দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস ও তাৎপর্য

লেখক
সম্পাদনা ---আশীষ দত্ত রায়

অনেকের ধারণা দুর্গাপূজা খুব পুরানো পূজা, কিন্তু তা মোটেই নয়৷ মুসলমান যুগেই এর প্রচলন হয় অর্থাৎ একেবারেই পুরানো নয়৷ বর্তমানে শরৎকালে বাঙালী হিন্দুরা যে দুর্গাপূজা করেন তার ভিত্তি হচ্ছে কৃত্তিবাস ঠাকুরের বাংলা রামায়ণ৷ কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে আছে যে রামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গা পূজা করেছিলেন ১০৮টা কমল দিয়ে৷ কিন্তু বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণে এ কাহিনী নেই৷ তুলসী দাসের রামচরিত মানসেও এসব কথা নেই৷ রামচন্দ্র যদি দুর্গাপূজা করতেন তাহলে তা অবশ্যই বাল্মীকি রামায়ণে থাকত৷

তাহলে প্রশ্ণ জাগে কৃত্তিবাস ঠাকুর এ কাহিনী পেলেন কোথায়? আসলে বাংলায় প্রথম দুর্গা পূজা করেছিলেন বরেন্দ্রভূমির রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায়৷ কংস নারায়ণের প্রচুর টাকা ছিল৷ তিনি পণ্ডিতদের বললেন দেখ, কলিকালে তো রাজসূয় যজ্ঞের বিধি নেই৷ তা’ তুমি মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে দুর্গা পূজার উল্লেখ আছে, খুব টাকা খরচ করে তা-ই করো৷ কংস নারায়ণ তখন সেকালের সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে দুর্গা পূজা করলেন৷ তা দেখে পরের বছর একটাকিয়ার রাজা জগদ্বল্লভ মতান্তরে জগৎ নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ করে দুর্গাপূজা করলেন৷ তারপরে জমিদারে জমিদারে রেষারেষি, প্রতিযোগিতা লেগে গেল৷ জমিদারের ঘরের পূজা হয়ে দাঁড়াল দুর্গা পূজা৷ আসলে উদ্দেশ্য ছিল কার কত টাকা তাই দেখানো৷ প্রচুর লোক খাইয়ে দেব, প্রচুর সাজগোজ  করাব৷ প্রতিযোগিতা চললো জমিদারে জমিদারে৷ ছোট হোক, বড় হোক, মেঝো হোক সব জমিদারই দুর্গা পূজা শুরু করলেন৷ এখন যেমন কলিকাতার ক্লাবগুলোতে দুর্গাপূজা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে৷ এ হচ্ছে পাঠান যুগের কথা৷

সেই সময় হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ার বারজন বন্ধু ভাবলেন যে আমরা একক ভাবে না হয় পারব না, কিন্তু বার জনে মিলে তো পূজার আয়োজন করতে পারি৷ উর্দু ভাষায় বন্ধুকে বলে ‘ইয়ার’৷ তাই বার জন ইয়ারে মিলে যে দুর্গা পূজা করলেন সেটা হলো ‘বার ইয়ারী’ পূজা-বারোয়ারী পূজা৷ কিন্তু বারোয়ারী পূজায় যেহেতু ‘অন্তজ’ লোকেদের অঞ্জলি দেবার অধিকার থাকে না, সেই জন্যে অতি আধুনিককালে বারোয়ারী পূজা বিবর্ত্তিত হয়ে হ’ল সার্বজনীন দুর্গা পূজা৷ এতে সবাইকার সমান অধিকার  থাকে৷ বর্তমানে এই সার্বজনীন দুর্গা পূজা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ‘সার্বজনীন দুর্র্গেৎসব’৷

এই দুর্গা পূজা পাঠান যুগে গোড়ার দিকে শুরু হয়৷ তখন বাঙলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ৷ হুসেন শাহ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন৷ বাংলা সাহিত্যে যাতে ভাল ভাল বই লিখিত হয়, সংস্কৃত ভাষার ভাল ভাল বইগুলো যাতে বাংলায় অনুদিত  হয় সেই জন্যে তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না৷ তাঁর অনুরোধেই কবি কৃত্তিবাস ঠাকুর বাংলা ভাষায় রামায়ণ লিখলেন৷ বাঙলায় সে সময়ে জমিদার বাড়ীতে দুর্গা পূজা শুরু হয়ে গেছে৷ এই দুর্র্গ পূজাটাকে অধিকতর মহিমা দেবার জন্যে তিনি তাঁর বাংলা ভাষায় লেখা রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গা পূজার কথা উল্লেখ করেছিলেন৷ তাই রাম যে দুর্গা পূজা করেছেন বলা হয় তার সূত্র হ’ল বাংলায় রচিত কৃত্তিবাসের রামায়ণ৷

মার্কণ্ডেয় পুুরাণ যার সংক্ষিপ্ত নাম চণ্ডী, এতে দেবী দুর্গার  কথা রয়েছে৷ রাজা সুরথ দুর্গা পূজা করেছিলেন তার উল্লেখ আছে৷ কিন্তু রাম যে দুর্গা পূজা করেছিলেন সে কথা নেই৷ পুরাণ মানে যার ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, কিন্তু শিক্ষাগত মূল্য রয়েছে৷ তাই চণ্ডী পুরাণেরও শিক্ষাগত মূল্য অবশ্যই রয়েছে৷ এখানে আছে, দেবী দুর্গা দশ হাতে প্রহরণ ধারণ করে মহিষাসুররূপী অশুভ শক্তিকে, পাপশক্তিকে সংগ্রামে পরাজিত করে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন৷ এখানে দেবী দুর্গা হলেন সমস্ত শুভ শক্তির প্রতীক, আত্মিক শক্তির প্রতীক৷ অসুরের অত্যাচারে, পাপীদের অত্যাচারে, অশুভ শক্তির অত্যাচারে যখন মানবতা ভূলুন্ঠিত, নিষ্পেষিত, পর্যুদস্ত তখন সমস্ত দেবতারা অর্থাৎ সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা সমস্ত নিপীড়িত নির্যাতীতরা সংঘবদ্ধ হলেন, তাদের আকুল আবেদনে আবির্ভূতা হলেন আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা৷ তিনি সমস্ত শুভ শক্তি সম্পন্ন মানুষের শক্তিকে একত্রিত করে আসুরী শক্তিকে সংগ্রাম পরাজিত করলেন৷

আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আসুরী শক্তি আবার জেগে উঠেছে, পাপশক্তির অভ্রংলেহী আস্ফালনে চারিদিক কেঁপে উঠেছে৷ মানবতা আজ নির্যাতিত, ভূলুন্ঠিত৷ তাই আজ দরকার সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের একতাবদ্ধ হয়ে আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা৷ নির্যাতিত, ভূলুন্ঠিত মানবতাকে রক্ষা করা৷ আর তা করতে পারলেই আমাদের দুর্র্গেৎসব সার্থক হবে৷ সমাজে ফিরে আসবে শান্তি৷ দুর্র্গেৎসব তাই আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হোক৷

এখন এই সংগ্রাম কি শুধু বাইরের আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে? না, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এই আসুরী শক্তি রয়েছে৷ প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে রয়েছে ষড়রিপু আর অষ্টাপাশ৷ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ছয়টা হ’ল রিপু আর ঘৃণা, শঙ্কা, ভয়,লজ্জা, জুগুপ্সা, কুল,শীল, মান এই আটটা হ’ল পাশ৷ মানুষ এই ষড়রিপু আর ষড়রিপু আর অষ্টপাশের বশীভূত হয়ে ছুটে চলে জাগতিক ভোগের দিকে৷ এই বৃত্তিকে চরিতার্থ করতেই সে অন্যের প্রাণরস নির্মমভাবে  শোষণ করছে৷ অন্যের ওপর অত্যাচার করছে৷ তাইতো সমাজে এত হানাহানি, এত রক্তপাত৷

এখন মানুষকে এর থেকে বাঁচতে হলে তার আত্মিক শক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে৷ মনের সমস্ত  শুভবৃত্তিকে বিকশিত করতে হবে৷ তার ববির্মুখী বৃত্তি অর্থাৎ ষড়রিপু ও অষ্টপাশের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে৷ তাই মানুষকে বহির্জগতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সাথে তার অন্তর্জগতের বহির্মুখী বৃত্তির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে চলতে হবে৷ এই বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে  সংগ্রামের প্রতীক হোক দুর্র্গেৎসব৷

জগদ্ধাত্রী পূজা ঃ রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় যে শরৎকালীন দশভূজা দুর্গাপূজারপ্রবর্তন্ করেন তা বাংলায় অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রথমে  জমিদারদের মধ্যে তারপর অন্যান্যদের মধ্যে৷

বলাবাহুল্য সেকেলের নামী জমিদার নদীয়া এষ্টেটের রাজারাও দুর্গা পূজা শুরু করেছিল খুব ধুমধাম করে৷ একবার  আশ্বিনের কিস্তিতে মালগুজারীর টাকা বাকী পড়ায় বাঙলার  নবাব কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করেন৷ দুর্র্গপূজার সময় তাকে আটকে থাকতে হল মুর্শিদাবাদের কারাগারে৷ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ফিরে এলেন কোজাগরী পূর্ণিমার পরে৷ তখন তো আর নতুন করে দুর্গাপূজা করা যায় না৷ তিনি বললেন, স্বপনে তিনি এক দেবী মূর্তি দেখেছেন৷ রাজার মুখ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেল তা তন্ত্রোক্ত রাজরাজেশ্বরী বা ষোড়শীদেবীর সঙ্গে মেলে যা হিন্দু ও মহাযানী বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রে স্বীকৃতা৷ তখন তিনি ঘটা করে এই পূজা করলেন---দেবীর নাম হল জগদ্বাত্রী (জগদ্ধাত্রী শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে জগতের যিনি ধাত্রী)৷ পূজোটি অনুষ্ঠিত হল দুর্র্গপূজো অনুষ্ঠিত হবার ঠিক এক মাস পরে শুক্ল পক্ষে৷ কিন্তু সময় অল্প থাকায় দেবী পক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পূজা একসঙ্গে নবমীতে সারা হল৷ কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজোর এই ধূমধাম দেখে সেই সময়কার নদীয়া এষ্টেটের দীবান সম্ভবত গঙ্গাগোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের শহর চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রবর্তন করেন৷ দুর্গাপূজা যেমন প্রাচীন নয় পাঠান আমলের পূর্ববার্দ্ধের জিনিস, তেমনি জগদ্ধাত্রী পূজাও বাঙলার নবাবী আমলের অন্তিমকালের৷

(শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের বাংলা ও বাঙালী, আনন্দবচনামৃতম, নমঃ শিবায় শান্তায় পুস্তক অবলম্বনে)---

 

উৎসবের উন্মাদনায় বিপন্ন না হয় মনুষ্যতর জীব

নিজস্বসংবাদদাতা ঃ সামনে কালীপূজা, দীপাবলী৷ আলোর রোশনাই আর শব্দবাজির ধূম৷ আর এই উৎসব অনুষ্ঠানে মানুষ হুল্লোড়ে মাতে৷ অনেক সময় তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়৷ উৎসব অনুষ্ঠানে পশুপাখীরা যে ব্রাত্য, তা কয়েক বছর আগে রাজগঞ্জে দূর্র্গপূজা উপলক্ষ্যে দেখা গিয়েছিল৷ কার্ণিভালে জোরালো আলোও শব্দের ভয়ে রায়গঞ্জে বলদ গুঁতিয়ে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল একজন মানুষের৷ এযেন উৎসবের  দুধে এক ফোঁটা চোনা৷

অনেক সময় দেখা যায় দোল-হোলিতে রঙ দিয়ে রাঙানো হয় পথ কুকুরদের৷ বেচারী কুকুর কয়েকদিন ধরে জিভ দিয়ে নিজের ত্বক পরিস্কার করার অবিরাম চেষ্টা করে থাকে৷ ফলে পেটে যায় রাসায়নিক রঙ৷ অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ বছর ভর কুকুরগুলো ভোগে চামড়ার রোগে৷

বাঙালীদের শোভাযাত্রায় আজকাল ঘোড়ার গাড়ীর ব্যবহার বেড়েছে৷ ঘোড়াদের কানের কাছে বাজে তাসা, ব্যাণ্ডপাটি, আর পায়ের কাছে, ঘোরে চরকি বাজি৷ ঘোড়া বেচারী ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে৷

দীপাবলী আলো আর শব্দের তাণ্ডবের উৎসব৷ সারা বছর ধরে শহরে চলে বিভিন্ন ধরণের নির্র্মণকাজ, মিছিল, গাড়ী চলাচল ইত্যাদির জন্য জীবজন্তুদের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ এর সঙ্গে লাউড স্পীকার ডিজে বাজানো অথবা বাজী ফাটানো হয়, ফলে পশু পাখীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে৷ তাদের রক্তচাপ যায় অনেক বেড়ে৷ তারা বাধ্য হয় এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাঁচার তাগিদে৷ কারণ শহরেই তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ হয়৷ কিন্তু মারাত্মক কুপ্রভাব পড়ে তাদের শরীরে৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে রাস্তাঘাটের উজ্বল ল্যাম্পপোষ্ট বহুতল ভবন৷ বিশেষ জায়গায় আলোকসজ্জা ইত্যাদি পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে৷ গাছের গায়ে জড়ানো এল-ইডি আলো, বা তাদের ওপর ফোকাস করা তীব্র আলোয় শুধু যে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাই নয় ওইসব গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখীরাও তীব্র আলো ও শব্দের  জন্য ঘুমোতে পারে না৷ তাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায়  ব্যাঘাত ঘটে৷ রাতের উজ্জ্বল আলোয় দিগভ্রান্ত পাখীরা হয় পথভ্রষ্ট৷ উদ্ভিদ ও পশুপাখীদের এই বিপন্নতা প্রকৃতি থেকে তাদের বিলুপ্তির সময় ত্বরান্বিত করছে৷

মনে রাখা দরকার মানুষের সুষ্ঠভাবে সমাজে বাঁচার স্বার্থেই দরকার-পর্বত অরণ্য, খাল,বিল, জলাশয়, নদ-নদী, জল-হাওয়া, গাছপালা, পশুপাখী সমন্বিত আমাদের এই প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথোচিতভাবে রক্ষা করা অর্থাৎ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ভূ-প্রাকৃতিক ও জীব বৈচিত্র্যে অজৈব ও জৈব শৃঙ্খলকে রক্ষা করা৷ প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য সুদূঢ় হলেই মানবজাতি জীবন দীর্র্ঘয়ু ও জীবনযাপন মসৃন হবে---একথাটা মানুষ যত তাড়াতাড়ি বোঝে ততই মঙ্গল৷