জয় শ্রীরাম উদ্যোগে নির্মলা সীতারমন জপে হরি হরি, মোদী জপে হর হর

লেখক
কৃষ্ণমোহন দেব

মানুষ মাত্রেই সাধারণ প্রবৃত্তি হলো সুখ পাওয়া৷ তবে সে ছোট খাটো সুখে অর্থাৎ যা পায় তাতে তৃপ্ত হয়না৷ আরও সুখ চাই আরও সুখ চাই বলে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত অধিক থেকে অধিকতর সুখ পাওয়ার পেছনে ছুটতে থাকে আর যতক্ষণ না সে অনন্ত সুখ লাভ  করছে ততক্ষণ তার জাগতিক সুখ পাবার পিছনে ছোটার বিরাম নেই৷ এই ছোটার বিরাম তখনই শেষ হবে  যখন সে অনন্ত বস্তু লাভ করবে৷ অনন্ত সত্তা একমাত্র ব্রহ্ম৷ জাগতিক সত্তার পেছনে ছোটা ছেড়ে ব্রহ্মপ্রাপ্তির পথে মানুষ একদিন তার অনন্ত সুখ পাওয়ার এষণাকে তৃপ্ত করতে পারবে৷ তাই মানুষের উচিৎ ব্রহ্ম ভিত্তিক জীবন গড়ে তোলা৷ যাদের এই ব্রহ্মভিত্তিক জীবনযাপন নেই তারা তাদের অনন্ত সুখ পাওয়ার এষণাকে জাগতিক বস্তু প্রতিপত্তি ক্ষমতা লাভের এই ভ্রান্ত পথকে অনুসরণ করার ফলে অন্যকে শোষণ করবেই, অন্যকে বঞ্চনা করবে৷ ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হবেই৷ বর্তমানে সমাজের বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির কারণ হল কিছু ব্যষ্টির বা কিছু গোষ্ঠীর (পার্টি সম্প্রদায় ইত্যাদি) অধিকতর সুখ পাওয়ার এষণাকে পূর্ত্তির জন্য অন্যদের চরমভাবে শোষণ করার ফলে৷ এতে আজ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷

এই শোষণ ব্যাপারে মার্ক্স কেবল অর্থনৈতিক শোষণের কথা বলেছেন৷ কিন্তু প্রাউটের দৃষ্টিতে শোষণ হলো---‘‘একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত জনগোষ্ঠীর-দৈহিক মানসিক ও আত্মিক বিকাশকে স্তম্ভিত করে ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে স্থানীয় জন শ্রেণীর শ্রম ও মানসিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠন হলো শোষণ৷ প্রাউট শুধু অর্থনৈতিক শোষণের কথা বলে না৷ প্রাউটের দৃষ্টিকোন থেকে অর্থনৈতিক শোষণছাড়া ও রয়েছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক শোষণ৷ এখন অর্থনৈতিক শোষণের পর্যায় ভাগ হলো---১) ঔপনিবেশিক শোষণ,২) সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও ৩) ফ্যাসিষ্ট শোষণ৷’’

 

১) ঔপনিবেশিক শোষণ

ঔপনিবেশিক শোষণ হলো---ঔপনিবেশিকগণ ‘‘প্রথমে একটি বাজার জখল করে৷ তারপর ওই অঞ্চলের কাঁচামালগুলি এক চেটিয়াভাবে তুলে নেয় ও নিজস্ব অঞ্চলে উৎপন্ন করে পুনরায় ওই বাজারে সেগুলি বিক্রয় করে৷ এই ব্যবস্থার মধ্যে  তারা দু’দিক থেকে সম্পদ লুন্ঠনের সুযোগ পায়৷ কাঁচামাল সংগ্রহ করার সময় স্থানীয় অধিবাসীদের ঠকায় ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীকে ওই বাজারে নায্যমূল্যের অধিকমূল্যে বিক্রয় করে৷ ঔপনিবেশিক শোষকেরা বাজারটিকে দখলে রাখার জন্যে স্থানীয় শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধবংস বা পঙ্গু করে  ফেলে৷’’

বাঙলার ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগটা ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের যুগ৷ ‘‘ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা বাঙলার বিশাল অর্থনৈতিক বাজারটা দখল করার জন্যে বাঙলার শিল্পগুলিকে ধবংস করে ছিল, আর বাঙালী শিল্পী ও কারিগরদের ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের নির্মিত কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হোত৷ ব্রিটিশ কোম্পানী কাঁচামাল সংগ্রহ করত লুন্ঠন করে ও জোর জুলুম করে ও কম দামে৷ আর কোম্পানী সেগুলি বিক্রয় করার সময়ে তাদের তৈরী পণ্য বিক্রি করত প্রকৃত মূল্যের  অধিক দামে, বাঙলার তাঁতীরা ভবিষ্যতে কোন দিন যাতে ম্যাঞ্চেষ্টারের উৎপন্ন শিল্পের ফলে প্রতিযোগিতা করতে না পারে তারজন্যে তাঁতীদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে তাদের শিল্পনৈপুণ্যকে ধবংস করে দিয়েছিল৷ বাঙলার রেশম, সূতি, চীনী, লবণ, লোহা, রঙ যন্ত্রপাতি জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি ধবংস করে অসংখ্য বংশ পরম্পরাগত কারীগরদের তাদের স্বাভাবিক রোজগারের পথ থেকে উৎখাত করে দেয়৷ এরফলে বাংলায় দেখা দেয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর৷’’ এ ছিল বাঙলার বুকে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শোষণ৷

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও স্বাধীন ভারতে এই ঔপনিবেশিক শোষণ বাংলার বুক থেকে মুছে যায়নি৷ ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের শোষণের থেকে আজকে বাঙলার বুকে ভারতীয় পুঁজিপতিদের শোষণ আরও গভীর ও ব্যাপকভাবে হয়ে চলেছে৷ ভারতীয় পুঁজিপতিরা পশ্চিমবঙ্গের খনিজ কৃষিজ ও বনজ সম্পদগুলি নায্যমূল্যের অনেক কম দামে সংগ্রহ করে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, রাজস্থানে, প্রভৃতি স্থানে সেগুলিকে পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত করে’ বাঙলার বাজারে অধিকমূল্যে বিক্রয় করে৷ বর্তমানে বাঙালীর উদয়াস্ত জীবনযাত্রার প্রতিটি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যই বাইরে থেকে উৎপাদিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে আসে অথচ সবগুলির উপকরণ ও কাঁচামাল যোগায় পশ্চিমবঙ্গ৷ ঠিক এই অবস্থার পাশেই পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব শিল্পগুলিকে ধবংসপ্রায়ও পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে এদের কাছে কাঁচামাল সরবরাহকারী ‘পরদেশ’ ও তাদের নিজস্ব অঞ্চলের উৎপাদিত সামগ্রী খালাসের এক বিশাল বাজার৷ তাদের মনস্তত্ব হল পরদেশ মে আয়া হ্যায় যেতনা হো সকে ল্যাঠো৷ এই হল ঔপনিবেশিক শোষণ৷

সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ক্ষেত্রে শোষকরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক শোষণের কাজে লাগায়৷ বাঙলার ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগ শুরু হয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরের যুগ থেকে৷ আইনই আকবরে উল্লেখ আছে বাঙলাকে মুঘল বাহিনীতে ২৩,৩০১ সংখ্যক অশ্বারোহী, ৮,০১,১৫৯ সংখ্যক পদাতিক,২৩০০ সংখ্যক নৌকা,৪২৬০টি কামান ও ১০৮টি  হাতি যোগান দিতে হত৷ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বাঙলাকে পূরণ করতে হত৷ আত্তরঙ্গ জেবের মারাঠা দমনের জন্যে বিপুল যুদ্ধোপকরণের রসদ ও ব্যয় যুগিয়েছিল বাঙলা৷ এর ফলে বাঙলার ঘরে ঘরে হাহাকার উঠেছিল৷ (ক্রমশঃ