জি.এস.টি ---প্রারম্ভিক ঢক্কানিনাদ ও ধোঁয়াশা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

গত ৩০শে জুন মধ্যরাত্রে সংসদের সেন্ট্রাল হলে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পণ্য-পরিষেবা কর বা গুডস্ এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স সংক্ষেপে জি.এস.টি-র পথ চলা শুরু হলো৷ সারা দেশে একই রকম কর ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের উদ্দেশ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে প্রায় সতেরো বছর আগে জি.এস.টির ভাবনা -চিন্তা শুরু হয়৷ পরবর্ত্তীকালে ২০১১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখ্যোপাধ্যায় সংসদে জি.এসটির সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন৷ এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরে আলাপ-আলোচনা, সহমত-ভিন্নমত-বিরোধিতা ইত্যাদির পথ পেরিয়ে বহু পবিবর্ত্তন , পরিবর্দ্ধন , পরিমার্জনের স্তর অতিক্রম করে ২০১৭ সালের ১লা জুলাই থেকে এক দেশ এক কর ব্যবস্থা জিএসটি চালু হলো৷ সংসদ ভবনের আলোকসজ্জা, ঐতিহ্যমন্ডিত সেন্ট্রাল হলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সাংসদ ও দেশের গণ্যমান্য ব্যষ্টিগণের  উপস্থিতিতে বহুবিধ প্রচারের ঢক্কানিনাদের মাধ্যমে জিএসটি চালু হলেও  বিরোধী দলগুলির অনুপস্থিতি ও দেশের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংঘটনের ধর্মঘট-প্রতিবাদ এই অনুষ্ঠানকে সামগ্রিক রূপ দিতে ব্যর্থ৷ এছাড়াও রয়েছে জিএসটি সম্পর্কে জনমানসে ও ব্যবসায়ী মহলে অস্পষ্টতা আর ব্যবহারিক  জটিলতার পূর্বাভাস৷

জিএসটি সম্বন্ধে বিভিন্নমহলের অভিমত বিভিন্ন রকমের ৷ কেউ বলছেন, জিএসটির ফলে বহু পণ্যের দাম কমবে, আবার কেউ বলছেন অনেক পণ্য ও পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি হবে৷ ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষ অনেকটাই বিভ্রান্ত৷ এখন দেখা যাক, জি এস টি কী? আমরা প্রতিদিন যে সমস্ত পণ্য ব্যবহার করি , হোটেলে রেষ্টুরেন্টে খাবার খাই, বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করি , আনন্দ উপভোগ করি, ব্যাঙ্ক-বিমা-পোষ্ট অফিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করি, ইন্টারনেট-মোবাইল প্রভৃতি ব্যবহার করি--- সবকিছুর জন্যই আমাদের বিভিন্ন রকমের ট্যাক্স বা কর প্রদান করতে হয়৷  এরমধ্যে রয়েছে কেন্দ্রকে প্রদেয় উৎপাদন শুল্ক , আমদানী শুল্ক, বিক্রয় কর, পরিষবা কর ইত্যাদি ও রাজ্যের ক্ষেত্রে  ভ্যাট, বিলাস ও বিনোদন কর, প্রবেশ কর ইত্যাদি৷ জি এস টি চালু হবার ফলে এই সব রকমারি কর, শুল্ক, সেস,সারচার্জ প্রভৃতির বদলে জি এস টির নিয়মানুযায়ী শূণ্য শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশ কর  প্রদেয় হবে৷  জি এস টির প্রয়োগ নিম্নলিখিত ভাবে প্রযোজ্য হবে---

১) কেন্দ্রীয় জি এস টি বা সি জি এস টি

২)রাজ্যের জি এস টি বা এস জিএসটি

৩)কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের  জি এস টি বা ইউটি  জি এস টি

৪) সম্মিলিত বা ইনটিগ্রেটেড  জি এস টি অর্র্থৎ আই  জি এস টি

উপরোক্ত ভাবে  জি এস টি ধার্য হবে বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার আদান-প্রদানের বা ক্রয়-বিক্রয়ের অবস্থান হিসেবে--- অর্থাৎ এই ক্রয়-বিক্রয় একটি রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত  অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে নাকি বিভিন্ন রাাজ্যের মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে তার উপর৷

 মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  জি এস টি কে গুড এ্যান্ড সিমপল ট্যাক্স অর্র্থৎ  ভাল ও সরল ট্যাক্স নামে অভিহিত  করলেও জি এস টির বিভিন্ন রকম বাস্তব প্রয়োগ ভৌমিক ও ব্যবহারিক দিকের জটিলতার জন্য  একদিকে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না  তাঁরা লাভবান হবেন না ক্ষতিগ্রস্ত হবেন--- ঠিক তেমনি রাজ্য সরকার গুলিও তাঁদের লাভক্ষতির হিসেব মেলাতে পারছেন না৷

জি এস টি ব্যবস্থা পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার ফলে ভারত বর্ষের মতো বিশাল গ্রামগঞ্জের এলাকাভুক্ত দেশের এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহল দ্বিধাবিভক্ত৷ জি এস টির জন্য প্রথমেই সংস্থাগুলিকে অনলাইনে নথিভুক্ত করিয়ে ‘‘প্রভিশনাল আইডি’’ নিতে হবে৷ জি এস টি চালুর প্রথম দিনে ‘‘জি এস টি নেটওর্র্য়ক’’ নামে সফট্ ওয়্যার ঠিকমতো কাজ  না করার ফলে ব্যবসায়ীরা নাম নথিভুক্ত করাতে পারেন নি৷ আশা করা যায় কয়েকদিনের মধ্যে এই অসুবিধা দূর হবে৷ এছাড়াও  ছোট ব্যবসায়ীরা সব চেয়ে বেশী অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন৷ প্রথমত তাঁদের কাছে আগে থেকে মজুত পণ্যের উপর করের হার ও পরিমাণ নিয়ে সঠিক ধারণা না  থাকায় বেচাকেনা করতে পারছেন না৷ দ্বিতীয়তঃ সেই ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব কিভাবে রাখবেন তাও সঠিক ভাবে না  জানা থাকায় ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি না থাকার ফলে ব্যবসা মার খাচ্ছে ৷ যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে  প্রান্তিক সাধারণ মানুষের কেনাকাটার উপর ৷ এই চিত্র মুদিখানা,ছোটব্যবসায়ী, ঔষধের দোকান, সর্বত্রই৷ শুধু তাই নয়, অনেক অতি প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ঔষধও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না --- যার ফলে বহুরোগী সংকট জনক অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন৷

কয়েকমাস আগে নোটবন্দির সময় বাজারে প্রচুর পণ্যের জোগান ছিল কিন্তু মানুষের হাতে পয়সা ছিল না৷ অথচ এখন মানুষের হাতে পয়সা থাকলেও প্রয়োজন মতো পণ্য পাচ্ছেন না শুধুমাত্র  জি এস টির ধোঁয়াশার জন্য ৷ যেটুকু আভাস পাওয়া যাচ্ছে , তাতে ঔষধপত্র , কাপড় চোপড় , ব্যাঙ্কের পরিষেবা, বিমার প্রিমিয়াম ইত্যাদির মহার্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা৷  এই কারণেই বস্ত্র ব্যবসায়ী ও আসবাব পত্র ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট -আন্দোলনে নেমেছে৷ বিমা ক্ষেত্রেও অসন্তোষ মাথাচারা দিচ্ছে৷

যে কোন প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে তার সার্বিক গ্রহণ যোগ্যতার উপর৷ প্রাথমিকভাবে কিছু বিভ্রান্তি,সংশয়, আশংকা অবশ্যই থাকে, সেই সব আশংকা বা বিভ্রান্তি দূর করবার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের৷ যতদূর জানা যাচ্ছে , বিরোধীদলগুলির ভিন্ন মত এখানেই ---সরকার খুব বেশি তাড়াহুড়ো না করে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আরো প্রস্তুতি নিয়ে জি এস টি চালু করলে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেত৷ বড় ব্যবসায়ীরা বা শিল্প মহল যারা প্রযুক্তির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ও যাদের ব্যবসাপত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে তাদের পক্ষে জি এস টি ব্যবস্থা মানিয়ে নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ও লাভ দায়ক৷ কিন্তু ভারতের গ্রামীন ক্ষেত্রে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে জি এস টি ব্যবস্থাকে রপ্ত করা সময় সাপেক্ষ ও ব্যয় সাপেক্ষ৷ তারা নিজেরা প্রযুক্তি বান্ধব না হওয়ার ফলে অন্য সংস্থাকে দিয়ে বেচা-কেনার হিসাব রাখা, মাসিক ও অন্যান্য রিটার্ন দাখিল করা, সাধারণ ক্রেতাগণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করা ইত্যাদির জন্য তাদের ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ক্রেতা সাধারণের ওপরেই৷ এছাড়াও অজ্ঞতার কারণে সময়ে সঠিক রিটার্ন ও কর দাখিল না করতে পারলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, এমনকি হাজত বাসের ভীতিও রয়েছে৷ তাই সরকারকে  এই সম্পর্কে অবশ্যই সদর্থক পদক্ষেপ করতে হবে যাতে সাধারণ ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ অযথা হয়রানির শিকার না হয়৷ শুধুমাত্র জাঁকজমকপূর্ণ প্রারম্ভিক  চমকের মধ্যে ব্যাপারটিকে সীমাবদ্ধ না রেখে ক্রমে ক্রমে যেন তা জনমুখী, জনকল্যাণধর্মী, ও সর্বজনগ্রাহী হয়ে ওঠে তার সর্র্বত্মক, সদর্থক ও সহানুভূতি পূর্ণ পদক্ষেপই  জি এস টি ব্যবস্থাকে সার্থক করে  তুলতে পারে৷