দেশের যথার্থ-অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোন্‌পথে?

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

নববর্ষের সূচনায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণের দিকে তাকিয়ে দেখা দরকার৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় বসার পর অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নূতন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা৷ একদিকে আত্মনির্ভরতার শ্লোগান ও পুঁজিপতি তোষণ রাষ্টের সম্পদ বেসরকীকরণ--- যার পরিণতি পুঁজিপতিদের উন্নয়ন  সাধারণের আর্থিক দুর্দশা৷ প্রকৃত উন্নয়নের পথে এই সরকার হাঁটে না---এটা স্পষ্ট৷ তাহলে যথার্থ উন্নয়নের পথ কি?

 সরকার যে বেশি করে ধণিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করছে,  বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা এই দেশের  সরকারেরই পরিবেশিত তথ্য তার প্রমাণ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘ফোব্‌স’৷ পত্রিকার  এক প্রতিবেদনে  প্রকাশিত  হয়েছিল, ভারতের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের  গড়ে ১ জনের ১ দিনের  সম্পদবৃদ্ধির  পরিমাণ ১ কোটি  টাকার ঊধের্ব৷ অথচ এদেশে   ২৭  কোটি মানুষ  এখনও পেট ভরে খেতে  পায় না৷ বছরে প্রায় ২ কোটি মানুষের  দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধাজনিত রোগে মৃত্যু হয়৷

সাধারণ মানুষ যেখানে চরম অভাবে অনটনে  শুকিয়ে  মরছে তার পাশাপাশি ধনিক শ্রেণীর মানুষের  বিপুল বিলাসিতা ও অপচয়  ঘটে চলেছে৷

স্বাধীনতার পর কেন্দ্রে  বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস, জনতা  ও বিজেপি জোট ক্ষমতায় এল৷ বহুবার বহু প্রতিশ্রুতি দিল, কিন্তু  কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষিত হয়নি৷ ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবী হটাও’ প্রতিশ্রুতিও যেমন রক্ষিত  হয়নি৷ তেমনি মোদিজী ক্ষমতায়  আসার আগে  প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,  দুর্নীতি মুক্ত বেকারহীন ভারত গড়ে তুলবেন৷ প্রতিটি গরীব মানুষের  এ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করবেন৷  কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষিত হয়নি৷ বরং উল্টো দিকে রাষ্ট্রসংঘের ২০১৮-১৯ এর প্রতিবদনে প্রকাশ পেয়েছে, ভারতে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে৷

এই ৭৪ বছরে  কেউই ভারতের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা--- দেশের যে মূল  অর্থনৈতিক  সমস্যা তারই কিছুমাত্র  সমাধান করতে পারল না৷

কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কী?  মহান্‌ দার্শনিক প্রাউট-প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার, এই সমস্যা সমাধানের যে পথ দেখিয়েছেন এছাড়া সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই, তাঁর নীতি অর্থনৈতিক  বিকেন্দ্রীকরণের  নীতি৷

পুঁজিপতি শ্রেনীর হাতে বা সরকারের হাতে (যেমন কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থায়) অর্থনৈতিক  শক্তির কেন্দ্রীকরণ করা  চলবে না৷  জনসাধারণের হাতে অর্থনৈতিক শক্তির বিকেন্দ্রীকরণ চাই৷

তার প্রথম ধাপ হবে, প্রথমতঃ স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল  গড়তে হবে৷ প্রাউট -প্রবক্তা ভারতে জনগণের  হাতে অর্থনৈতিক  শক্তির বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে তথা অর্থনৈতিক যথাযথ উন্নয়নের  জন্যে ভারতবর্ষকে ৪৪টি  স্বনির্ভর  অর্থনৈতিক অঞ্চলে (‘সমাজ’) বিভক্ত করেছেন৷

এর ভিত্তি হচ্ছে--- (১) একই অর্থনৈতিক সমস্যা, (২) একই ধরণের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা, (৩) জাতিগত সাদৃশ্য, (৪) সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (৫) একই সেন্টিমেন্টাল লিগ্যাসি৷

এরপর সংশ্লিষ্ট ‘সমাজ’ থেকে অর্থের বহিঃস্রোত ও কাঁচামালের  বহিঃস্রোত বন্ধ করতে হবে৷  সঙ্গে সঙ্গে  ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার  মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষি সমবায় ও  ব্যাপক শিল্পবিকাশ ঘটিয়ে  স্থানীয় বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ উদ্‌বৃত্ত শ্রমিক অঞ্চলে শ্রম নিবিড় (লেবার-ইনটেনসিব্‌) শিল্প ও  ঘাটতি শ্রমিক এলাকায় মূলধন-নিবিড় শিল্প গড়ে, তুলতে হবে৷ এইভাবে  স্থানীয়  মানুষের  হাতে  অর্থনৈতিক শক্তির  পরিচালনার ভার  তুলে দিতে হবে৷

এইভাবে যথাযথ পরিকল্পনা মফিক শিল্পবিকাশ ঘটিয়ে (সমবায়কে প্রাধান্য দিয়ে) ১০০ শতাংশ  স্থানীয়  মানুষের  কর্মসংস্থানের  ব্যবস্থা করতে হবে৷ যে শিল্পগুলির উৎপাদিত  দ্রব্য অন্যান্য শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে  ব্যবহৃত হবে---সেই সমস্ত শিল্পের পরিচালনার ভার স্থানীয় প্রশাসনের  হাতে ন্যস্ত করতে হবে৷

যেমন , শিল্পের  ক্ষেত্রে  রাজ্য সরকার  বা স্থানীয়  প্রশাসনের  হাতে থাকবে সূতা কল পরিচালনার  ভার৷ তারা  ‘না লাভ না ক্ষতি’র ভিত্তিতে ব্লকে ব্লকে ব্যাপকভাবে খোলার সমবায় বয়নশিল্পকে  সূতা  সরবরাহ করবে৷  আবার সমবায় বয়ন শিল্পগুলি বস্ত্র তৈরী করে  গ্রামে গ্রামে  গড়ে ওঠা কুটির শিল্পের মাধ্যমগুলিতে  রঙ  করার কাজ  (যেমন শাড়ীতে  বাটিকের কাজ) করিয়ে নেবে৷ বাড়ীতে  বাটিকের  কাজ  করিয়ে নেবে৷ বাড়ীতে বসে মহিলারা, বৃদ্ধরাও এই  কাজ করতে পারবে৷

এইভাবে প্রাউটে প্রতিটি এলাকার স্থানীয় সম্ভাবনার  সর্বাধিক উপযোগের  ভিত্তিতে কৃষিও শিল্প বিকাশের  পরিকল্পনা নিয়ে নোতুন করে উন্নয়ণ-যজ্ঞ শুরু করতে হবে৷ তবেই দেশের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা সমাধান হবে৷