মোদী সরকারের হঠকারী চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপের আর একটি নিদর্শন একেবারে তাড়াহুড়ো করে ১লা জুলাই মধ্যরাত থেকে জি.এস.টি (গুডস্ এ্যান্ড সার্ভিসেস্ ট্যাক্স) চালু করা৷ যদিও এর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, এর ফলে সারাদেশে একই করব্যবস্থা চালু হচ্ছে৷ ১৭ রকমের পরোক্ষ করকে একই ছাতার তলায় আনা হবে৷ একই জিনিসের জন্যে দুবার আলাদা কর দিতে হবে না৷ ইত্যাদি ইত্যাদি৷
এই জি.এস.টি চালু করার প্রথম চিন্তা করেছিলেন বাজপেয়ী সরকার৷ কিন্তু তখন বিশেষ সমর্থন পাওয়া যায়নি বলে তা চালু করা সম্ভব হয়নি ৷ পরে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারও এটিকে চালু করতে চেয়েছিল৷ তখন এই বিজেপি এই প্রবল বিরোধিতা করেছিল৷
এখন তা-ই করছে মোদী সরকার ১লা জুলাই গভীর রাতে মহাড়ম্বরে সংসদের মধ্যরাত্রির অধিবেশনে৷ বলা বাহুল্য, এ সময় কংগ্রেস, তূণমূল, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, ও বামপন্থীরা সংসদ বয়কট করেছেন৷ বিরোধীদের মধ্যে সংসদে উপস্থিত ছিলেন নীতীশ কুমারের দলের একজন প্রতিনিধি, এন.সি.পি’র শারদ পাওয়ার,স.পা. ও সিপিএম.এর অসীম দাশগুপ্ত৷ লক্ষ্যণীয়, বামদল সংসদ বয়কট করলেও সিপিএম-এর প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত সংসদে উপস্থিত ছিলেন৷ এটা বেশ কৌতুকজনক ব্যাপার ৷
জিএসটি কী ? জিএসটি হ’ল গুডস্ এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স৷ সারা দেশের জন্যে এক পণ্য ও পরিষেবা কর৷ কর---দু’ধরণের হয়, একটা হ’ল প্রত্যক্ষ কর আর একটা হল পরোক্ষ কর৷ আয়কর, সম্পত্তি কর প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করের আওতায় পড়ে৷ আর বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ও পরিষেবার ক্ষেত্রে যে নানান ধরনের কর--- যেমন বিক্রয় কর, যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট), আবগারি শুল্ক. পরিষেবা কর, বিনোদন কর--- এখন সব আসবে এক ছাতার তলায়৷ নাম হবে জি এস টি৷
বলা হচ্ছে এই পণ্যের ওপর একাধিকবার কর নেওয়া এবার বন্ধ হবে৷ ভ্যাট চালু সময়ও ওই একই কথা বলা হয়েছিল৷ বাস্তবে তেমন কিন্তু হয়নি৷
জি.এস.টি-র ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের অন-লাইনে মাসে মাসে রিটার্ন দাখিল করতে হবে৷ এজন্যে একটি নূতন সফট্ ওয়ার তৈরীও হয়েছে৷ বলা হয়েছে, একজন ব্যবসায়ী তার বিক্রয় করের ওপর ততটা ছাড় পাবে, যতটা সে কাঁচামাল কেনার সময় দিয়েছে৷ তবে এটা পাওয়া যাবে, যার কাছ থেকে সে মাল কিনেছে , সে যদি ঠিক তথ্য দেয় তবে৷ তার তথ্য দেওয়া সামান্য ভূল হলে করে ছাড় হবে না৷
তাছাড়া টেলিকম, ইন্টারনেট পরিষেবা দেশের তূণমূল স্তরে পৌঁছেছে কি? মূল প্রশ্ণটা তো এখানেই৷ দেশের কত শতাংশ মানুষ এর সুবিধা পেয়েছে, বা এর ব্যবহার জেনেছে বা এর ব্যবহার করার পরিস্থিতিতে আছে?
এই মৌলিক চিন্তাভাবনা না করেই একটা ধোঁয়াসাপূর্ণ জটিল (সরকার যদিও একে ‘অতি সহজ’ বলতে চান, কিন্তু দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের চোখে এটা জটিল) করব্যবস্থা দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে কি? বিশেষ করে এই যুক্তিটাই আজ দিয়েছে প্রায় সমস্ত বিরোধীরা৷ তাঁদের এই বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ এ ব্যাপারে রাজ্যের আয় কমবে ও কেন্দ্রের আয় বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷ আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, যে নূতন সফট্ ওয়ারের মাধ্যমে এই জিএসটি-র হিসেবপত্র অন লাইন-এ পাঠাতে হবে, ওই সফট্ ওয়ারটি এখনও মন্ত্রীরা পরীক্ষা করে দেখাননি বলে জানিয়েছেন৷
এর চেয়ে হঠকারিতা আর কী হতে পারে! নূতন কিছু একটা করতে হবে৷ কোনো কিছু ভাবনা চিন্তা না করে চোখ বন্ধ করে বেপরোয়াভাবে তীর চালাও শিকার জুটবেই ৷ এই হ’ল ,সরকারের নীতি৷
এদিকে মোদিজীর উপদেষ্টা জুটেছেন একদিকে আম্বানী, টাটা প্রভৃতি পঁুজিপতি শিরোমণিরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী৷ ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান’ এদের শ্লোগান৷ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘ক্যাশলেশ ইকোনমি’ প্রভৃতি অত্যাধুনিক বুলি৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর উপদেষ্টা মন্ডলীর পরামর্শ মত নোতুন কিছু একটা করতে যাচ্ছেন, দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের কথা তিনি ভাবছেন না, ভাবছেন কিছু উচ্চবিত্ত মানুষদের কথাই৷ দেশের যে মৌলিক সমস্যা----সমাজের যারা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত, শোষিত , নি:স্ব, রিক্ত, তাদের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান --- সেদিকে সরকারের ততটা লক্ষ্য নেই৷ লক্ষ্য পঁুজিপতিদের হাতে রাখা, আর তা রাখতে পারলে আগামী নির্র্বচনে লড়াইয়ের জন্যে যত টাকা দরকার পাবেন৷ তবে সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত যুবসমাজকে তিনি কৌশলে হাতে রাখতে চান৷
আজকাল স্যোশ্যাল মিডিয়ার যুগে--- ফেসবুক, টুইটারের যুগে এদের প্রচারটা খুব জরুরী৷ আর যাদের পেটে অন্ন নেই, পরনে উপযুক্ত বস্ত্র নেই , রোগে চিকিৎসা নেই, থাকবার ঘর নেই, শিক্ষা নেই--- ওদের মন জয় করার জন্যে কিছু দান খয়রাত করলে তাহলেই ওদের কাছে সহজে ‘ভগবান’ হওয়া হবে৷ আর ওই দান খয়রাতের টাকাটাও তো দেবে গৌরী সেন-রা অসুবিধা তো কিছুই নেই! তাই কেন্দ্রীয় সরকারের নূতন ব্যবস্থার মধ্যে লম্বা-চওড়া অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকলেও সারা দেশের বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সরকারের এই নীতিকে সহজে মেনে নিতে পারছে না৷
- Log in to post comments