তা’ তুমি আমাদের একটা মজার কথা শোনাও৷ আমরা তাতে সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে ছেড়ে দোব৷
দাশু রায় ৰললেন–এ অবস্থায় কার ঠোঁটেই বা মজার কথা আসে ৰল! তা গাছের নীচে তো দেখছি তোমরা তিনটি মূর্ত্তিমান দাঁড়িয়ে আছ৷ তোমাদের আত্মীয়–স্বজন জ্ঞাতি–কুটুম্ব আর ক’জন ওই গাছের ওপরে হুপ্ হুপ্ করছে ৰল তো!
ডাকাতরা ৰুঝলে, দাশু রায় তাদের ৰাঁদর ৰলে গালি দিলেন৷ কিন্তু ৰলবার কিছুই ছিল না৷
দাশু রায় ৰললেন–কথা বেচে খাওয়াই আমার জীবিকা৷ আমার যে প্রাপ্য পূরণ তা দিয়ে দাও৷ ডাকাতরা তাদের যথাসর্বস্ব দাশু রায়কে পেণ্ণামী হিসেৰে দিয়ে দিলে৷
* * *
সেই দাশু রায় একৰার চুঁচড়োয় এসেছেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সভায় পাঁচালী গাইতে৷ চুঁচড়ো তখন সংস্কৃত পণ্ডিতদের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল (আর যে সকল স্থান সেকালের রাঢ়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল তারা হ’ল ভাণ্ডারহাটি, ত্রিবেণী, দশঘরা, বাঁশৰেড়ে, জনাই, পেঁড়ো–বসন্তপুর, মাকড়দা, বালী, তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর, সবঙ্গ, চন্দ্রকোণা, বিষ্ণুপুর, ইন্দাশ (বাঁকুড়া), সিমলাপাল, সোণামুখী, ৰর্দ্ধমান, কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, ইন্দাশ (বীরভূম), শিউরী, মলুটী, সর্পলেহনা, কঙ্কালীতলা, কুন্তলা, করীধ্যা (বীরভূম) প্রভৃতি স্থান৷ সেখানে রাঢ়ের বিভিন্ন স্থান থেকে ৰড় ৰড় পণ্ডিতরা এসেছেন....হচ্ছে দাশু রায়ের পাঁচালী গান৷ তিনি তাঁর গানের এক জায়গায় কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করলেন (গানের প্রথম লাইনটি ছিল ‘দোষ কারোর নয় গো মা’)৷ পণ্ডিতেরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন৷
তাঁরা ৰললেন–এ কী কথা! দাশু রায়ের মত পণ্ডিত মানুষ ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ভুল অর্থে ব্যবহার করলেন! পাঁচালী গান হওয়ার পরে পণ্ডিতদের সভা বসল৷
তাঁরা বললেন–যদিও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে চলে না কিন্তু দাশু রায়ের মত প্রখ্যাত পণ্ডিত ও প্রতিভাধর মানুষের সম্মান রক্ষার জন্যে আমাদের উচিত কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটিকে মেনে নেওয়া৷ সংস্কৃতে এমন আর্ষ প্রয়োগের ঘটনা অজস্র রয়েছে৷ সুতরাং আরেকটি আর্ষ প্রয়োগ ৰাড়লই বা! তাই তখন থেকে ‘কোদাল’ অর্থেও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি চলে আসছে৷
এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ দাশু রায় ছিলেন বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর নিকটবর্ত্তী চুপী গ্রামের সন্তান৷ কবি সত্যেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরাও এই চুপী গ্রামের অধিবাসী ছিলেন৷ এখন তোমরাই বিচার বিবেচনা করে আমাকে জানাও তোমরা চুঁচড়োর পণ্ডিত সমাজের এই বার্ত্তিক মানতে রাজী আছো কি না অর্থাৎ কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করবে কি না৷ কোদালের নিজস্ব সংস্কৃত হচ্ছে ‘কুদ্দালিক’৷