কীর্ত্তন মহিমা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবল পরমপুরুষই চরম সত্য–একমাত্র সত্য, একমাত্র অপরিণামী সত্তা, আর তাঁর সৃষ্ট বাকি সব কিছুই পরিণামী সত্তা অর্থাৎ তারা নিয়ত পরিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ তাই সেগুলোকে বলতে পারি আপেক্ষিক সত্য, চরম সত্য নয়৷ চরম সত্য হ’ল একমাত্র পরমপুরুষ৷ চরম সত্য সর্বদাই এক, তা কখনও দুই হতে পারে না৷

এই চরম সত্যের যে চক্রনাভি–তাতে কোন পরিবর্ত্তন নেই৷ কোন গতি নেই৷ আবার চরম অগতিও নেই, আপেক্ষিক স্থিতিশীলতাও নেই৷ অবশ্য এই চক্রনাভির বাইরে রয়েছে গতিশীলতা কিন্তু সেখানে অন্য কোনও দ্বিতীয় সত্তা সেই৷

আমাদের এই ব্যক্ত জগতে রয়েছে আপেক্ষিকতার ভীড়৷ তাই সেখানে আছে সুখ–দুঃখ ব্যথা–বেদনার সমারোহ৷ পরমপুরুষের এই আপেক্ষিক জগতেই মানুষের অবস্থিতি৷ মানুষ–পশুপক্ষী, উদ্ভিদ সকলের লক্ষ্য হ’ল এই পরমপুরুষ৷ পরমপুরুষের দিকে সকল মানুষের এই যে বিরামহীন যাত্রা, এটাই হ’ল মানুষের প্রগতি৷ মানুষের চলার উপযুক্ত পথ হল পরমপুরুষের দিকে চলা৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই৷ অন্য কোন পথকে অগ্রগতির পথ বলে মানাও চলে না, কারণ তাতে মানব মনীষার, মানব আত্মার উন্নতি হয় না৷ যা মানুষের অস্তিত্বের সকল অংশকে–শরীরকে, মনকে, আত্মাকে উন্নীত করে পরমপুরুষে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেয় সেটাই যথার্থ উন্নতি৷ এইটারই নাম সাধনা৷

চলাই মানুষের ধর্ম–চলতে মানুষকে হবেই৷ এই চলার পথে বাধা আসবেই–ভবিষ্যতেও আসবে৷ এই ব্যক্ত জগতে নানান শক্তি ক্রিয়াশীল এই শক্তিগুলোর কোন কোনটি মানুষকে পরমপুরুষের কাছে পৌঁছুতে সাহায্য করে৷ কেউ বা দূরে সরিয়ে দিতে চায়৷ যারা সরিয়ে দিতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই সাধককে এগিয়ে যেতে হয়৷ ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়ালে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না৷ বরং বাধা এলে আরও দৃৃতর পদবিক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে সমস্ত বাধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে৷ এই যে নিরলসভাবে পরম তত্ত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া–এই হ’ল সাধনা, আর এই যে সাধনা যা নিরলসভাবে মানুষ করে যাবে আর করে যাবার জন্যেই এই পৃথিবীতে এসেছে, কে এই সাধনাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে? – না, কীর্ত্তন৷ কীর্ত্তন করে কী? – না, পরমতত্ত্বের দিকে সাধকের চলার যে গতি সেই গতিতে দ্রুতি এনে দেয়৷ তাছাড়াও কীর্ত্তন বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন অবস্থায় সাধককে সাহায্য করে৷

আপেক্ষিক জগতের নানান বাধাবিপত্তির ভীড় ঠেলে তবেই না মানুষ শেষ পর্যন্ত পরম তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ জীবের মুখ্যতঃ তিন রকমের দুঃখ–প্রপাঞ্চিক বা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক আর আধ্যাত্মিক৷ এই আধিভৌতিক দুঃখও যেমন দুঃখ তেমনি আধিদৈবিক বা মানসিক ক্লেশও ক্লেশ, আধ্যাত্মিক ক্লেশও ক্লেশ৷

এখন প্রশ্ণ হ’ল, আধ্যাত্মিক ক্লেশ জাগে কেন? তোমরা জান যে মানুষ পরম পুরুষের স্নেহের পুত্ত্র-কন্যা৷ তবুও তো সব সময় তাঁকে কাছে পাচ্ছে না, সব সময় তাঁর স্নেহময় কোলটিতে বসবার সুযোগ পাচ্ছে না৷ এই ক্ষোধ থেকেই সাধকের মনে আধ্যাত্মিক ক্লেশের উদ্ভূতি৷

এই যে ত্রিবিধ দুঃখ, এর আত্যন্তিকী নিবৃত্তির একমাত্র উপায় হ’ল সাধনা৷ তাই মানুষ যত পারে সাধনা করবে৷ তাই মানুষের জীবনে সাধনা অতি প্রয়োজনীয়৷ সাধনা যদি ছেড়ে যায়, নাওয়া–খাওয়াও যেন ছেড়ে যায়, নিদ্রাও যেন ছেড়ে যায়৷ এই দু’টি নিয়ে যেমন মানুষকে চলতে হয় তেমনি সাধনার সর্বাধিক সহায়ক যে কীর্ত্তন যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে, সময় পাওয়া যাবে সেটাও করতে হবে৷ এতে বিদ্বান–বিদ্বানের ভেদ নেই, কোন রকম ভেদ নেই৷

আর এই যে কীর্ত্তন, এ মানুষের জাগতিক ব্যাধির যে নিরাময় ঘটাবে শুধু তাই নয়, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতেও সফলতা এনে দেবে, আর মানুষকে তার চরম লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে৷ কীর্ত্তন সর্বাবস্থাতেই সর্বতোভাবে সাধককে সাহায্য করে দেবে৷

মানুষ যদি মুখে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করে কীর্ত্তন করে তাতে তার মুখ পবিত্র হয়, জিহ্বা পবিত্র হয়, কাণ পবিত্র হয়, সমস্ত শরীর পবিত্র হয়৷ আর এই এতগুলো পবিত্র হওয়ার ফলে আত্মাও পবিত্র হয়৷ কীর্ত্তনের ফলে মানুষ এতখানি পবিত্র হয়ে ওঠে যে সে অনুভব করে যেন সে সবেমাত্র গঙ্গাস্নান সেরে এল৷ সাধকের পক্ষে গঙ্গাস্নান মানেই হ’ল সদা কীর্ত্তন৷

কাজেই বৃথা গাল–গল্পে সময় নষ্ট না করে মানুষ সময়–সুযোগ পেলেই কীর্ত্তন করবে৷ এমন কি, দুচার মিনিট সময়ও অবসর পেলে কীর্ত্তন করে নেবে৷ বৃথা কাজে সময় নষ্ট করা মূর্খতা৷ মানুষের শরীর যে পেয়েছে সে মূর্খ নয়৷ তার ৰুদ্ধি অবশ্যই আছে৷ মনে মনে জানে যে সে পরমপুরুষের সন্তান৷ কাজেই মূল্যবান সময় অনর্থক নষ্ট করবে কেন?

কীর্ত্তনের দ্বারা মানুষ অনুভব করে যে সে তুচ্ছ নয়৷ সে কারো চেয়ে হীন নয়, নীচ নয়৷ কীর্ত্তন মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, ‘‘সাধক, মনে রেখো, তুমি পরম পিতার স্নেহের সন্তান’’৷ কীর্ত্তনে স্থান–কালের বিচার নেই–বিদ্বান–মূর্খ, শাদা–কালোর ভেদ নেই৷ তাই যখনই পারো আর যেভাবে পারো কীর্ত্তন করবে৷

১৫ মে ১৯৮২, কলিকাতা

****

কালকে বলেছিলুম যে কীর্ত্তন আধ্যাত্মিক সাধনায় মানুষকে সাহায্য করে, অধ্যাত্ম জগতে সাধকের চলার গতিতে দ্রুতি এনে দেয়৷ কীর্ত্তন হচ্ছে ‘সাধনাসহায়কম্’৷ কিন্তু কীর্ত্তন কেবল যে আধ্যাত্মিক সাধনায় সাহায্য করে তাই নয়, জীবনের সর্বভূমিতেই সেটা মানুষকে সাহায্য করে৷ কীর্ত্তন এই পাঞ্চভৌতিক জগতের–আধিভৌতিক জগতের দুঃখ–ক্লেশ দূর করে৷ জাগতিক যত বাধা–বিপত্তিই আসুক না কেন, কীর্ত্তন সেই সবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ও পরিণামে জয়যুক্ত হয়৷

কীর্ত্তনের সময় হয় কী?–না, কতকগুলো মানুষ যখন মিলে মিশে কীর্ত্তন করছে তখন সেই মানুষগুলির শারীরিক শক্তিই যে একত্রিত হচ্ছে তাই নয়, তাদের মিলিত মানস শক্তিও একই ভাবধারায় আর একই পরমপুরুষের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে, প্রেষণা পেয়ে একই ধারায় একই খাতে বইতে থাকে৷ তাই সেখানে কেবল যে একটা বিপুল জড় শক্তির সমাবেশ ঘটে তাই নয়, মানস শক্তিরও একটা অতি বিরাট সমাবেশ ঘটে৷ আর সেই মিলিত জড়শক্তি ও মিলিত মানস শক্তি এই প্রপাঞ্চিক জগতের পুঞ্জীভূত দুঃখ–ক্লেশকে দূর করে দেয়৷

প্রতিটি মানব হূদয়েই পরমপুরুষের প্রতি আত্যন্তিকী নিষ্ঠা রয়েছে, প্রেম–ভালবাসা রয়েছে৷ আর যাঁরা কীর্ত্তন করছেন তাঁরা তো আসলে পরমপুরুষের ভক্ত৷ তাই তাঁদের হূদয়ে পরমপুরুষের জন্যে সিংহাসন তো পাতা আছেই৷ তাই ভক্তেরা যখনই মিলিত কীর্ত্তন করেন, তখনই পরমপুরুষ সেই ভক্ত হৃদয়ের সিংহাসনে এসে উপবেশন করেন৷ পরমপুরুষ তখনই তাঁর কেন্দ্রবিন্দুকে সেই স্থানটিতে স্থানান্তরিত করেন৷ সেটাই হয়ে দাঁড়ায় পরমপুরুষের দিব্য রাজধানী (divine capital)৷

এখন প্রশ্ণ ওঠে–পরমপুরুষ কেন সেই স্থানটিতে আসেন? – না, পরমপুরুষ যে ভক্তদের খুবই ভালবাসেন৷ কাজেই ‘‘আমি ভক্ত হৃদয়ের সিংহাসনে এসে বসব না’’–এ ধরনের কথা পরমপুরুষ ভাবতেই পারেন না৷ তিনি আসবেনই, আসতে তাঁকে হবেই, আসতে তিনি ক্ষাধ্য৷ পরমপুরুষের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে অণুমনগুলি প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর তাঁদের সেই মিলিত দুর্বার মানস শক্তির সামনে কোন জাগতিক ক্ষাধাই টিকতে পারে না৷ তাই কীর্ত্তন যেমন সাধনার পক্ষে সহায়ক তেমনি জাগতিক বাধাবিপত্তি দূর করবার পক্ষেও ততখানিই সহায়ক৷

আধিভৌতিক জগতের দুঃখ–ক্লেশগুলোর কতকগুলি প্রকৃতির সৃষ্টি, কতকগুলি মানুষের নিজের সৃষ্টি৷ প্রকৃতিসৃষ্ট বা মনুষ্যসৃষ্ট যাই হোক না কেন, সম্মিলিত কীর্ত্তনের ফলে সমস্ত বাধা–বিপত্তি কেটে যায়, সামূহিক বিপদ দূর হয়৷ বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপদে বা মুনষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের সময়ে মানুষ যদি প্রাণভরে নিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত কীর্ত্তন করে, তৎক্ষণাৎ মানুষের ক্লেশের উপশম হবে৷

এ ছাড়াও কীর্ত্তনের ফলে বহুবিধ মানসিক ক্লেশেরও উপশম ঘটে থাকে৷ যে সমস্ত বিপদ ইতোপূর্বেই এসে গেছে আর যে সব বিপদ এখনও আসেনি কিন্তু আসবার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে–তা সবই দূর হয় এই কীর্ত্তনের ফলেই৷ যদি আগেই কীর্ত্তন করা হয়, তাহলে অনাগত বিপদ–বাধা এসে পড়ার আগেই সেগুলো প্রিমনিশনের স্তরেই, প্রগ্নসিসের ত্নব্জপ্সন্ধুপ্সব্দন্ব্ স্তরেই সরে যায়৷ কেন সরে? –না, কেবল যে সম্মিলিত মানস শক্তির চাপে সরে তা নয়, এতগুলো মানুষের মন এক পরমপুরুষের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে দুর্দান্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলে, তারই চাপে সরে৷

যেখানে কীর্ত্তন করা হবে, সেখানে যাঁরা কীর্ত্তনে যোগদান করবেন কল্যাণ যে কেবল তাঁদেরই হবে তাই নয়, যাঁরা অংশ গ্রহণ করবেন না তাঁদেরও হবে৷ আর যাঁরা অংশ নিচ্ছেন না, অপছন্দ করছেন তাঁদেরও ভাল হবে৷ তাঁরা যদি মন–প্রাণ দিয়ে শোণেন তো অবশ্যই তাঁদের ভাল হবে, তাঁরা যদি মন–প্রাণ দিয়ে না শোণেন, অশ্রদ্ধায় অবহেলায় শোণেন তাঁদেরও ভাল হবে৷ ‘‘শ্রদ্ধয়া হেলয়া বা’’৷ শ্রদ্ধার সঙ্গে শুণলেও ভাল হবে, অবহেলায় শুণলেও ভাল হবে৷

তাই সকল ৰুদ্ধিমান, সকল জ্ঞানী, সকল চালাক মানুষের উচিত–স্থান–কালের বিচার না করে কীর্ত্তন করা৷ আর যে কীর্ত্তন করছে তাকে সব সময় এই কথাটা মনে রাখতে হবে যে পরমপুরুষের বরদ–হস্ত সব সময়ই তার ওপর রয়েছে৷

১৬ মে ১৯৮২, কলিকাতা

***

মানুষের অস্তিত্ব স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন জগতেই৷ মানুষ কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক জীব নয়, কেবল মানসিক জীবও নয়, আবার শুধুমাত্র আত্মিক সত্তাও নয়৷ তিনে মিলে মানুষের অস্তিত্ব৷ মানুষের অভিব্যক্তিগুলো, অভিস্ফূর্ত্তিগুলো তিনটি তত্ত্বে, তিনটি স্তরেই হয়ে থাকে৷

মানুষ পরমপুরুষকে সেবা করবে তিনটি স্তরেই–প্রপাঞ্চিক স্তরে, মানসিক স্তরে ও আধ্যাত্মিক স্তরে৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, প্রপাঞ্চিক স্তরে মানুষ কীভাবে সেবা করতে পারে এই জীব–জগৎ পরমপুরুষের সৃষ্টি৷ এখন, জীবের বিভিন্ন প্রকারের দুঃখ নিবারণ করে’ বিভিন্নভাবে জীবকে পরিত্রাণের উপায় দেখিয়ে দিয়ে ও তাদের দায়িত্ব নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যে এগিয়ে দেবে, ‘‘তুই এগো, আমি পেছনে রয়েছি’’ এই বলে নয়, ‘‘আমি এগিয়ে চলছি, তুই আমার পেছনে পেছনে আয়’’–এই বলে সে জীব জগতের কল্যাণের দায়িত্ব নেবে৷

এই জগৎ পরমপুরুষের প্রিয় সৃষ্টি৷ জাগতিক জীবের–মানুষের, জীবজন্তুর, উদ্ভিদের সেবা করে আমরা পরমপুরুষকে আনন্দ দিতে পারি৷ আর এই জীব সেবাই হবে নব্যমানবতাবাদের সর্বোৎকৃষ্ট প্রয়োগ৷ জীব সেবা মুখ্যতঃ চার ভাবে করা যেতে পারে–বিপ্রোচিত, ক্ষাত্রোচিত, বৈশ্যোচিত ও শূদ্রোচিত সেবা৷ এই সেবাগুলোর কোনটাই তুচ্ছ নয়, কাউকে আমরা তাচ্ছিল্য করতে পারি না৷ মানুষ আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী অপরের সেবা করবে৷ যার বিপ্রোচিত সেবা পছন্দ, সে বিপ্রোচিত সেবা করবে৷ যার শূদ্রোচিত সেবা ভাল লাগে সে শূদ্রোচিত সেবা করবে৷ কিন্তু সবচেয়ে ভাল হয় যদি মানুষ সব রকম সেবাই করতে পারে৷

যারা ভাল মানুষ, তথাকথিত ভাল মানুষ তারা যদি সকল স্তরের জীবকে কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দিতে না পারে তাহলে তাদের ভাল মানুষ বলতে পারি না, তাদের গোবেচারা বলতে পারি, ভাল লোক বলতে পারি না৷ ভাল লোক সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলবে ৰাধা–বিপত্তির বিরুদ্ধে মূক জনসাধারণকে চলার পথে রসদ যোগাবে আর অপরকেও এগিয়ে চলতে উদাত্ত আহ্বান জানাবে৷

তেমনি আমাদের অস্তিত্ব মানসিক স্তরেও রয়েছে৷ আর মানুষের জীবনে মনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস৷ মানসিক স্তরে পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হ’ল অত্যন্তিকী নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে কীর্ত্তন করা৷ কারণ পরমপুরুষ যখন দেখবেন যে একটা মানুষের মন অথবা অনেকগুলি মানুষের মন তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে, পরমপুরুষ তাতে নিশ্চয় একটা আনন্দময় স্পর্শ অনুভব করবেন৷ আর এই যে এগিয়ে চলা, এতে ব্যষ্টিজীবনেরও লাভ আছে, সমষ্টি জীবনেরও লাভ আছে৷ সেটা হচ্ছে এই যে, মন একের দিকে এগিয়ে চলায় বহু সংঘর্ষজাত যে জটিলতা আজকের সমাজকে পেয়ে বসেছে তার কিছুটা কমবে৷

আজকের মানুষের এই জটিলতাময় জগতে প্রচুর পরিমাণে মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে৷ মানুষ পাগল হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে৷ তারও কারণ এই যে মানুষ বহুদৈশিক জটিলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না৷ মানুষের মস্তিষ্কের সামর্থ্য আর কতটুকু মানুষের স্নায়বিক শক্তিই বা কতটুকু তাই ক্রমবর্ধমান জটিলতার চাপ সে সহ্য করতে পারছে না৷ কিন্তু এই যে কীর্ত্তন, এ যেমন মানসিক জগতে পরমপুরুষকে আনন্দ দিচ্ছে তেমনি মানুষকেও এককভাবে ও সমষ্টিগতভাবে আনন্দ দিচ্ছে ও কল্যাণের পথ দেখাচ্ছে  বহুদৈশিক জটিলতা থেকে মানুষকে মুক্ত করছে, মানুষের ৰুদ্ধিও রোগমুক্ত হচ্ছে, মানুষ সহজভাবে ও যথাযথভাবে চিন্তা করবার সুযোগও পাবে৷

তাই বুদ্ধিমান মানুষ যত বেশী পারে কীর্ত্তন করবে৷ কোন একটা মানসিক জটিলতা থেকে চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে মানুষ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না এমন অবস্থায় এসে পৌঁচেছে তখন কোন ব্যষ্টি বা সমষ্টি যদি বসে খানিকক্ষণ প্রাণভরে কীর্ত্তন করে তাতে মানসিক জটিলতা দূর হয়ে যাবে, সমাধানের সূত্রও সামনে সে পেয়ে যাবে৷ তাই যদি হাতে পাঁচ মিনিটও সময় থাকে তো পাঁচ মিনিটের জন্যেও কীর্ত্তন করবে৷ আর যদি একলা থাক তো একলাই কীর্ত্তন করবে৷ যদি এক হাজার সাধক থাকে তো এক হাজার সাধক মিলেই কীর্ত্তন করবে৷

তোমরা জান, পরমপুরুষের একটি নাম আশুতোষ৷ আশু মানে শীঘ্র, আর আশুতোষ মানে যাঁকে খুব সহজে অল্পেতেই সন্তুষ্ট করা যায়৷ ভাল হোক, মন্দ হোক মানুষ যদি মন প্রাণ দিয়ে অল্পক্ষণের জন্যেও কীর্ত্তন করে তাতেও পরমপুরুষ সন্তুষ্ট হয়ে যান৷ তাহলে দেখছি পরমপুরুষকে সন্তুষ্ট করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়৷ বহু সাধক যখন মিলিতভাবে কীর্ত্তন করেন আর সকলের মিলিত মন পরমাত্মার দিকে পরমপুরুষের দিকে চলতে থাকে তখন পরমপিতার মনেও অপার আনন্দ হয় এই ভেবে যে অতগুলো মন তাঁর দিকে ছুটছে–অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিভরে কীর্ত্তন করছে৷ এই আনন্দে তিনিও অভিভূত হয়ে যান৷

এখন পরমপুরুষ তো সবাইকে ভালবাসেন৷ আর যাঁরা কীর্ত্তন করছেন তাঁদের তো আরও বেশী ভালবাসেন৷ তাঁদের আদর করে ডেকে বলেন–এসো, এসো, আমার কাছে এস, আরো কাছে এসো৷ মানসিক ক্ষেত্রে পরমপুরুষের সেবা করার এইটাই হ’ল উত্তম পন্থা, ঠিক উপায়৷

যাঁরা খাঁটি ভক্ত তাঁরা বিদ্বান হতেও পারেন, না–ও হতে পারেন, উচ্চশিক্ষিত হতেও পারেন, না–ও হতে পারেন৷ কিন্তু তাঁরা যদি কীর্ত্তন করেন তাহলে তাঁরা মানসিক ক্ষেত্রে পরমপুরুষের সেবা অবশ্যই করতে পারবেন৷ তাই আনন্দমার্গের ছেলে–মেয়েরা–তোমরা অবহেলায় এই দামী সুযোগ নষ্ট কোর না৷ তোমরা উন্নত মানব শরীর পেয়েছো, দেহ ও মন দিয়ে পরমপুরুষের সেবা করে এই মানব অস্তিত্বটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাও৷

আর আত্মিক জগতে পরমপুরুষের সেবা করার একটাই উপায়–তা হ’ল কঠোর সাধনা করা৷ কঠোর সাধনার দ্বারা পরমপুরুষের নিকট থেকে নিকটতর সম্পর্কে চলে এসো৷ আর তুমি যখন এভাবে চলতে চলতে তাঁর একেবারে কাছটিতে এসে পৌঁছবে, দেখবে আগে থেকেই তাঁর কোলের একটা স্থান কেবল তোমার জন্যেই খালি পড়ে রয়েছে৷ পরমপুরুষের কোটি কোটি সন্তান, সবাই তো তাঁর দিকেই আসছে৷ তবুও দেখবে, পরমপুরুষের কাছটিতেই তোমার জন্যে একটি স্থান আগে থেকেই সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে৷   

১৭ মে ১৯৮২, কলিকাতা