২০২৪-এ তৃতীয়বার দিল্লিতে ক্ষমতায় পুনর্বহাল বিজেপি৷ বাম কংগ্রেসের ব্যর্থতায় ও রাজ্যে তৃণমূলের বিরোধী দল ভাঙনের খেলার সুযোগ নিয়ে বিজেপি রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলেও নবান্ন থেকে এখনও বহু দূরে৷ বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও বাঙালী বিদ্বেষী রাজনীতি তার দলীয় কর্মসূচী৷ স্বাধীনতার আগে থেকে বহু চেষ্টা করেও বাঙলায় আর এস এস প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি৷ শ্যামাপ্রসাদের মতো ব্যষ্টিও বাঙলায় হিন্দুত্বের রাজনীতির শিকড় খুব গভীরে নিয়ে যেতে পারেনি৷ নেহেরু পটেলের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন নিয়ে বাঙলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, উদ্বাস্তুর ভারে জর্জরিত বাঙলাকে আর্থিক বঞ্চনা, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মাতৃভাষা বাংলার অধিকারের দাবীতে উর্দুর বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন ও ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারীর ওপারের মুসলিম বাঙালীর রক্তস্নাত গণজাগরণ দেখে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুত্বের মোহে হয়তো চিড় ধরেছিল৷ কিন্তু ভুল সংশোধনের আগেই তার রহস্যজনক মৃত্যু হয় কশ্মীরে৷
বিজেপি তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরলেও আশানুরূপ ফল হয়নি৷ একক গরিষ্ঠতা হারিয়েছে৷ বাঙলাতেও ২০১৯ থেকে আসন ও বোট অনেক কম পায়৷ বিজেপি বুঝে যায় সুষ্ঠু নির্বাচনে বাঙলা দখল সম্ভব নয়৷ তাই বাঙালী বিদ্বেষের যে বীজ বিধান রায়ের হাত ধরে নেহেরু বপন করেছিল মোদি শাহের হাতে পড়ে তাই এখন মহিরুহে পরিণত হয়েছে৷ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালী পরিযায়ী শ্রমিকরা বাংলায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছে এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে৷
বাংলায় প্রবাদ আছে কেউ ঠেকে শেখে, কেউ দেখে৷ দিল্লির শাসক ঠেকেও শেখে না, দেখেও শেখে না৷ ভাষার ওপর আঘাত করলে পরিণতি কি হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রতিবেশী বাংলাদেশ৷ এপারেও যদি বাংলার ওপর আঘাত আসে তার পরিনাম শিলচরের ভাষা আন্দোলন৷ শাসক বিজেপির বাঙলা দখলের এই স্বৈরাচারী প্রচেষ্টা দেশের সংহতির ভিত দুর্বল করছে৷ একদিকে বাঙলাকে আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত করে, তার ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে অবদমিত করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতি মোটেই ভালো হবে না৷ এক রাজ্যের সঙ্গে এক রাজ্যের, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ অন্য ভাষাগুলিকে অবদমিত করে হিন্দি চাপানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে৷
তবে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আসল লক্ষ্য বাঙলার ওপর৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারত ছাড়তে হয়েছিল বাঙলার বৈপ্লবিক শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে৷ তাই ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার আগে তাদের বিশেষ বন্ধু নেহেরুকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল দেশীয় পুঁজিপতি ও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও শাসন বজায় রাখতে হলে দেশে বাঙালী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে৷ ৭৭ বছর ধরে সেই কাজে নেহেরু থেকে নরেন মোদি অনেকটাই সফল৷ তাই আজ রাজ্যে রাজ্যে এত বাঙালী নির্যাতন, বাংলাভাষা ও বাংলাভাষীর ওপর আঘাত---শুধু পররাজ্যে নয় পশ্চিম বাঙলার বুকেও নেমে আসছে সেই আঘাত৷ তবুও বাঙলায় প্রতিবাদের কোন গর্জন নেই৷ স্বাধীনতার পর থেকে যে বাঙালী নির্যাতন বিভিন্ন রাজ্যে চলছে---বিধান রায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার নীরব দর্শক ছিলেন৷ বাঙালীর সামনে ক্ষীণ আশার আলো---এই প্রথম একজন মুখ্যমন্ত্রী বাঙালী নির্যাতনের প্রতিবাদে পথে নামলেন৷
কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না৷ বাঙলায় এখনও বর্গীর রক্তজাতও মীরজাফরদের উত্তরসুরি রয়েছে৷ তারাও রব তুলেছে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে৷ তবে যারা এই রব তুলেছে তাদের পূর্বপুরুষও ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে নানা কদর্য মন্তব্য করতো৷ তাই বিকৃত মানসিকতা, বিকৃত ভাবনাকে আমল না দিয়ে ভারতীয় বাঙালী জাতিকে ভারতে তার অস্তিত্ব রক্ষার পথ খুঁজতেই হবে৷ বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ধবংস করে বাঙালী জাতির মেরুদণ্ড ভাঙার কাজ প্রায় সম্পন্ন করে নিয়েছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শাসক ও শোষক৷ এখন শুধু বাঙালী জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার কাজটুকু বাকী, রাজ্যে রাজ্যে বাংলায় কথা বললেই বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়ন করার সেই শেষের প্রক্রিয়া৷ বাঙালী যদি এখনও গর্জে না ওঠে, রাজ্যে বাঙালীর প্রতি আগ্রাসন রুখতে না পারে তবে ভারতে বাঙালী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই বিপন্ন হবে৷
- Log in to post comments